গলায় মালা দিয়ে বরণ করে নেওয়া হতো এমটিএফই’র বিনিয়োগকারীদের
অফিসে সাজ-সজ্জার অভাব ছিল না। নতুনদের অভ্যর্থনায় দেওয়া হতো ক্রেস্ট, রজনীগন্ধার স্টিক, ফুলের তোরা, গলায় মালা, টি-শার্ট। নামি-দামি রেস্তোরাঁয় খাওয়ার ব্যবস্থাও ছিল। এসবই ছিল বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষদের উদ্বুদ্ধ করার জন্য। সভা-সেমিনারে অতিথি ছিল এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিরা। আর সিইওদের চমকপ্রদ বক্তব্যে ছিল লোভনীয় অফার। সবকিছু শুনে অফার মিস করতে চাননি অনেকেই। অফার লুফে নিয়ে বিনিয়োগ করেছিলেন তারা।
তবে কয়েকমাস যেতেই লুফে নেওয়া অফারের ব্যক্তিদের মাথায় হাত। নিজের নামে করা অ্যাকাউন্টে জমানো টাকা শূন্য, এমনটি সাজ-সজ্জার সেই অফিসেও তালা। নেই সিইওদের খোঁজ। মুহূর্তেই বিনিয়োগকারীদের খোয়া গেছে কোটি কোটি টাকা। বলছিলাম কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া অনলাইনভিত্তিক এমটিএফই অ্যাপের কথা। উচ্চ মুনাফার লোভে এখানে বিনিয়োগ করেছিলেন জয়পুরহাটের স্বল্প শিক্ষিত, বেকার ও কলেজপড়ুয়া শিক্ষার্থীরা। মুনাফাতো দূরের কথা, তারা নিজেদের বিনিয়োগ করা টাকাও হারিয়েছেন।
বিজ্ঞাপন
জানা গেছে, মেটাভার্স ফরেন এক্সচেঞ্জ গ্রুপ অর্থাৎ এমটিএফই একটি অ্যাপ। শুয়ে-বসে কাজ করলেই অ্যাকাউন্টে আসবে ডলার। আর এতে বিনিয়োগ করতে হবে। যে যত বেশি বিনিয়োগ করবে, তার তত ডলার আসবে। এক কথায় বিনিয়োগ করলেই মিলবে উচ্চ মুনাফা। এমনই অফার দিয়েছিলেন ওই প্রতিষ্ঠানটির সিইওরা। তাদের টার্গেট ছিল স্বল্প শিক্ষিত, বেকার ও কলেজপড়ুয়া শিক্ষার্থীরা। আর সেই টার্গেট কাজেও এসেছে।
জয়পুরহাট জেলার প্রায় দেড় হাজার বিভিন্ন পেশার মানুষ এতে টাকা বিনিয়োগ করেন। কেউ এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে, কেউ জমি বন্ধক রেখে, ব্যাংক ঋণ নিয়ে, গরু-ছাগল কিংবা সোনা-গহনাও বিক্রি করে অ্যাপটিতে বিনিয়োগ করেন। সর্বনিম্ন ৪ হাজার টাকা থেকে ১০ লাখ ৭০ হাজার টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগকারী ছিল। উচ্চ মুনাফার পাওয়ার আশায় ১১ কোটির বেশি টাকা খোয়া গেছে বিনিয়োগকারীদের।
এমটিএফইতে বিনিয়োগ করে প্রতারিত হয়েছেন কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থী সৌখিন। তিনি জয়পুরহাট শহরের দেওয়ানপাড়ায় থাকেন। সৌখিন বলেন, সাদ আলম চৌধুরী নামে একজন সিইও ছিলেন। তিনিই আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তাদের অফার ছিল টাকা বিনিয়োগ করলে বসে বসে মুনাফা পাওয়া যাবে। ৫০ হাজার টাকায় প্রতি সপ্তাহে ৬ হাজার থেকে সাড়ে ৬ হাজার টাকা পাওয়া যাবে। আমি দুইটি আইডিতে ৪০২ ডলার বিনিয়োগ করেছিলাম। এরপর অ্যাপে ঢুকে এআই রোবট অন করে দেই। সাত দিন পর ৪০ ডলার জমা হয়েছিল। প্রথমে ৫ হাজার ৮০০ টাকা তুলেছি। কিন্তু এরপর আর কোনো টাকা তুলতে পারিনি। তাদেরকে বললে বলে সাইট আপডেট হচ্ছে। এই বলতে বলতে আমার বিনিয়োগ করা সব টাকায় শেষ। গতকাল (সোমবার) থেকে আর অ্যাপে ঢোকা যাচ্ছে না।
