কিছুদিন আগে সিনিয়র একজন সাংবাদিক ফেসবুকে পোস্টে বলেন ‘সম্ভবত সারাদেশে কোথাও জন্মনিবন্ধন হচ্ছে না। ধরুন কারও বাচ্চা অসুস্থ, উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিয়ে যেতে হবে। এজন্য তো পাসপোর্ট দরকার। পাসপোর্ট করার জন্য আবার জন্মনিবন্ধন দরকার। জন্মনিবন্ধন ছাড়া কি পাসপোর্ট করা আদৌ সম্ভব?’ এমন পোস্ট অনেকের বিবেককে নাড়া দেয়। সেই ফেসবুক পোস্টটি আমাদের নজরে আসে। এরপর বেশকিছু ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভা ঘুরে দেখেছি। তাতে দেখা যায় জন্মনিবন্ধন নিয়ে চরম ভোগান্তির মধ্যে রয়েছে ঠাকুরগাঁও জেলার সাধারণ মানুষ।

২০০৪ সালে জন্মনিবন্ধন আইন করা হয় এবং ২০০৬ সালে তা কার্যকর করা হয়। জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন আইন ২০০৪ এর আওতায় একজন মানুষের নাম, লিঙ্গ, জন্মের তারিখ ও স্থান, বাবা-মায়ের নাম, তাদের জাতীয়তা ও স্থায়ী ঠিকানা নির্ধারিত নিবন্ধক কর্তৃক রেজিস্টারে লেখা বা কম্পিউটারে এন্ট্রি করে জন্মসনদ প্রদান করা হয়। জন্মসনদ হচ্ছে নাগরিকের জন্ম, বয়স, পরিচয় ও নাগরিকত্বের প্রমাণ। রাষ্ট্র স্বীকৃত নাগরিকের মর্যাদা ও সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে হলে জন্মনিবন্ধন সনদ প্রদর্শন করা বাধ্যতামূলক।

জন্মনিবন্ধন নিয়ম অনুসারে শিশু জন্মের ৪৫ দিনের ভেতরে নতুন জন্মনিবন্ধন সনদ তৈরি করতে কোনো ফি জমা দিতে হবে না। ৪৫ দিনের পর থেকে ৫ বছর বয়স পর্যন্ত জন্মনিবন্ধন সনদ তৈরি করতে ২৫ টাকা ফি। ৫ বছর পর থেকে জন্মনিবন্ধন সনদ তৈরি করতে প্রতিটি জন্মনিবন্ধনের জন্য ৫০ টাকা প্রদান করতে হবে। এ টাকা স্থানীয় সরকার বিভাগ অথবা নিবন্ধকের কার্যালয় গ্রহণ করবে। কিন্তু সরকারি ফি কত, তা জানেন না বেশির ভাগ মানুষ। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তাদের ইচ্ছে মতো ফি নেন। সবচেয়ে বড় দুর্ভোগ-মাসের পর মাস ঘুরতে হয় জন্মনিবন্ধন সনদ তুলতে অথবা সংশোধন করতে।

ঠাকুরগাঁও পৌর শহরের হাজিপাড়ার বাসিন্দা মো. তানভীর হাসান তানু। তার ১ বছরের বাচ্চা বেশ কিছুদিন ধরে মারাত্মক অসুস্থ। খুব দ্রুত চিকিৎসার জন্য ভারতে নেওয়ার দরকার। এজন্য সন্তানের পাসপোর্ট করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। পাসপোর্ট করার জন্য যেহেতু জন্মনিবন্ধনের দরকার, তাই তিনি ঠাকুরগাঁও পৌরসভার জন্মনিবন্ধন সেন্টারে গেলে দায়িত্বরত ব্যক্তি তাকে সাতদিন পরে আসতে বলেন। ৭ দিন পর গিয়ে দেখেন জন্মনিবন্ধন হয়নি। সন্তানের চিকিৎসার জন্য তার দ্রুত ভারতে যাওয়া দরকার ছিল। এরপর তিনি জন্মনিবন্ধনের জন্য আরও কয়েকবার গেলেও কর্তব্যরত ব্যক্তিরা সার্ভার সমস্যার কথা বলেন। দীর্ঘ ১ মাস ঘুরার পর তিনি জন্মনিবন্ধন হাতে পান।

একই চিত্র দেখা যায় জেলা শহরের বিভিন্ন ইউনিয়নগুলোতেও। অনেককেই মাসের পর মাস ঘুরতে হচ্ছে জন্মনিবন্ধনের জন্য। এতে ভোগান্তিতে পড়ছেন তানুর মতো অনেকে। পুরোনো সনদ এখন আর কোনো কাজেই আসছে না। নতুন করে সনদ নিতে হচ্ছে।

