শিক্ষক, শিক্ষার্থী কিংবা কোনো মাদরাসা ভবনের অস্তিত্ব না থাকলেও একটি মাদরাসার নামে পদ্মা সেতু অ্যাপ্রোচ সড়ক প্রকল্পের প্রায় অর্ধকোটি টাকা লোপাটের চেষ্টা করছে একটি প্রভাবশালী চক্র।

অস্তিত্বহীন ওই মাদরাসা কমিটির সভাপতি দাবি করে গোলাম মোস্তফা মাঝি নামের এক ব্যক্তি বলছেন, ‘নশাসন ইবতেদায়ী স্বতন্ত্র মাদরাসা’ নামে একটি মাদরাসার দুইটি ভবন রয়েছে মাঝির হাটে। তবে ওই একই কমিটির সাধারণ সম্পাদক চুন্নু মাঝি বলছেন, বহু বছর আগে সেখানে একটি মক্তব ছিল। এখন তাও নেই। মাদরাসার অস্তিত্ব থাকার প্রশ্নই আসে না। মাদরাসার নামে আসা ৭ ও ৮ ধারার কোনো নোটিশ তিনি পাননি। মাদরাসা কমিটির অন্য সদস্য কারা তাও তিনি জানেন না।

মাঝিরহাট নামক ওই বাজারের ব্যক্তি মালিকানাধীন একটি গুদামঘর ও একটি ক্লাবঘরকে মাদরাসার ভবন দেখিয়ে শরীয়তপুর-জাজিরা ও নাওডোবা পদ্মা ব্রিজ অ্যাপ্রোচ সড়ক উন্নয়ন প্রকল্পের স্থাবর সম্পত্তি অধিগ্রহণ প্রকল্পের ৪৬ লাখ ৭৫ হাজার ৭৫৮ টাকা  আত্মসাতের চেষ্টা করছে শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার নশাসন ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান কামরুল আহসান মাঝি ও গোলাম মোস্তফা মাঝিসহ একটি প্রভাবশালী মহল।

এমন ভূতুড়ে একটি মাদরাসা নিয়ে নশাসন ইউনিয়নের মাঝিরহাট এলাকার স্থানীয়দের মধ্যে কৌতূহল সৃষ্টি হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে ঢাকা পোস্টের কথা হয়েছে প্রায় ১০ জন সত্তরোর্ধ্ব স্থানীয় বাসিন্দার সঙ্গে। জেলা প্রশাসনের অধিগ্রহণ শাখা থেকে নশাসন ইবতেদায়ী স্বতন্ত্র মাদরাসার নামে পাঠানো ৭ ও ৮ ধারার ওই নোটিশকে অসাধু চক্রের কারসাজি বলে দাবি করেছেন তারা। অধিগ্রহণকৃত ওই এলাকায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সুষ্ঠু তদন্ত করলে ব্যাপক অনিয়মের চিত্র উঠে আসবে বলে মনে করছেন স্থানীয় সচেতনমহল।

সরেজমিন ও জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, শরীয়তপুরের জাজিরার নাওডোবা প্রান্ত থেকে জেলা শহর পর্যন্ত ২৭ কিলোমিটার এলাকায় ১ হাজার ৬৮২ কোটি ৫৪ লাখ টাকা ব্যয়ে ১০৫ দশমিক ৫ হেক্টর জমিতে শরীয়তপুর-জাজিরা ও নাওডোবা পদ্মা ব্রিজ অ্যাপ্রোজ সড়ক উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ চলছে। এই প্রকল্পের জন্য সড়ক বিভাগের প্রস্তাব অনুযায়ী এল.এ কেস এর মাধ্যমে জমি ও স্থাপনা অধিগ্রহণের কার্যক্রম শুরু করেছে জেলা প্রশাসন। জেলা প্রশাসন, গণপূর্ত বিভাগ এবং বন বিভাগ যৌথ তদন্ত শেষ করে ৭ ধারার নোটিশ প্রদান করে জমি ও স্থাপনার মালিকদের। এরপর সম্প্রতি শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার নশাসন গাগ্রীজোড়া ও ডগ্রী এলাকাসহ কয়েকটি এলাকায় ৮ ধারার নোটিশ প্রদান করে শরীয়তপুর জেলা প্রশাসন।

