প্রযুক্তির এই যুগে মোবাইল ফোন মানুষের নিত্যসঙ্গী। মোবাইল ছাড়া যেন চলেই না। শুধু যোগাযোগের মাধ্যম নয়, মোবাইল হয়ে উঠেছে শিক্ষা ও বিনোদনের মাধ্যমও। তবে শিশু-কিশোরদের মোবাইলে আসক্তি উদ্বেগ বাড়াচ্ছে অভিভাবকদের। তাদেরকে কোনোভাবেই মোবাইল থেকে দূরে রাখা যাচ্ছে না। এমনকি পড়াশোনা বাদ দিয়ে মোবাইলে গেম খেলা কিংবা ভিডিও দেখায় মত্ত থাকছে শিশুরা। বাড়ছে মোবাইলের অপব্যবহার। 

অভিবাবকরা বলছেন, ঘুম থেকে উঠে সকালের নাস্তা, দুপুর ও রাতের খাবার থেকে ঘুমানোর আগ পর্যন্ত শিশুরা মোবাইল ব্যবহার করছে। এতে শিশুরা অসুস্থ্য হয়ে পড়ছে।

সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা বলছেন, মোবাইলের ব্যবহার মারাত্মক রূপ ধারণ করছে। এটি নিয়ে সবাইকে সচেতন হতে হবে। প্রয়োজনে সভা-সমাবেশ করতে হবে। মোবাইলের অপ্রয়োজনীয় অ্যাপস বন্ধ করতে হবে। শিশুদের খেলাধুলার প্রতি আকৃষ্ট করাতে হবে। পাঠ্যপুস্তকে এর কুফল সম্পর্কে তুলে ধরতে হবে।

চাঁদপুর শহরের ব্যাংক কলোনী এলাকার বাসিন্দা সুমাইয়া আফরিন মেঘলা বলেন, আমার শিশু সন্তানরা মোবাইলের ওপর নির্ভরশীল হচ্ছে। পড়ালেখা মনোযোগ না দিয়ে মোবাইলে গেমস, ভিডিও, টিকটকের দিকে ঝুঁকছে। আমরা মোবাইল লুকিয়ে রাখলেও লাভ হয় না। তারা মোবাইল খুঁজে নিয়ে যায়। তারা মোবাইলের প্রতি খবুই আসক্ত। তাদের নজর শুধু গেমসের দিকেই। পড়াশোনার দিকে তাদের কোনো নজর নেই মোবাইলে আসক্ত হওয়ার কারণে সকালে ঘুম থেকে উঠার পর স্কুলে যেতে চায় না। তাদের সামনে পরীক্ষা কী করবো, এ নিয়ে চিন্তায় আছি। 

চাঁদপুর শহরের বিষ্ণুদী এলাকার শরীফুল ইসলাম বলেন, আমার এক মেয়ে (৭) ও এক ছেলে (৪)। মেয়ে একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুলে পড়ে। তারা প্রতিদিনই মোবাইল দেখে। এখন মোবাইল দেখা নেশা হয়ে গেছে। তারা এমন একটা পর্যায়ে চলে গেছে যা দেখে আমি উদ্বিগ্ন। ঘুমাতে গেলেও তাদের মোবাইল দেখাতে হচ্ছে। সকালের নাস্তা, দুপুর-রাতের খাবার মোবাইল দেখে খাওয়াতে হয়। মোট কথা মোবাইল ছাড়া তাদের চলেই না। এ মোবাইল ব্যবহারের কারণে আমার মেয়েটার ছয় মাস যাবৎ চোখে সমস্যা হয়েছে। ডাক্তার বলছে, অতিরিক্ত মোবাইল ব্যবহারের কারণে তার চোখ নষ্ট হয়ে গেছে। যার কারণে মেয়েটাকে চশমা দিয়েছে। অবস্থা খারাপ হওয়ার কারণে চশমার পাওয়ার পরিবর্তন করেন। তাদের টিভি ও মোবাইল দেখা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এ মোবাইলের কারণে আমি হাতাশায় আছি। জানি না কী হবে?

চাঁদপুর পৌরসভার ৯ নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা নজরুল ইসলাম সরদার নজু বলেন, মোবাইলের ভালোর চেয়ে খারাপ দিকই বেশি। আমার বাচ্চাটার বয়স ১০ বছর। সে মোবাইলের প্রতি অনেকটা আসক্ত হয়ে পড়েছে। যার কারণে আমরা মোবাইল লক করে রেখেছি।

চাঁদপুর সদর উপজেলার তরপুরচন্ডী এলাকার বাসিন্দা শামীম মিজি বলেন, আমার একমাত্র ছেলে সিফাত। তার বয়স মাত্র ১২ বছর। সে মোবাইল ছাড়া কিছুই বোঝে না। খেতে গেলেও মোবাইল লাগবে। তাকে নিয়ে মহাবিপদে আছি।

