ফরিদপুরে ডেঙ্গু পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। এ জেলায় গত এক মাস ২৬ দিনে মোট মৃত্যু হয়েছে ৩০ জন রোগীর। এর মধ্যে ১৯ জনই নারী। শতাংশ হিসেবে প্রায় ৬৪ শতাংশ নারী রোগী মারা গেছেন। বাকি ৩৬ শতাংশ অর্থাৎ ১১ জন হলেন পুরুষ। তাদের মধ্যে তরুণ, যুবক ও বৃদ্ধ রয়েছেন। 

ফরিদপুরের সিভিল সার্জনের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, জেলায় ডেঙ্গুতে প্রথম মৃত্যুর ঘটনা ঘটে গত ২১ জুলাই। সেদিন ফরিদপুর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মহিলা মেডিসিন ওয়ার্ডে রাজবাড়ী সদর উপজেলার দ্বাদশী ইউনিয়নের ইউনুসের স্ত্রী জাহানারা বেগম (৩৯) মারা যান। তখন ফরিদপুরে ডেঙ্গু পরিস্থিতি বেগতিক না থাকায় হাসপাতালে আলাদা ওয়ার্ড না করে পুরুষ ও মহিলা রোগীদের যথাক্রমে পুরুষ মেডিসিন ও মহিলা মেডিসিন ওয়ার্ডে চিকিৎসা দেওয়া হত। এরপর ক্রমাগত রোগীর চাপে করোনার সময়ে আইসোলেশন ওয়ার্ড হিসেবে ব্যবহৃত ভবনে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের জন্য আলাদা ওয়ার্ড করা হয়। তবে বর্তমানে সেখানেও জায়গা সংকুলান না হওয়ায় পুরুষ ও মহিলা মেডিসিন ওয়ার্ডেও ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ছাড়াও ফরিদপুর জেনারেল হাসপাতাল, সাতটি উপজেলার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও ফরিদপুর ডায়াবেটিস হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।

সিভিল সার্জন কার্যালয়ের দেওয়া তথ্য মতে, গতকাল রোববার (১৭ সেপ্টেম্বর) পর্যন্ত জেলায় মোট ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে ৮ হাজার ৪৬৪ জন রোগী। এর মধ্যে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন ৭ হাজার ৫৯৩ জন। বাকি ৮৪১ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন। এরমধ্যে ফরিদপুর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি আছেন ৩৪৩ জন, ফরিদপুর জেনারেল হাসপাতালে ১২৪ জন, বোয়ালমারী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৭৫ জন, ভাঙ্গা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৫৫ জন, নগরকান্দা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্রেক্সে ৩০ জন, আলফাডাঙ্গা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৩৫ জন, সদরপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৪৫ জন, মধুখালি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৭৮ জন, চরভদ্রাসন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১১ জন ও ফরিদপুর ডায়াবেটিস হাসপাতালে ৪৫ জন ভর্তি আছেন।

ফরিদপুর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, জেলা শহরের হাসপাতাল তিনটিতে শুধু ফরিদপুর নয় রাজবাড়ী, ঝিনাইদহ, মাগুরা ও মাদারীপুর অঞ্চল থেকে ডেঙ্গু রোগীরা এসে ভর্তি হন। তাদের বেশিরভাগেরই অবস্থা সংকটাপন্ন থাকে। এছাড়া উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোতে স্থানীয় বাসিন্দারা ভর্তি হন।

সিভিল সার্জনের কার্যালয়ের সরবরাহ করা প্রেস বিজ্ঞপ্তি ঘেঁটে জানা গেছে, ফরিদপুরে ডেঙ্গুতে যে ৩০ রোগীর মৃত্যু হয়েছে তারা সবাই ফরিদপুর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা গেছেন। তাদের মধ্যে ১৯ নারীর অনেকেই ফরিদপুর জেলার বাইরের বাসিন্দা। গত ২১ জুলাইয়ের পর ফরিদপুর মেডিকেলে মৃত্যুর ঘটনা ঘটে ২৬ জুলাই। সেদিনও ফরিদপুরের বাইরের রোগীর মৃত্যু হয়। ওইদিন মারা যান রাজবাড়ী সদরের বাসিন্দা অন্তঃসত্ত্বা গৃহবধূ রুমা দাস (২৫)। এরপর এই হাসপাতালে ৫ আগস্ট ফরিদা বেগম (৫৫) নামে এক নারীর মৃত্যু হয়। ৬ আগস্ট, ৯ আগস্ট,১০ আগস্ট ও ২৬ আগস্ট একেকজন করে নারী মারা গেছেন।

এরপর সেপ্টেম্বরের প্রথম ১৫ দিনের মধ্যে পহেলা সেপ্টেম্বর একদিনে দুই গৃহবধূর মৃত্যু হয়। এরপর ৩ ও ১০ সেপ্টেম্বর মারা যান একজন করে দুইজন নারী। এর পরদিন ১১ সেপ্টেম্বর ফরিদপুরে ডেঙ্গুতে মৃত্যুর পেছনের সকল রেকর্ড ভেঙে দিয়ে একই দিনে তিনজন নারী মারা যান। এর দুইদিন পর ১৪ ও ১৫ সেপ্টেম্বর যথাক্রমে ৩ জন ও ২ জন করে মোট ৫ জন নারীর মৃত্যু হয়।গত ২১ জুলাই ডেঙ্গুতে প্রথম মৃত্যুর পর ওই মাসে মোট ৩ জন রোগীর মৃত্যু হয়।এর পরের মাস আগস্টে ১১ জন ও সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম ১৫ দিনেই বাকি ১৬ জনের মৃত্যু হয়।

ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জ্যেষ্ঠ স্টাফ নার্স তাহমিনা আক্তার বলেন, রোগীদের মশারি টানানোর কথা বললে শোনে না। আমরা বা চিকিৎসকরা যখন রাউন্ড দেন তখন তড়িঘড়ি করে অনেকে মশারি টানায় আবার পরে খুলে ফেলে। অনেক রোগী ও তাদের স্বজনরা গরমের উছিলায় মশারি টানাতে চান না। আমাদের কথা তারা খুব একটা কানে নেন না।

গতকাল রোববার (১৭ সেপ্টেম্বর) সরেজমিনে ঘুরে ফরিদপুরের নগরকান্দা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কথা হয় ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর স্বজন ইদরিস মোল্লার (৫৬) সঙ্গে। তিনি উপজেলার তালমা ইউনিয়নের বাসিন্দা। ইদরিস বলেন, আমার স্ত্রী সীমা বেগমকে (৪৫) গত শনিবার হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছি। ডেঙ্গু ধরা পড়ার পর তার চিকিৎসা চলছে। এই হাসপাতালে বেড পাইনি ফ্লোরে চিকিৎসা নিচ্ছি। তিনি বলেন, এই হাসপাতালে তো তাও ভালো একটা তোষক পাওয়া গেছে ফরিদপুরের হাসপাতালে তো পা ফেলানের জায়গা নেই। ডাক্তার বলছে আর ২/৩ দিন পর আমার স্ত্রী বাড়িতে যেতে পারবেন।

একই হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত গৃহবধু পুরাপাড়া ইউনিয়নের দফা গ্রামের বাসিন্দা ষোড়শি মন্ডল (৪৩) বলেন, চকবাড়ি মিলাইয়া খাটা খাটনি করি। দুই তিন ধইরা জ্বর হওয়ায় নাপা ট্যাবলেট খাইছি। এরপরও শরীর ঠিক না হওয়ায় হাসপাতালে এসে পরীক্ষা করলে ডেঙ্গু ধরা পরে। এরপর তিনদিন ধরে হাসপাতালে ভর্তি আছি।

ডেঙ্গু আক্রান্ত ছেলে সজিব রহমান। তার সঙ্গে হাসপাতালে এসেছেন মা জোলেখা বেগম (৫৪)। জোলেখা বলেন, আমার ছেলে ঢাকায় একটা জুতার কারখানায় কাজ করত। সেখানে জ্বর হওয়ায় এলাকায় চলে আসতে বলি। বাড়িতে আসার কয়েকদিন পর জ্বর ভালো হয়ে যায়। ডেঙ্গুর ভয়ে আর ঢাকায় যাইতে দেই নাই। আমার সেই ছেলের আবার জ্বর হওয়ার পর ডেঙ্গু টেস্ট করাইলে ডেঙ্গু ধরা পড়ে। ডাক্তাররা ফরিদপুর হাসপাতালে যাইতে কইছিল কিন্তু বাড়ির কাছে হওয়ায় এই হাসপাতালেই ভর্তি করাইছি। ডাক্তার আরও ২-৩ দিন থাকার কথা বলছে।

ফরিদপুরের বেপরোয়া ডেঙ্গু আতংকের কথা স্বীকার করে সিভিল সার্জন মো. ছিদ্দীকুর রহমান বলেন, আমাদের জেলায় নারীদের মৃত্যুর হার বেশি দেখা যাচ্ছে।এরমধ্যে অনেকেই বাইরের জেলা গুলো থেকে এমন সংকটময় মুহূর্তে আমাদের হাসপাতালে আসছে তখন আর তাকে বাঁচিয়ে তোলাটা সম্ভব হয়না।অনেকক্ষেত্রে দেখা যায় যে তারা হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার কয়েকঘন্টা বা সর্বোচ্চ একদিনের মধ্যেই মারা যাচ্ছেন।

তিনি বলেন, আমাদের হাসপাতাল গুলোতে ধারণক্ষমতার কয়েকগুণ ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হওয়ায় অনেককে হাসপাতালের মেঝেতে চিকিৎসা নিতে হচ্ছে।দুই একটি উপজেলায় মাঝে মাঝে স্যালাইন সংকট দেখা দিলে অন্য উপজেলা থেকে নিয়ে চাহিদা পূরণ করা হচ্ছে।তবে আমাদের জেলায় স্যালাইনের কোনও সংকট নেই।
ছিদ্দীকুর রহমান বলেন, আমরা শুরু থেকেই একটি কথা বলছি- সচেতনতা। সচেতনতাই পারে ডেঙ্গু থেকে আমাদের মুক্ত করতে। বাড়ির আশপাশের পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখা। এই সময়টাতে অন্তত মশারি টানানো,কয়েলের ব্যবহার বা মশানাষক স্প্রে বা ক্রিমের ব্যবহার করা।তরল জাতীয় খাদ্য ফলমূল বেশি বেশি পানি পান করা।এসব ছোট ছোট অভ্যাসই ডেঙ্গু রোগ প্রতিরোধে ভূমিকা রাখে।আমাদের এদিকে বেশি নজর দিতে হবে।

জহির হোসেন/আরকে