এরমধ্যে অস্তিত্বহীন ওই মাদরাসার নামেও এসেছে ৮ ধারার নোটিশ। প্রকল্প স্থাবর ভূমি অধিগ্রহণের আওতাভুক্ত নড়িয়া উপজেলার নশাসন ইউনিয়নের মাঝির হাট এলাকায় বিআরএস ২৩নং নশাসন মৌজার ৬নং খতিয়ানের ৩৩০৩, ৩৩০৪ ও ৩৩০৫ নম্বর দাগে ৩৪ শতাংশ জমি অস্তিত্বহীন ওই মাদরাসার নামে বিআরএস রেকর্ড রয়েছে। কিন্তু এই রেকর্ড করা জমি কীভাবে মাদরাসার নামে বিআরএস রেকর্ড হয়েছে তার কোনো দলিল খুঁজে পাওয়া যায়নি। মাদরাসার ওই রেকর্ড করা সম্পত্তির ৩৩০৫ নম্বর দাগসহ আরও কয়েকটি দাগের সম্পত্তি এসএ রেকর্ড অনুযায়ী পৈতৃক মালিকানা দাবি করে ২০১৯ সালে আব্দুল খালেক ব্যাপারী নামের এক ব্যক্তি জেলা প্রশাসকসহ পাঁচজনকে বিবাদী করে আদালতে মামলা দায়ের করেন। খালেক ব্যাপারীর মৃত্যুর পর তার স্ত্রী নিলুফা বেগম ওই মামলা এখনো পরিচালনা করছেন। জমি অধিগ্রহণের জন্য জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে ৮ ধারার নোটিশ দেওয়ার পর মামলার বাদী আব্দুল খালেক ব্যাপারীর স্ত্রী নিলুফা বেগম গত ৩১ আগস্ট ৩৩০৫ দাগসহ মামলার আরজি অনুযায়ী আদালতে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা চেয়ে আবেদন করেন। তার আবেদনের প্রেক্ষিতে আদালত ওই মামলার পাঁচজন বিবাদীকে ১০ দিনের মধ্যে কারণ দর্শানোর নোটিশ প্রদান করেন।

অধিগ্রহণে ৮ ধারার নোটিশে মাদরাসার নামে স্থাপনা হিসেবে দেখানো হয়েছে ৩৩০৫ নম্বর দাগের একটি  ক্লাবঘর। কিন্তু ওই ক্লাবঘরটির নিজস্ব মালিকানা দলিল থাকলেও ক্লাব কর্তৃপক্ষ ৮ ধারার নোটিশ পায়নি। ক্লাবঘরের দক্ষিণ পাশে আব্দুল খালেক ব্যাপারীর বাগান থাকলেও তিনি ৮ ধারা নোটিশ পাননি। ওই বাগানের পাশেই বাজারের মধ্যে জলিল মাঝির একটি গুদামঘর রয়েছে। ওই গুদামঘরটিকেও মাদরাসার নামে আসা ৮ ধারার নোটিশে দেখানো হয়েছে। আব্দুল জলিল মাঝির মৃত্যুর পর তার উত্তারাধিকারী স্ত্রী ফেরদৌস জাহান, মেয়ে লায়লা জিয়াসমিন ও বোন জাহানারা বেগম। তারাও ৮ ধারার নোটিশ পাননি।

স্থানীয় বাসিন্দা দলিল উদ্দিন মাঝি (৭৫) ঢাকা পোস্টকে বলেন, মাঝিরহাট বাজারে কোনো ইবতেদায়ী মাদরাসা ছিল না। যে মাদরাসার নাম দেখিয়ে ৮ ধারার নোটিশ এসেছে ওই টাকা আত্মসাৎ করার জন্যই একটি চক্র এমন কাজ করেছে।

মোসলেম ঢালী (৯০) নামে আরেকজন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার জীবদ্দশায় এখানে কোনো মাদরাসা দেখিনি। এখানে মাদরাসার নামে ঘরের বরাদ্দ কীভাবে হলো যারা সংশ্লিষ্ট তারাই ভালো জানেন। এখানে কোনো কালেই মাদরাসা ছিল না।

