ময়মনসিংহ-ঢাকা রেলসেবা
টিকিটের পাঁচগুণ যাত্রী, তবুও নেই আলাদা ট্রেন
ট্রেন আসার আগে আগে যাত্রীতে ভরে যায় প্ল্যাটফর্ম। ঠাসাঠাসি করে দাঁড়িয়ে থাকেন শত শত নারী-পুরুষ। ট্রেন এলে শুরু হয় ধাক্কাধাক্কি, কার আগে কে উঠবে...।
জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ থেকে ছেড়ে আসা ঢাকাগামী ট্রেন ময়মনসিংহে দাঁড়ানোর পর যাত্রীদের এই হুড়োহুড়ির চিত্র নিত্যদিনের। বিভাগীয় নগরী ময়মনসিংহ থেকে প্রতিদিন ঢাকায় যাতায়াত করেন গড়ে আড়াই থেকে তিন হাজার মানুষ। কিন্তু এ নগরী থেকে ঢাকাগামী আলাদা কোনো ট্রেন নেই। জামালপুর এবং নেত্রকোণা থেকে ছেড়ে আসা ছয়টি আন্তঃনগর ট্রেনে বরাদ্দ থাকা অল্পকিছু আসনে চড়েই পৌঁছাতে হয় গন্তব্যে। যারা ভাগ্যবান তারা আসনের টিকিট পান, বাকিরা আসনবিহীন টিকিট সংগ্রহ করে কিংবা বিনা টিকিটে চলাচল করেন।
বিজ্ঞাপন
রেলওয়ের বুকিং অফিস থেকে পাওয়া তথ্যমতে, ময়মনসিংহ জংশন স্টেশন হয়ে চলা ছয়টি আন্তঃনগর ট্রেনের সবকটি মিলিয়ে বিভাগীয় এ নগরীর মানুষের জন্য মাত্র ৫৪১টি টিকিট বরাদ্দ করা আছে। এর মধ্যে জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ থেকে ছেড়ে আসা তিস্তা ট্রেনে ১৬৬টি, ব্রহ্মপুত্র এক্সপ্রেসে ৭০টি, তারাকান্দি থেকে ছেড়ে আসা অগ্নিবীণায় ১১০টি, যমুনায় ১১০টি, মোহনগঞ্জ থেকে ছেড়ে আসা মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনে ৪০টি এবং হাওড় এক্সপ্রেসে টিকিট বরাদ্দ ৪৫টি। আর সম্প্রতি জামালপুর এক্সপ্রেস ট্রেন বিকল্প পথ হিসেবে ময়মনসিংহ হয়ে যাওয়ায় সেখানে ১৫টি আসন বরাদ্দ পেয়েছে ময়মনসিংহ রেল বিভাগ।
ট্রেনের জন্য প্ল্যাটফর্মে অপেক্ষায় থাকা কয়েকজন যাত্রীর সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, আসন না থাকায় দাঁড়িয়ে যাওয়ার জন্য ১৪০ টাকা করে আসনবিহীন টিকিট সংগ্রহ করেছেন তারা। খুব কমই সময়ই ট্রেনে আসন পাওয়া যায়।
সাইফুল ইসলাম নামের এক যুবক ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রায় তিন ঘণ্টা সময় লাগে ঢাকা যেতে। এত দীর্ঘ পথ দাঁড়িয়ে যেতে কষ্ট হয় আমাদের। অনেক সময় এখান থেকে ট্রেনে উঠলেও আসন পাওয়ার জন্য বাড়তি টাকা দিয়ে দেওয়ানগঞ্জ বা মোহনগঞ্জ থেকে টিকিট সংগ্রহ করতে হয়। ময়মনসিংহের জন্য আলাদা ট্রেন থাকলে এই সমস্যাটা হত না।
ময়মনসিংহ রেলওয়ের প্রধান বুকিং সহকারী মো. হামিদুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, চাহিদার তুলনার টিকিট বরাদ্দ খুবই কম। এ কারণে স্ট্যান্ডিং (আসনবিহীন) টিকিট বিক্রি করতে হয়। সারা দেশে জামালপুর-দেওয়ানগঞ্জ রেলপথে সবচেয়ে বেশি যাত্রী পরিবহন হয়। তারপরও এ অঞ্চল অবহেলিত। যাত্রী চাহিদা থাকলেও আসন ও কোচ বাড়ছে না। ট্রেন বৃদ্ধি এবং চলাচলকারী ট্রেনগুলোতে কোচ বৃদ্ধি করতে হবে। তাহলে পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি হবে।
