লাল ফিতায় বাঁধা ‘রংপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ’
পৌরসভা থেকে সিটি কর্পোরেশনে উন্নীত হওয়ার পরও পরিকল্পিত নগরায়ণে রংপুর মহানগরীকে ঘিরে তৈরি হয়নি কোনো মাস্টারপ্ল্যান। বছরের পর বছর চিঠি চালাচালি হলেও নানা প্রতিবন্ধকতায় দীর্ঘদিনেও আলোর মুখ দেখেনি ‘রংপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ’। অথচ ২০১৪ সালের ৮ জুন সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব কমিটির সভায় সংস্থাটি গঠনের নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়। অনুমোদনের নয় বছর পেরিয়ে গেলেও রংপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ গঠন কিংবা এর কোনো কার্যক্রমে অগ্রগতি না হওয়ায় ক্ষুব্ধ রংপুরবাসী।
এদিকে দেশের আলোচনায় রংপুর এগিয়ে থাকলেও উন্নয়নে অনেকাংশে পিছিয়ে রয়েছে প্রাচীনতম এই নগরী। এ কারণে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১১ সালের ৮ জানুয়ারি জিলা স্কুল মাঠে অনুষ্ঠিত এক জনসভায় রংপুর উন্নয়নের দায়িত্ব তিনি নিজ কাঁধে তুলে নেন। এরই অংশ হিসেবে রংপুর বিভাগ, সিটি কর্পোরেশন, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন, মেট্রোপলিটন পুলিশ প্রতিষ্ঠা করেছেন। এছাড়াও চার লেন মহাসড়ক, মেরিন একাডেমি, পল্লী উন্নয়ন একাডেমি, রংপুর বিভাগীয় সদর দপ্তর নির্মাণসহ বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজও করেছেন।
বিজ্ঞাপন
সবশেষ এবছরের গত ২ আগস্ট রংপুর জিলা স্কুল মাঠে আওয়ামী লীগ আয়োজিত সমাবেশে রংপুরবাসীর জন্য উপহার হিসেবে ২৭টি প্রকল্প উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে রংপুর নগরীকে অত্যাধুনিক নগরী হিসেবে গড়ে তুলতে এসব প্রকল্পের সঙ্গে ‘রংপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ’ বাস্তবায়ন সময়ের দাবি ছিল বলে মনে করেন সচেতনমহল।
বর্তমানে রংপুর মহানগরীর বিভিন্ন এলাকার ঘুরে দেখে বোঝার উপায় নেই এটি একটি বিভাগীয় জেলা শহর। অবকাঠামোগত উন্নয়ন ছাড়া কোথাও পরিকল্পিত উন্নয়ন ছাপ নেই। এই মহানগরের রাস্তাঘাটের কিছুটা উন্নয়ন হলেও হিসেব মিলবে না দৈর্ঘ্য-প্রস্থে। ঘোষণা ও কাগজপত্রে মহানগরের প্রধান সড়কটি ৬৫ ফুট প্রশস্ত হলেও স্থানভেদে কোথাও কম আবার কোথাও বেশি। চোখে পড়বে রাস্তার ওপর বিদ্যুতের পোল। একই পোলে ঝুলছে বিদ্যুৎ, টেলিফোন, ইন্টারনেট ও ডিশের সংযোগ লাইন। রংপুর বিভাগ প্রতিষ্ঠার ১৩ বছর পরও যেন এখনো পুরো মহানগর রয়েছে অগোছালো।
রংপুর মহানগরের বিভিন্ন এলাকার মূল সড়ক পিচঢালা হলেও অলিগলির সবই এখন ঢালাই করা। হয়েছে উন্নত ড্রেনেজ ব্যবস্থা, বাড়ি বাড়ি রয়েছে ডাস্টবিন। তবে আগের চেয়ে বেড়েছে মানুষের বসবাস। সঙ্গে বেড়েছে অপরিকল্পিত ভবন নির্মাণের পরিমাণও। নগর উন্নয়নে মাস্টারপ্ল্যান না থাকায় পুরো নগরীর যত্রতত্র ইচ্ছেমতোই গায়ে ঘেঁষে উঠছে ভবনের পর ভবন।