জলিল মাঝির মেয়ে লায়লা জিয়াসমিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, নশাসন মাঝির হাট বাজারের ওই গুদামঘরটির মালিক আমার বাবা। বাবা মারার যাওয়ার পর আমরা গ্রামে না থাকার কারণে ওই ঘরটি মাদরাসার নামে দেখানো হয়েছে। তবে কীভাবে এটা করা হয়েছে তা আমি জানি না।

মামলার বাদী নিলুফা বেগম (৭০) বলেন, ৩৩০৫ নম্বর দাগের জমিতে নশাসন ইবতেদায়ী মাদরাসা নামে মাদরাসার কোনো ঘর নেই। সরেজমিনে তদন্ত করলে ঘরের কোনো অস্তিত্বও খুঁজে পাবে না। ওই দাগের জায়গাটি আমার স্বামী খালেক ব্যাপারীর নামে। এই জায়গা নিয়ে এখনো আদালতে মামলা চলমান আছে। আমি মামলা পরিচালনা করছি।

অস্তিত্বহীন ওই মাদরাসা কমিটির সভাপতি দাবি করে গোলাম মোস্তফা মাঝি ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা মাদরাসার ভবনের ভূমি অধিগ্রহণের ৮ ধারার নোটিশ পেয়েছি। বিআরএস রেকর্ডের ৩৩০৩, ৩৩০৪ ও ৩৩০৫ দাগে ভূমি মাদরাসার নামে। ওই জায়গায় একটি পাকাঘর আছে সেটিই মাদরাসা। ছাত্রছাত্রীরা এখন পড়তে আসে না বলে আমরা ওই পাকাঘরটি ভাড়া দিয়েছি।

তবে গোলাম মোস্তফা মাঝি ওই রেকর্ডের সপক্ষে কোনো দলিল বা প্রমাণাদি দেখাতে পারেননি।

নশাসন ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান কামরুল আহসান মাঝি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ক্লাবঘর ও গুদামঘর ভবনের ৮ ধারার নোটিশ মাদরাসার নামে হয়েছে। কীভাবে এটা হয়েছে তা মাদরাসার সভাপতি ভালো বলতে পারবেন। গোলাম মোস্তফা মাঝির সঙ্গে মিলে অধিগ্রহণে মাদরাসার নামে বরাদ্দকৃত টাকা আত্মসাতের সঙ্গে আমি জড়িত নই। স্থানীয়দের অভিযোগ ভিত্তিহীন ও সম্পূর্ণ মিথ্যা।

শরীয়তপুর গণপূর্ত অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী মহিবুর রহমান পিইঞ্জ ঢাকা পোস্টকে বলেন, জমির মালিকানা বা মূল্য নির্ধারণ করার ক্ষমতা রাখে জেলা প্রশাসন। জেলা প্রশাসনের অধিগ্রহণ শাখা থেকে গণপূর্তকে স্থাপনার বর্ণনা দেওয়া হয়। বর্ণনা অনুযায়ী আমরা মূল্য নির্ধারণ করি। লোকবল সংকটের কারণে প্রত্যেকটি স্থাপনা সরেজমিনে তদন্ত করা সম্ভব হয় না। কিন্তু ৯০ থেকে ৯৫ ভাগ স্থাপনার সরেজমিন তদন্ত করা হয়। জেলা প্রশাসন থেকে যদি কোনো স্থাপনার পুনঃতদন্তের জন্য বলা হয় তাহলে আমরা পুনঃতদন্ত করবো।

এ বিষয়ে শরীয়তপুরের জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ নিজাম উদ্দিন আহম্মেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, নশাসন ইবতেদায়ী স্বাতন্ত্র্য মাদরাসার যদি কোনো অস্তিত্ব না থাকে, তবে বিল পাবে না। কিন্তু মাদরাসার রেকর্ড গ্রহণযোগ্য দলিল। তবে মাদরাসার জমি নিয়ে আদালতে বিরোধপূর্ণ মামলা থাকলে মামলা নিষ্পত্তি হওয়ার পর প্রকৃত মালিককে স্থাপনা ও জমির ন্যায্যমূল্য প্রদান করা হবে।

এমজেইউ