দীর্ঘদিন ধরে ঢাকা-ময়মনসিংহ রেলপথে যাত্রীদের ভোগান্তির কথা জানিয়ে ডুয়েলগেজ রেলপথসহ ময়মনসিংহ থেকে ঢাকাগামী দুইটি বিশেষ ট্রেন চালুর দাবি জানিয়ে আসছে জেলা নাগরিক আন্দোলন। সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক নূরুল আমিন কালাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিভাগীয় শহর হিসেবে যে পরিমাণ মানুষ ময়মনসিংহ থেকে ঢাকা যায় সেই হিসেবে বরাদ্দ থাকা আসন সংখ্যা রীতিমতো হাস্যকর। এটি প্রহসন ছাড়া আর কিছু নয়। দীর্ঘদিন ধরে আমরা প্রাচীন রেলপথের উন্নয়ন ও ডুয়েলগেজ রেলপথ বাস্তবায়নের দাবি জানিয়ে এলেও তা কেউ আমলে নিচ্ছে না। আগামীতে বৃহত্তর কর্মসূচি দেওয়া হবে।
জনবল সংকটে বন্ধ হচ্ছে স্টেশন, কোচ সংকটে বন্ধ ট্রেন
এদিকে জনবল সংকটে বন্ধ হয়ে গেছে ১৬টি রেলস্টেশন। কোচ সংকটে বন্ধ হয়ে পড়েছে চারটি ট্রেন। ঢাকা-ময়মনসিংহ সিঙ্গেল লাইনে ধারণক্ষমতার বেশি ট্রেন চলছে। এছাড়া রেলপথে রয়েছে নানা সংকট ও ঝুঁকি। প্রায়ই রেলপথে ঢাকা-ময়মনসিংহ ও ময়মনসিংহ-গৌরীপুর সেকশনে ট্রেন লাইনচ্যুতির ঘটনা ঘটে। করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের সময় ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে গেলে অন্য ট্রেন চালু হলেও ময়মনসিংহ-ভৈরব রুটে চলাচল করা জনপ্রিয় দুটি লোকাল ট্রেন (২৪১ ও ২৪৩ নম্বর ট্রেন) ও ঢাকা থেকে ভৈরব বাজার হয়ে ময়মনসিংহে আসা ৩৯ নম্বর ঈশা খাঁ ট্রেনটি চালু হয়নি। এছাড়া ময়মনসিংহ থেকে জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জে চলা ২৫১ নম্বর লোকাল ট্রেনটিও পুনরায় আর চালু করেনি রেল কর্তৃপক্ষ। অন্য ট্রেনগুলোর কোচ ও রেক এলেও চারটি ট্রেনের রেক না আসায় এবং কোচ সংকটে ট্রেন চালু হয়নি।
এদিকে ময়মনসিংহ জংশন থেকে জামালপুর, জারিয়া-মোহনগঞ্জ ও ভৈরব রেলপথে থাকা স্টেশনগুলো দিন দিন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। জনবল সংকটের কারণে এসব লাইনের বিভিন্ন স্থানে থাকা স্টেশনগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বলে জানিয়েছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। কিছু স্টেশন বন্ধ হয়ে গেছে পুরোপুরি, কিছু স্টেশনে চলে শুধু বাণিজ্যিক কার্যক্রম। এর মধ্যে ময়মনসিংহ এলাকায় বাইগনবাড়ি, বিসকা, বোকাইনগর, মুসুল্লি, সোহাগী, কিশোরগঞ্জ অংশে নীলগঞ্জ, নেত্রকোণা অংশে হিরণপুর, ঠাকরাকোনা, চল্লিশানগর, বাঙলা, অতিতপুর, জালসুকা, জামালপুর অংশে হেমনগর, শহীদনগর বারইপটল, মোশাররফগঞ্জ, জামালপুর কোর্ট স্টেশনের কার্যক্রম বন্ধ।
ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি ট্রেন চলাচল