দশ লাখেরও বেশি মানুষের বসবাস রংপুর মহানগরীতে। অথচ কোথাও কোনো পরিকল্পনার ছাপ নেই। নগরীর সচেতন মহল বলছেন, আবাসিক ভবন কোথায় হবে, বাণিজ্যিক ভবন কোথায় হবে-এ ধরনের কোনো নির্দেশনাও নেই। ফলে যত্রতত্র ইচ্ছেমতোই চলছে নগরায়ণ। এছাড়াও ক্রমবর্ধমান হারে আশপাশের জেলা থেকে মানুষ আসছে রংপুরে। পাল্লা দিয়ে নগরজুড়ে বাড়ছে যানজট।
অপরিকল্পিতভাবে বাড়িঘরের পাশাপাশি ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসারে হোটেল, মোটেল, মার্কেট, ছোট-বড় কলকারখানা, আবাসিক ভবন বা বহুতল ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। এতে করে শহরের সৌন্দর্য বাড়ছে না। বরং বাড়ছে ইট-বালু আর রড-সিমেন্টের জঞ্জাল। দিন দিন রংপুর পরিণত হচ্ছে অস্বাস্থ্যকর ও দূষিত নগরীতে। লোকবল সংকটের কারণে পুরো নগরীর কর্মকাণ্ড তদারকি করা সম্ভব হচ্ছে না।
সচেতনমহল বলছেন, ২০১৪ সাল থেকে ২০২৩ সাল আজ অবধি রংপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বাস্তবায়ন না হওয়ায় এখনো অগোছালো রংপুর মহানগরী। আধুনিক নগরায়ণের জন্য যে মাস্টারপ্ল্যান থাকা অত্যাবশ্যকীয় সেটাও এখনো করা হয়নি। ফলে অপরিকল্পিতভাবে যত্রতত্র বিল্ডিংসহ যাবতীয় স্থাপনা গড়ে উঠছে যেভাবে, তাতে একসময় রংপুর নগরী বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠবে। তাই দ্রুত রংপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বাস্তবায়নের দাবি রংপুরবাসীর।
সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন রংপুর মহানগর সভাপতি অধ্যক্ষ খন্দকার ফখরুল আনাম বেঞ্জু বলেন, একটি আধুনিক নগরের প্রথম শর্ত হচ্ছে পরিবেশবান্ধব পরিকল্পিত নগর ব্যবস্থাপনা ও বাস্তবায়ন। রংপুর মহানগরকে উন্নত নাগরিক সুবিধা, তথ্যপ্রযুক্তি ও পরিবেশবান্ধব হিসেবে গড়ে তুলতে উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বাস্তবায়ন এখন সময়ের দাবি। এর মাধ্যমে পিছিয়ে পড়া রংপুরে উন্নয়নের মূল স্রোতোধারায় সম্পৃক্ত করা সম্ভব। কিন্তু কেন এটাকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না, এটা ভাবার বিষয়।
রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও সংগঠক ড. তুহিন ওয়াদুদ বলেন, দেশের অন্যতম অপরিকল্পিত নগরগুলোর একটি রংপুর। এই নগরকে পরিকল্পনার আওতায় আনতে রংপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ গঠন করার কথা ছিল। অথচ ৯ বছরেও এটি বাস্তবায়ন হয়নি। যেভাবে রাস্তা নির্মাণে যানজট কমবে, জলাবদ্ধতা কমবে সেই উপায়ে ড্রেনেজ ব্যবস্থা করার দিকে আমাদের মনোযোগ দিতে হবে। কিন্তু সেই মাস্টারপ্ল্যান নেই। আমরা চাই দ্রুত সময়ের মধ্যে রংপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ গঠন, রংপুর সিটি কর্পোরেশনের জন্য একটি মাস্টারপ্ল্যান তৈরিসহ রংপুরকে ঢেলে সাজানোর জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হোক।
