ছিলেন রাজার হালে, পালালেন দেয়াল টপকে
প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী নন। কিন্তু শিক্ষার্থীদের দিয়ে হাত-পা টিপে নিতেন নিয়মিত। খাওয়ার পর হাত ধুইয়ে দিতে হতো। এমনকি নিজে থেকে ব্রাশও করতেন না। এসব সেবার ঘাটতি হলেই শিক্ষার্থীদের ওপর চলতো নির্যাতন। শুধু শিক্ষার্থীই নয়, তার ভয়ে তটস্থ থাকতেন শিক্ষকেরাও। অবশেষে শিক্ষার্থীদের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়। আন্দোলনে নামেন শিক্ষার্থীরা। এতে ভয়ে প্রাচীর টপকে পালিয়ে যান স্বঘোষিত ‘রাজা’ সজল ঘোষ।
বগুড়ার ইনস্টিটিউট অব হেলথ টেকনোলজির (আইএইচটি) ক্যাম্পাসে এ ঘটনা ঘটেছে। গতকাল মঙ্গলবার (২৯ আগস্ট) দুপুরে প্রতিষ্ঠানটির হোস্টেলের মিল ম্যানেজার ও শিক্ষার্থী আমিনুল ইসলামকে মারধর করায় সজল ঘোষের বিচার দাবিতে সড়ক অবরোধ করেন শিক্ষার্থীরা।
বিজ্ঞাপন
অভিযুক্ত সজল ঘোষ জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক। বর্তমান কমিটিতে তিনি কোনো পদে নেই। তিনি বগুড়ার বেসরকারি একটি ইনস্টিটিউট থেকে ডিপ্লোমা করেছেন।
রাজনৈতিক পরিচয় ব্যবহার করে বেশ কয়েক বছর আগে আইএইচটিতে ঘাঁটি তৈরি করেন সজল ঘোষ। পরবর্তীতে সাধারণ শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের মাঝে প্রভাব বিস্তার করে প্রতিষ্ঠানে ‘রাজার হালে’ দিন কাটাতে শুরু করেন।
তবে মঙ্গলবার দুপুরে তার ক্ষমতায় টান পড়ে। হোস্টেলের খাবারের টাকায় সংকট পড়ায় সজলের সঙ্গে কথা বলতে যান মিল ম্যানেজার আমিনুল। এতে রেগে আমিনুলকে মারধর করেন সজল ঘোষ। খবরটি ছড়িয়ে পড়লে মুহূর্তের মধ্যে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। উত্তেজনা বাড়ছে দেখে তখনই দেয়াল টপকে পালিয়ে যান সজল ঘোষ। তাকে না পেয়ে শিক্ষার্থীরা আইএইচটির সামনে শহরের প্রধান সড়কে অবরোধ করেন।
এ সময় সজলের বিচারের জন্য স্লোগান দিতে থাকেন শিক্ষার্থীরা। পরিস্থিতি সামাল দিতে পুলিশ, জেলা ছাত্রলীগের একাধিক নেতা-কর্মী ছুটে আসেন।
আইএইচটির তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মুশফিকুর রহিম বলেন, এমন কেউ নেই যে সজলের মারধরের শিকার হননি। চুন থেকে পান খসলেই মারতো। আমাকেও মেরেছে। অথচ তার সঙ্গে সব সময় থেকেছি।
সজল ঘোষ এখানকার শিক্ষার্থীই না। অথচ সে ২২৮ নম্বর রুমে থাকতো। সবাইকে দিয়ে হাত-পা টিপে নিতো। আমিও টিপেছি। খাওয়ার পর হাত ধুইয়ে দিতে হতো আমাদের। ব্রাশ করিয়ে দিতো ছেলেরা। কলেজ অধ্যক্ষ সব কিছু জানেন। কিন্তু তিনি আরও প্রশ্রয় দিতেন সজল ঘোষকে।
বিক্ষোভরত একাধিক শিক্ষার্থীরাও এই অভিযোগ করেন। তাদের দাবি, কথা না শুনলেই সজল শিক্ষার্থীদের মারতেন। ছুরি, চাকু পেটে ঠেকিয়ে ভয় দেখাতেন সজল। আর হোস্টেলে বসে মিলের টাকা মেরে খেতেন। কলেজে তার কথামতো কিছু না হলেই মারধর, নির্যাতন চালাতেন এই সজল ঘোষ।
শিক্ষার্থীরা বলেন, আজকে আমিনুলকে মারধর করায় শিক্ষার্থীরা আর সহ্য করতে পারেননি। তারা বিক্ষোভ শুরু করলে সুযোগ বুঝে আইএইচটির পেছনের অংশ দিয়ে দেয়াল টপকে পালিয়ে যান সজল ঘোষ।
রেডিওলজি বিভাগের শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী বাছেদ আহমেদ বলেন, ১৫ থেকে ১৬ দিন আগে ছাত্রলীগের এক প্রোগ্রামে যাওয়ার কথা ছিল। আমি আসতে একটু লেট করি। এ জন্য আমাকে প্রচুর চড়-থাপ্পড় মারে। অথচ আমি কলেজ ছাত্রলীগের একজন কর্মী। কিন্তু তিনি এই কলেজের কেউ না। সজল কলেজে আমাদের দিয়ে ব্যবসা করতো।