গড়েয়া ইউনিয়নের বাসিন্দা ধীরেন বলেন, আমি দীর্ঘ ৬ মাস ঘুরেও আমার ছেলের জন্মনিবন্ধন করতে পারিনি। ৬ মাস পরে যে জন্মনিবন্ধন দেয়, তাতেও অনেকের তথ্যগত ভুল থাকে। যার ফলে আরও ভোগান্তিতে পড়তে হয়।

ভোগান্তির কথা স্বীকার করে আব্দুল মোতালেব নামে একজন বলেন, আমি আমার বাচ্চার জন্মনিবন্ধনের জন্য দীর্ঘ তিন মাস ধরে ঘুরছি। আমরা কি দেশের নাগরিক নয়। জন্মনিবন্ধনের জন্য কেন এতদিন ঘুরতে হবে। আমার মেয়েকে কোথাও কোনো কিছু করাতে পারছি না। তারা সার্ভারের সমস্যার কথা বলছেন। এতোদিন ধরে কি সার্ভারের সমস্যা থাকে। তাদেরকে তো আমরা টাকাও দিচ্ছি। আমি টাকা দিয়েও তিন মাস যাবৎ ঘুরছি জন্মনিবন্ধনের জন্য, এখনো পাইনি। 

মো. শামীম ইসলাম নামে এক ভুক্তভোগী বলেন, আমার ভাইয়ের জন্মনিবন্ধনের জন্য আমি গড়েয়া ইউনিয়ন পরিষদে যাই। আমার মা বাবার ভোটার আইডি কার্ড চাইলে আমি সেটা দেই তাদের। পরে তারা টিকার কার্ডও চায়। টিকার কার্ড না থাকায় আমি দিতে পারিনি। এজন্য আমাকে কয়েক মাস ঘুরতে হয়। পরে কর্তব্যরত ব্যক্তি আমার কাছে কিছু টাকা চান। পরে আমি টাকা দিলে ১ ঘণ্টার মধ্যেই জন্মনিবন্ধন সনদ করে দেন। 

লস্করা গ্রামের বাসিন্দা ঝরু বলেন, আমি আমার ছেলের জন্মনিবন্ধনের জন্য দুই মাস যাবৎ ঘুরছি। পরে তারা প্রতিটি জন্মনিবন্ধনের জন্য আমার কাছে ২০০ টাকা করে নিয়েছে। এরকম অসংখ্য মানুষ দিনের পর দিন জন্মনিবন্ধনের জন্য ভোগান্তিতে পড়েন। আমি যেহেতু কর্মজীবী মানুষ কাজ রেখে প্রতিদিন যাওয়া সম্ভব হয় না। আমরা এটার দ্রুত সমাধান চাই।

গড়েয়া ইউনিয়নের ইউপি চেয়ারম্যান মো. রইচ উদ্দীন সাজু বলেন, গত এক মাস ধরে সারা দেশে সার্ভারের সমস্যা ছিল। তাই হয়ত অনেকেই জন্মনিবন্ধন করতে এসে ভোগান্তিতে পড়েন। কিন্তু এখন সার্ভার ঠিক আছে, আশা করি আর কোনো সমস্যা হবে না। এরপরও কেউ যদি ভোগান্তির শিকার হন তাহলে আমরা ব্যবস্থা নিব। 

পৌর নির্বাহী কর্মকর্তা মুজিবুর রহমান বলেন কিছুদিন আগে সার্ভারের সমস্যা হয়েছিল যার ফলে জন্মনিবন্ধন সনদ দিতে সমস্যা হয়। তাছাড়া জন্মনিবন্ধনের যে প্রক্রিয়া সেটা একটা সময়ের ব্যাপার। আমরা এটা ডিসি অফিসে পাঠায়। ডিসি অফিস থেকে সেন্ট্রালে যায়। সেখান থেকে সংশোধন হয়ে আবার ডিসি অফিসে আসে। ডিসি অফিস তারপর আমাদের পাঠায়। তখন আমরা প্রিন্ট করে দেই। তারপরও আমরা চেষ্টা করছি খুব দ্রুত জন্মনিবন্ধন দেওয়ার জন্য।

ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার নির্বাহী অফিসার আবু তাহের মো. সামসুজ্জামান বলেন, আমরা জন্মনিবন্ধনের জন্য কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি। এতে যদি কখনও সার্ভারের সমস্যা হয় দ্রুত সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে জানানোর চেষ্টা করি যেন এটা দ্রুত সমাধান হয়ে যায়। টাকা বেশি নেওয়ার বিষয়টি সুনির্দিষ্ট প্রমাণসহ আমাদের অভিযোগ করলে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

আরিফ হাসান/এএএ