‘শেখ হাসিনা বাড়ি না দিলে সারা জীবন রাস্তায় থাকা লাগত’
নিজের কোনো জায়গা-জমি না থাকায় দীর্ঘদিন ধরে স্ত্রী-সন্তান ও বৃদ্ধা মাকে নিয়ে রাস্তার ধারে ঝুপড়ি ঘরে বসবাস করে আসছিলেন জামিনুর রহমান। সামান্য ভাঙারির ব্যবসা করা জামিনুরের ছিল না জমি কিনে বাড়ি করার সামর্থ্য। বছরখানেক আগে ভাগ্য পরিবর্তন হয় তার। নীলফামারীর কিশোরগঞ্জের পুটিমারী শ্মশান বাজার আশ্রয়ণ প্রকল্পে মুজিববর্ষে ভূমি ও গৃহহীন পরিবার পুনর্বাসনের একটি সরকারি ঘর পেয়েছেন তিনি। সেই থেকে স্ত্রী-সন্তান ও বৃদ্ধা মাকে নিয়ে রাস্তার ধারে ঝুপড়ি ঘরে বসবাস করা জামিনুর নিজেই বাড়ির মালিক। প্রকল্পের ঘরসহ দুই শতাংশ জায়গায় নতুন করে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখছেন তিনি।
জামিনুরের মতো আপন ঠিকানা পেয়েছেন পুটিমারী শ্মশান বাজার আশ্রয়ণ প্রকল্পের ১৭টি পরিবার। সরকারি আশ্রয়ণ প্রকল্পের এসব ঘর পেয়ে বদলে গেছে প্রান্তিক এ জনগোষ্ঠীর জীবনমান।
বিজ্ঞাপন
জানা গেছে, কিশোরগঞ্জ উপজেলায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কতৃর্ক নির্মিত ব্যারাকসহ ২০টি আশ্রয়ণ প্রকল্পে ঠাঁই হয়েছে ৬৬২টি পরিবারের। একসময় ছিন্নমূল, ভূমিহীন, গৃহহীন এই মানুষগুলোর দিন কাটতো অনাহারে-অর্ধাহারে। তবে একটি নিরাপদ ঠিকানার চিন্তা দূর হওয়ায় বর্তমানে নিজেদের স্বাবলম্বী করতে কাজ করছেন তারা। কেউ অন্যের জমি বর্গা নিয়ে চাষাবাদ, কেউ সবজি চাষ, কেই ক্ষুদ্র ব্যবসা, আবার খামার করেও স্বাবলম্বী হচ্ছেন অনেকে।
সরেজমিনে কিশোরগঞ্জের পুটিমারী শ্মশান বাজার আশ্রয়ণ প্রকল্পে দেখা গেছে, উপহারের ঘরের পাশে সামান্য কিছু জায়গায় চাষ করা হয়েছে শাকসবজি। রোপণ করা হয়েছে কয়েকটি ফুল ও ফলগাছ। এসব গাছের পরিচর্যা করছিলেন জামিনুরের স্ত্রী জহুরা বেগম।
জামিনুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমি রাস্তায় ১৩ বছর আছিলাম। আমাকে কেউ জায়গা দেয় নাই। জায়গা চেয়ে না পেয়ে রাস্তার ধারে ছিলাম। একটু বাতাস হইলেও আমার বাড়ির চালা উড়ি যায়। পরে ইউএনও স্যার ডাকে নিয়ে একটা বাড়ি দিছে আমাক। এখন এই বাড়িতে আমরা খুব ভালো আছি। শেখ হাসিনা যদি বাড়ি না দিল হয় আমাক সারা জীবন রাস্তায় ধারেই থাকা লাগত। বাড়ি পেয়ে খুব সুখশান্তিতে বসবাস করছি। দোয়া করি শেখ হাসিনার ভালো হোক।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমি যদি এই বাড়িটা না পেতাম তাহলে এদিকে আর থাকা হতো না, ঢাকা চলে যাওয়ার লাগত। আমি এত মানুষের হাত-পা ধরছি কেউ জায়গা দেয় নাই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমার মতো এমন অসহায় মানুষকে জায়গা দিছে। এরচেয়ে বড় চাওয়া আমার নাই। আমি খুব শান্তিতে আছি। আমি ভাঙারির ব্যবসা করি। রাস্তার ধারে বাড়ি থাকতে আমার বৃদ্ধ মা তিনবার অ্যাক্সিডেন্ট করছে। আমার কাছে তো টাকা নাই মায়ের চিকিৎসা করার, তখন ধারদেনা করে মায়ের চিকিৎসা করেছি। আমি খালি দোয়া করি শেখ হাসিনার জন্য। আল্লাহ তার মঙ্গল করুক। যেখানে আমার মা আমাকে জন্ম দিয়ে জায়গা দিতে পারে নাই কিন্তু শেখ হাসিনা আমাকে জায়গা দিছে।’