জাফর সিদ্দিক নামে শেষ বর্ষের আরেক শিক্ষার্থী বলেন, আমাদের খাওয়ার জন্য হোস্টেলে প্রতি মাসে ২২০০ টাকা নেওয়া হয়। আর গ্যাস বিল ১৫০ টাকা। অথচ ওরা আলু ঘাঁটি ছাড়া আর কিছু খাওয়ায় না। এসব টাকা থাকে সজলের কাছে। সে এই টাকা দিয়ে জুয়া খেলে, মদ খায়। তার রুমে গেলে এখনো মদের বোতল পাওয়া যাবে।
সন্ধ্যার দিকে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের একপর্যায়ে জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আল মাহিদুল ইসলাম জয় বলেন, সজল ঘোষ আইএইচটিতে আর প্রবেশ করবে না। তার বিরুদ্ধে আরও লিখিত অভিযোগ তোমরা দিলে আমরা সেটাও দেখবো।
আইএইচটি সূত্রে জানা গেছে, শিক্ষার্থীদের থাকার ১৯৭৮ সালে দুটি হোস্টেল চালু করা হয়। এর মধ্যে একটি ছাত্রদের। অন্যটি ছাত্রীদের। প্রথমে এটি মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট ট্রেনিং স্কুলের (ম্যাটস) শিক্ষার্থীরা ব্যবহার করত। সেসময় ম্যাটসের কার্যক্রমের জন্য এখানে কিছু ভবন নির্মাণ করা হয়। ১৯৯২ সালে থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত এটি শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজের ভবন হিসেবে ব্যবহার করা হয়। পরে এই মেডিকেল কলেজ নতুন ভবনে স্থানান্তর হয়। এরপর এখানে আইএসটির কার্যক্রম শুরু হয়।
শিক্ষার্থী ও কর্মচারীদের সঙ্গে কথা জানা গেছে, চারতলা এই হোস্টেলে মোট ৭২টি কক্ষ রয়েছে। প্রতিটি কক্ষে দুজন করে শিক্ষার্থী থাকতে পারে। বর্তমানে এখানে ১২০ জনের মতো শিক্ষার্থী রয়েছে।
সজলের বন্ধু-বান্ধব ছাড়া ক্যাম্পাসের মাঠেও কেউ খেলাধুলা করতে পারে না। বিভিন্ন অনুষ্ঠান, বনভোজনের নামে চাঁদা নেন সজল। হোস্টেলের ডাইনিং নিয়ন্ত্রণ করেন নিজেই। সে কারণে হলের মধ্যেই আবাসিক শিক্ষার্থীদের খাবার খেতে বাধ্য করা হয়।
আইএসটিতে ভর্তি হওয়ার সময় শিক্ষার্থীদের হল বরাদ্দ দেওয়া হয়। হলে থাকলে প্রত্যেক ছাত্রকে ৩ বছরের জন্য এককালীন ১২ হাজার টাকা পরিশোধ করতে হয়। তবে কোনো শিক্ষার্থী হল থেকে বের হয়ে গেলে তাকে কোনো অর্থ ফেরত দেওয়া হয় না।
তবে যাকে নিয়ে এতো কাণ্ড সেই সজল ঘোষের কোনো সন্ধান মিলেনি। তার মুঠোফোন বন্ধ থাকায় বক্তব্যও নেওয়াও সম্ভব হয়নি।
জানতে চাইলে আইএইচটির হোস্টেলের সহকারী মোখলেছুর রহমান বলেন, সজল কখনই আমাদের শিক্ষার্থী ছিল না। সজলের বিষয়ে ছাত্ররাই তো কখনও অভিযোগ দেয়নি। ও রাজনীতি করে, কথা বলাই তো সো টাফ হয়ে যায়। রাজনীতির প্রভাব দিয়েই আইএইচটিতে প্রবেশ করেছে সে।
প্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষ ডা. আমায়াত-উল-হাসিন বলেন, সজল হোস্টেলের শিক্ষার্থীদের নির্যাতন করে তা আমি জানি না। বনভোজনের নামে টাকা নিয়েছে এটাও আমি জানি না। তবে শিক্ষার্থীরা আমার কাছে লিখিত অভিযোগ দিলে আমি ব্যবস্থা নিতাম।
এ বিষয়ে বগুড়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শরাফত ইসলাম বলেন, কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কোনো ব্যক্তির কাছে জিম্মি হবে এটা কখনই কাম্য না। আইএইচটির শিক্ষার্থীরা সড়কে অবস্থান নেওয়ার পর তাদের বেশ কিছু সমস্যার কথা জানতে পেরেছি। তারা প্রিন্সিপালকে এসব সমস্যার কথা জানিয়েছেন। প্রিন্সিপাল আমাদের জানিয়েছেন তারা এসব সমস্যা সমাধান করবেন।
আরএআর