জয়পুরহাটের সিইও পদে কয়েকজন ছিলেন। তাদের মধ্যে সাদ আলম চৌধুরী নামে একজন প্রধান ভূমিকা রাখেন। প্রতারণার অভিযোগ এনে সাদ আলমের বিরুদ্ধে জয়পুরহাট থানায় অভিযোগ করেছেন বিনিয়োগকারী ইমন হোসেন। গত ২০ আগস্ট রাতে তিনি অভিযোগটি করেন। ইমন হোসেন শহরের দেওয়ানপাড়ার বাসিন্দা।
তিনি লিখিত অভিযোগে উল্লেখ করেছেন, জয়পুরহাট শহরের ইরাক নগরের বাসিন্দা সাদ আলম চৌধুরী সবুজনগরে এমটিএফই’র অফিস খোলেন। তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও সরাসরি সভা-সেমিনারে ডেকে নিয়ে বিকাশ ও নগদের মাধ্যমে কোম্পানির শেয়ার কেনার নামে ইমনের কাছ থেকে ৬৩ হাজার টাকা হাতিয়ে নেন। এখন অফিস তালাবদ্ধ রয়েছে আর সাদ আলম চৌধুরী পলাতক রয়েছেন। ওই অভিযোগে আরও চার জন ভুক্তভোগীর নাম রয়েছে। তাদের কাছ থেকে মোট ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা নেওয়া হয়েছে। ইমন হোসেন বলেন, আমার মতো অনেকেই এমটিএফই অ্যাপে প্রতারিত হয়েছেন। সাদ আলম চৌধুরী আমাকে অ্যাপে বিনিয়োগ করতে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। এখন তো সব শেষ। আমরা চাই প্রশাসন এই প্রতারকদের আইনের আওতায় নিয়ে আসুক।
লোকলজ্জায় মোটা অঙ্কের বিনিয়োগকারীরা কেউই প্রকাশ্যে আসতে চাচ্ছেন না। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরও কয়েকজন ভুক্তভোগী জানান, এমটিএফই অ্যাপে সিইও ছিলেন সাদ আলম চৌধুরী। তাছাড়া সাদের বাবা সহিদুল আলম, তামান্না আক্তার সুরভী, সুমন খন্দকার, আল হোসেন রাব্বী, শাহিনুর, মঈনুল খন্দকার, মোশারফ হোসেন সিইও হিসেবে ছিলেন। তারা সভা-সেমিনার করে এমটিএফই অ্যাপে বিনিয়োগ করতে উদ্বুদ্ধ করেন। এসব সভা-সেমিনারে এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিরা থাকতেন। তাদের কারণে তারা আস্থা পেয়ে বিনিয়োগ করেছিলেন। প্রতারিত হবেন তা কখনো ভাবেননি বিনিয়োগকারীরা।
এ ব্যাপারে জানতে সাদ আলমের মোবাইলে ফোন করে তার বন্ধ পাওয়া যায়। মঙ্গলবার (২২ আগস্ট) দুপুর সাড়ে ১২টায় ইরাক নগর মহল্লায় সাদ আলম চৌধুরীদের বাড়িতে গিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি। তার মা রেজিয়া সুলতানা বলেন, আমার তিন সন্তানের মধ্যে সাদ আলম চৌধুরী সবার ছোট। সে কলেজে অর্নাস করছে। পড়াশোনার পাশাপাশি আউট সোর্সিংয়ের কাজ করতো। এক সপ্তাহ আগে বাড়ি থেকে চলে গেছে। তার স্বামীও বাড়িতে নেই। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ হয়নি। তার ছেলে সাদ আলম চৌধুরী কারও সঙ্গে প্রতারণা করেনি বলে দাবি করেন তিনি।
জয়পুরহাটের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ নূরে আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, এই বিষয়টি নিয়ে সেন্ট্রাল থেকে কাজ করছে। আমরাও তদন্ত করছি।
চম্পক কুমার/এএএ