ময়মনসিংহ জংশন হয়ে প্রতিদিন ২৮ জোড়া ট্রেন ঢাকায় চলাচল করে। এ জংশন থেকে বিভিন্ন রেলপথে চলাচল করে ৪৮ জোড়া ট্রেন। এর মধ্যে ৬টি আন্তঃনগর ট্রেন নিয়মিত ঢাকার দিকে চলাচল করে। একটি যায় চট্টগ্রামেও। ময়মনসিংহ-গফরগাঁও হয়ে ২৮ জোড়া ট্রেনে চলাচল করলেও সিঙ্গেল লাইনের এই রেলপথটি বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। সিঙ্গেল লাইন হিসেবে যে পরিমাণ ট্রেন চলার কথা বাস্তবে চলাচল করছে তার চেয়ে বেশি। রেলপথটির স্থানে স্থানে স্লিপার না থাকা, স্পাইক, ফিশ বোল্ট, খিলা, হ্যান্ডেল ক্লিপ, পাথর তীব্র সংকট রয়েছে। রেললাইনের জয়েন্টে চারটি নাটের (ফিশ বোল্ট) স্থলে কোথাও দুটি কোথাও তিনটি এভাবে চলাতে হচ্ছে। চাহিদা অনুযায়ী রেলপথের বিভিন্ন সরঞ্জাম না পাওয়ায় রেলপথটি দিনদিন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
ময়মনসিংহ স্টেশনের সুপারিটেনডেন্ট নাজমুল হক খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ব্রিটিশ আমলে তৈরি রেললাইনের মান উন্নয়ন সবার আগে প্রয়োজন। ট্রেনের সংখ্যা বৃদ্ধি না করে কোচ বৃদ্ধি ও গতি বাড়ানো এবং এলাকাবাসী ডুয়েলগেজসহ ডাবল লাইনের যে দাবি জানিয়ে আসছে সেটি বাস্তবায়ন হলে সেবার মান বাড়বে। যাত্রী চাহিদা থাকলেও আসন না থাকায় মানুষ অনেক সময় বিকল্প চিন্তা করে সড়কপথে যায়। এই পরিস্থিতি থেকে উন্নয়নের প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো সম্পর্কে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ অবগত আছে।
রেলওয়ে পরিবহন বিভাগের পরিদর্শক শাহীনুর ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, জনবল সংকটের কারণে স্টেশনগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কিছু স্টেশন পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেলেও কিছু স্টেশনে শুধু বাণিজ্যিক কার্যক্রম চলামান রয়েছে। এমন পরিস্থিতি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ অবগত আছে। নতুন স্টেশনমাস্টারদের প্রশিক্ষণ চলছে। প্রশিক্ষণ শেষে তারা এলে হয়ত স্টেশনগুলো আবার চালু হতে পারে।
ময়মনসিংহ রেলওয়ের সহকারী নির্বাহী প্রকৌশলী আকরাম আলী ঢাকা পোস্টকে বলেন, ময়মনসিংহ-গফরগাঁও লাইনটি ওভারলোডেড। সিঙ্গেল লাইনে যে পরিমাণ ট্রেন চলাচল করার কথা তার চেয়ে বেশি ট্রেন চলাচল করছে। এছাড়া লাইনটি অনেক পুরোনো হওয়ায় নিয়মিত কাজ করে যাচ্ছি।
তিনি আরও বলেন, পুরোনো লাইন হিসেবে যতটুকু মেরামত করে এবং ট্রেনগুলোর গতি নিয়ন্ত্রণ করে চালানো যায় সেভাবেই চালানো হচ্ছে। ডাবল লাইনের একটি প্রজেক্টের কথা শুনেছিলাম কিন্তু তার কোনো আপডেট জানা নেই। ডাবল লাইন হলে অনেক বেশি ট্রেন চালানো সম্ভব হবে।
এমজেইউ