দেড় বছর ধরে ক্লিনিকে অস্ত্রোপচার করেন এইট পাস মনিরুল
নওগাঁর সাপাহারে সনদ ছাড়াই টানা দেড় বছর প্রসূতি নারীদের অস্ত্রোপচার করায় মনিরুল ইসলাম স্বপন নামে এক ক্লিনিক মালিককে এক মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। শুক্রবার (২২ সেপ্টেম্বর) বেলা সাড়ে ১১টার দিকে উপজেলা সদরের সততা ক্লিনিক অ্যান্ড নার্সিং হোমে অভিযান চালিয়ে ক্লিনিক বন্ধ, জরিমানা ও কারাদণ্ড দেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আবদুল্যাহ আল মামুন।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, অষ্টম শ্রেণি পাস মনিরুল ইসলাম স্বপন দেড় বছর আগে অনুমোদন ছাড়াই উপজেলা সদরে সততা ক্লিনিক অ্যান্ড নার্সিং হোম নামে একটি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান খোলেন। এরপর সেখানে অস্ত্রোপচারসহ বিভিন্ন স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার অনুমতি চেয়ে সিভিল সার্জন অফিসে আবেদন করেন। নিয়ম অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানটি পরির্দশন করে জেলা সিভিল সার্জন অফিসের প্রতিনিধি দল। তবে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার উপযুক্ত পরিবেশ না থাকায় ওই মুহূর্তে প্রতিষ্ঠানটিকে অনুমোদন দেওয়া হয়নি। তবে এতে মোটেও থেমে যাননি মনিরুল ইসলাম। নিজেই ওই ক্লিনিকে সার্জনের ভূমিকায় প্রসূতি নারীদের অস্ত্রোপচার করতেন।
বিজ্ঞাপন
সম্প্রতি মনিরুলের অপারেশন থিয়েটারে অস্ত্রোপচারের একটি ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। বৃহস্পতিবার রাতে স্থানীয় এক সাংবাদিকের মাধ্যমে ছবিটি পৌঁছায় জেলা প্রশাসকের কাছেও। এরপর জেলা প্রশাসকের হস্তক্ষেপে টনক নড়ে উপজেলা প্রশাসন ও স্বাস্থ্য বিভাগের। যার প্রেক্ষিতে শুক্রবার (২২ সেপ্টেম্বর) বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ওই প্রতিষ্ঠানে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে উপজেলা প্রশাসন।
পোরশা উপজেলার তেঁতুলিয়া ইউনিয়নের চরনারায়ণ গ্রামের জাহিদুল ইসলাম বলেন, ৮ মাস আগে অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীর সিজারের জন্য সততা ক্লিনিকে ভর্তি করিয়েছিলাম। ক্লিনিকের পরিচালক মনিরুল কথা দিয়েছিলেন আমাদের পছন্দের সার্জনকে এনে অপারেশন করাবেন। কিন্তু রোগীর অবস্থা গুরুতর হতে লাগলে নানা অযুহাত দেখিয়ে মনিরুল নিজেই অপারেশন থিয়েটারে ঢুকে অস্ত্রোপচার করেন। এরপর স্ত্রীকে বাড়িতে আনার পর পেটে ইনফেকশন ধরা পড়ে। সেই ইনফেকশন ভালো করতে বাড়তি ৩৫ হাজার টাকা গুনতে হয়।
শুধু জাহিদুল ইসলাম নন। ওই ক্লিনিকের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ স্থানীয়দেরও। সাকিব, গোলাপ, মোকছেদসহ স্থানীয় বেশ কয়েকজন বলেন, মনিরুল অবৈধ ক্লিনিক খুলে রোগীদের সাথে প্রতারণা করে জীবন নিয়ে খেলেছে। ওই ক্লিনিকে এখন পর্যন্ত যারাই গেছেন তারাই প্রতারিত হয়েছেন। প্রত্যেক রোগীকেই ঝুঁকির মুখে ফেলেছেন মনিরুল। অথচ স্বাস্থ্য বিভাগ দেখেও বিষয়টি না দেখার ভান করে থাকে। তাই শুধুমাত্র এক মাসের কারাদণ্ডই যথেষ্ট নয়, এদের মতো প্রতারকদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হওয়া উচিত।
সাপাহার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আবদুল্যাহ আল মামুন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ডিসি স্যারের নির্দেশনা পাওয়ার পর সকালে ওই ক্লিনিকে অভিযান পরিচালনা করলে জানা যায় ক্লিনিকটি অবৈধ। সেখানকার ৩ জন সিজারিয়ান রোগীর সঙ্গে কথা বলে ভয়াবহ চিত্র পাওয়া যায়। ওই তিনজন নারী ভর্তি হওয়ার পরই তাদের পরিবারের কাছ থেকে ফাঁকা কাগজে বন্ড সই নেওয়া হয়েছে। সিজারের সময় একজন গাইনি সার্জনের পাশাপাশি সেলাইসহ আনুষাঙ্গিক কাজে আরেকজন চিকিৎসক থাকার কথা। এর কোনোটি ছাড়াই তাদের সিজার করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, গাইনি সার্জনের বিপরীতে অনভিজ্ঞ চিকিৎসককে দিয়ে ওই ক্লিনিকে সিজার করা হয়। অ্যানেস্থেসিয়াও করানো হয় অনভিজ্ঞদের দিয়ে। ডাক্তার সেজে সেলাইসহ আনুষাঙ্গিক কাজ করতেন অষ্টম শ্রেশি পাস ক্লিনিক পরিচালক মনিরুল। জিজ্ঞাসাবাদে মনিরুল অস্ত্রোপচারের অভিযোগের বিষয়টি স্বীকার করলে তাকে এক মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এ ছাড়া পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও সাত দিনের কারাদণ্ডের আদেশ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি চিকিৎসার উপযুক্ত পরিবেশ না থাকায় ক্লিনিকটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
সাপাহার উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. রুহুল আমিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, অবৈধ ক্লিনিকটি চলছিলো এটা জানতাম। তবে সেখানে ডাক্তারের বিপরীতে অষ্টম শ্রেণি পাস কেউ অস্ত্রোপচার করছে এমনটি জানা ছিল না। অভিযানে যাওয়ার পর মনিরুল কোনো ডাক্তারি সনদ দেখাতে পারেননি। এটা খুবই ভয়ানক একটি বিষয়। ক্লিনিকের অনুমোদন না থাকা, প্রয়োজনীয় চিকিৎসক ও নার্স না থাকাসহ চিকিৎসার উপযুক্ত পরিবেশ না থাকায় ক্লিনিকটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
অনুমোদনহীন ক্লিনিকে দীর্ঘ দেড় বছর অষ্টম শ্রেণি পাস ভুয়া চিকিসক অস্ত্রোপচার করলেও সেটি স্বাস্থ্য বিভাগের নজরে আসেনি। এর কারণ জানতে চাইলে নওগাঁর সিভিল সার্জন ডা. রায়হানুজ্জামান সরকার ঢাকা পোস্টকে বলেন, একজন সিভিল সার্জনের পক্ষে সবকটি উপজেলার ক্লিনিক দেখভাল করা সম্ভব না। এক বছর আগে ওই ক্লিনিক বন্ধের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। অবৈধ ক্লিনিকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বরাবরই উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে। এরপরও সেটি চলমান থাকলে এ দ্বায় উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তার।
আরমান হোসেন রুমন/আরএআর