এ বিষয়ে রংপুর সিটি কর্পোরেশনের নগর পরিকল্পনাবিদ নজরুল ইসলাম বলেন, ২০১২ সালে সিটি কর্পোরেশন প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর সিটি করপোরেশনের জন্য মাস্টারপ্ল্যান তৈরি করার একটা বাধ্যবাধকতা থাকে। তারই আলোকে আমরা প্রস্তাবনা পাঠাই স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে। সেই প্রস্তাবনার আলোকে এলজিইডি ২০১৩-১৪ অর্থবছরে রংপুর সিটি কর্পোরেশনের জন্য মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করে। পরবর্তীতে সেটি সিটি কর্পোরেশন কর্তৃক অনুমোদন করে ২০১৪ সালে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে গেজেট প্রকাশের জন্য পাঠানো হয়। এখন পর্যন্ত সেই গেজেট হয়নি।
তিনি আরও বলেন, ২০২২ সাল থেকে আবারও শোনা যাচ্ছিল যে রংপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বাস্তবায়ন হবে। তারই আলোকে গতবছর গণপূর্ত মন্ত্রণালয় আমাদের কাছে একটি চিঠি দেয় মতামত জানার জন্য। তারই পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের মার্চ মাসে উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ দ্রুত করার পক্ষে মতামত প্রদান করা হয়। সেই মতামত প্রদানের প্রায় দেড় বছর হয়ে গেছে। এখন পর্যন্ত কোন সাড়া পাইনি। বর্তমানে মাস্টারপ্ল্যান না থাকায় রংপুরকে পরিকল্পিত নগরী করা সবচেয়ে বড় অন্তরায়।
এদিকে দ্রুত ‘রংপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ’ গঠনের তাগিদ জানিয়ে এরই মধ্যে লিখিত মতামত অধিদপ্তরে পাঠিয়েছে রংপুর সিটি কর্পোরেশন। রংপুর উন্নয়ন প্রকল্প এবং নগরীকে ঘিরে কোনো মাস্টার প্ল্যান না থাকায় অপরিকল্পিত নগরায়ণ বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না।
এ বিষয়ে রংপুর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা বলেন, রংপুর সিটি কর্পোরেশন গঠন হওয়ার পর অনেক কিছুই এখনো হয়নি। পৌরসভা থেকে যখন সিটি কর্পোরেশনে উন্নীত হয়, তখন একটি মাস্টারপ্ল্যান হয়। মাস্টারপ্ল্যানটি এখনো অনুমোদন হয়নি। রংপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের রিপোর্টটি চলতি বছরে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। এখন পর্যন্ত সেটাও অনুমোদন হয়নি।
তিনি আরও বলেন, আমরা দৈনিক ভিত্তিতে কিছু লোক নিয়ে মানুষের সার্ভিসটা জোড়াতালি দিয়ে চালাচ্ছি। মন্ত্রণালয় থেকে যখন যেটা চায় আমরা সঙ্গে সঙ্গে তা দেই। দেওয়ার পর অনুমোদনের বিষয়টি তো সরকারের বা স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের। যতক্ষণ স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় অনুমোদন দেয় নাই, ততক্ষণ পর্যন্ত হ্যাঙ্ক আছে। বর্তমানে বিলুপ্ত পৌরসভার জনবল কাঠামো দিয়েই সিটি কর্পোরেশন চলছে। নতুন জনবল কাঠামো অনুমোদন হয়নি। রংপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এবং নগরকে ঘিরে কোনো মাস্টারপ্ল্যান না থাকায় অপরিকল্পিত নগরায়ণ বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না।
ফরহাদুজ্জামান ফারুক/এএএ