জামিনুরের স্ত্রী জহুরা বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘জমি কেনার জন্য একটা গরু বড় করছিনো, সেটাও সাপের কামড়ে মারা গেইছে। সেই গরুটা খুব কষ্টে বড় করছিনো। গরুটা মারা যাওয়ার পর অনেক কষ্ট পাইছিনো। এটা ভ্যান গাড়ি ছিল ভাঙারির ব্যবসা করতো আমার স্বামী, সেটাও চুরি হয়ে গেছিলো। ইউএন স্যার তিন দিন বাড়িতে গেছিল, ঘরে ঢুকে দেখে আমাদের কিছু নাই। এক চৌকিতে সবাই থাকি। তারপর স্যার আমাদের একটা ঘর দিল। বর্তমানে আমরা এখন খুব শান্তিতে আছি। শাকসবজি আবাদ করতেছি, গাছপালা লাগাইছি। পুঁইশাকের গাছ লাগাইছি সেই পুঁইশাক তুলে আজকে ভাত রান্না করে খাইছি।’
আশ্রয়ণের বাসিন্দা ছায়া রানি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আগে মানুষের জমিতে ছিলাম, খুব কষ্টে ছিলাম। এখন সরকার আমাকে পাকা বাড়ি দিছে, আমি খুব সুখে আছি। যে আমাকে ঘরটা দিছে আল্লাহ তার ভালো করুক। আমি পাকাঘরে ঘুমাতে পারতেছি। কখনো স্বপ্ন দেখি নাই যে আমি পাকাঘরে থাকবো। এখন সরকার আমার পাকাঘর দান করছে। আমি পাকাঘরে ছেলে-মেয়েকে নিয়ে সুখে শান্তিতে আছি।’
আরেক বাসিন্দা নালো বালা ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘মানুষের জমির থাকিয়া কত কথা, কত যে কষ্ট গেছে সেটা ভগবান জানে। এখন ভগবান দয়া করছে। এখন তো ভালো আছি। আগের চেয়ে কত ভালো আছি। ঘরটা ছিল সে ঘরটা চাটি-বেড়া কিছু নাই। বর্ষা শীত সব সময় কষ্ট। একটু বৃষ্টি হইলে মানুষের বাড়িতে দৌড়াতে লাগতো। এখন শান্তিতে ঘুমাতে পারি।’
আশ্রয়ণের বাসিন্দা হাসিনা বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমার ছেলে যখন ৭ মাস বয়স তখনই আমার স্বামী মারা যায়। তখন থেকে কষ্ট করে ছেলেকে মানুষ করছি। এখন ছেলে তার বউকে নিয়ে আলাদা খায়, আমি আলাদা খাই। মানুষের বাসায় কাজ করে চলতেছি। এই ঘর পেয়ে অনেক ভালো আছি। দিনে মানুষের বাড়িতে কাজ করি আর রাতে এই ঘরে আসি ঘুমাই।’
কিশোরগঞ্জ উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নূর-ই-আলম সিদ্দিকী ঢাকা পোস্টকে বলেন, ইতোমধ্যে কিশোরগঞ্জ উপজেলাকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ভূমি ও গৃহহীন ঘোষণা করেছেন। আমরা ৬৬২ জন গৃহহীনকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উপহারের জমিসহ ঘর প্রদান করেছি। বর্তমানে তারা খুব সুখে শান্তিতে বসবাস করছে। তাদের কর্মসংস্থানের ব্যাপারে বেশ কিছু কার্যক্রম আমরা হাতে নিয়েছি। অনেকে ভিক্ষুক ছিলেন, অনেকে রাস্তার পাশে বসবাস করতেন তাদেরকে আমরা এসব আশ্রয় কেন্দ্রে জায়গা করে দিয়েছি। তাদেরকে যুব উন্নয়নের মাধ্যমে বেশকিছু প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা করছি। হাঁস, মুরগি, গরু, ছাগল পালনসহ কিছু চাষাবাদ তাদের সম্পৃক্ত করার চেষ্টা করছি।
তিনি আরও বলেন, ইতোমধ্যে আমরা একটা প্রকল্প হাতে নিয়েছি। সবাই যাতে বস্তায় আদা চাষ করতে পারে। প্রত্যেকটি ঘরে ১০টি করে বস্তা দেওয়ার। এতে তারা আদা চাষ করবে ও আদার চাহিদা পূরণ হবে। এ চাষটা শিখলে ভবিষ্যতে তারা এটিকে সম্প্রসারিত করতে পারবে।
এমজেইউ