চাঁদপুর জেলা আইনজীবী সমিতির সদস্য অ্যাডভোকেটে আরিফ রাব্বানী বলেন, আমার ১০ বছর বয়সী একটা ছেলে রয়েছে। আগে সে টিভি দেখতো। এখন আর টিভি দেখে না। তাকে প্রতিনিয়তই মোবাইল দিতে হয়। এখন মোবাইল দেখে। খাওয়ার সময় তাকে মোবাইল দিতে হয়। এর ফলে আমার বাচ্চাদের চোখের রেটিনা নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে গিয়ে ছিলাম। ডাক্তার বলছে, অতিরিক্ত মোবাইল ব্যবহার করার কারণে তার চোখে সমস্যা দেখা দিয়েছে। এখন তাকে মোবাইল থেকে দূরে রাখতে পারলে তার এ সমস্যা দূর হবে। তাদের যদি আমরা বই দিয়ে বসাই, পড়তে চায় না। 

চাঁদপুর মডার্ন আদর্শ শিশু একাডেমির সহকারী শিক্ষক কামাল আহমেদ জানান, আমরা যখন শিক্ষার্থীদের পড়াতে যাই, তখন তারা মোবাইল ছাড়া পড়তে পারে না। তারা পড়ার সঙ্গে মোবাইলে ইউটিউব-ফেসবুক দেখার বাহানা করে। অনেক সময় তাদের সঙ্গে মোবাইল শেয়ার করতে হয়। তারা যেন ক্লাসে কথা না বলে। এ বিষয়ে অভিবাবকদের বলি আপনার বাচ্চা মোবাইলের প্রতি এতো আসক্ত কেন। তখন তারা আমাকে বলে মোবাইল না দিলে তারা লেখাপড়া করতে চায় না। তাই তাদের মোবাইল দিতে হয়। 

চাঁদপুর মডার্ন আদর্শ শিশু একাডেমির অধ্যক্ষ ওমর ফারুক বলেন, কল্যাণমূলক জিনিসপত্র ছাড়া মোবাইলে অপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র পরিহার করতে হবে।

চাঁদপুর সদর উপজেলার চান্দ্রা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান খান জাহান আলী কালু পাটওয়ারী বলেন, আমাদের ইউনিয়নে ১০-১৫ জন ছেলে এক স্থানে বসে। তারা শুধু মোবাইলে গেম খেলে, কার্টুন দেখে। এরা এ সময় একজন আরেকজনের সঙ্গে কথা বলে না। তারা মোবাইলে আসক্ত হয়ে পড়েছে। আমি অভিবাবকদের অনুরোধ করছি- ১৮ বছর বয়সের আগে সন্তানদের হাতে যেন মোবাইল ফোন না দেন। 

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চাঁদপুর জেলার সাধারণ সম্পাদক রহিম বাদশা বলেন, বিজ্ঞানে যতগুলো অবিষ্কার হয়, প্রত্যেকটি আবিষ্কারের ক্ষেত্রে শুরুতে অপপ্রয়োগ হয়। সুতরাং আমাদের তথ্য-প্রযুক্তি একটা বিশাল ভান্ডার। যার কারণে এটারও অপপ্রয়োগ হচ্ছে। মোবাইল, ইন্টারনেট, ফেসবুক অস্বাবাবিক হারে ব্যবহার হচ্ছে। তাই এটির সীমাবদ্ধতা ও নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন। এটির বহুমুখী ক্ষতিকর দিক আছে। ক্ষতির দিকগুলো সবাই যখন জানতে পারবে, তখন এটি নিয়ন্ত্রণে আসবে।

তিনি আরও বলেন, মোবাইলের ক্ষতিকর বিষয়গুলো আমাদের শিশু, অভিভাবক, শিক্ষার্থী-শিক্ষকদের জানাতে হবে। এ বিষয়ে পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা যায় কিংবা শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া যায়। তাহলে শিক্ষার্থীরা এর অপপ্রয়োগ সর্ম্পকে জানবে। তারা মোবাইল থেকে দূরে সরে আসবে।

চাঁদপুর সদর উপজেলার শাহতলী জিলানী চিশতী কলেজের চেয়ারম্যান সোহেল রুশদী জানান, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী মোবাইলে এতটাই আসক্ত হয়ে পড়েছে যে, অভিভাবকরা তাদের ফিরিয়ে আনতে পারছেন না। অভিভাবকরা অনেকটা অসহায় হয়ে পড়েছে। শিক্ষার্থীরা আবেগতাড়িত হয়ে পড়ছে। অনেকে আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে। তাই মোবাইল অপব্যবহার রোধে শিক্ষক, পুলিশ, প্রশাসন, সাংবাদিক, জনপ্রতিনিধি সকলে মিলে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। পাশাপাশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে খেলাধুলা আরও বেশি বাড়ানো উচিত। 

চাঁদপুর প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি ইকবাল হোসনে পাটওয়ারী বলেন, আমাদের বাচ্চাদের হাতে হাতে এখন স্মার্ট ফোন। তারা ফেসবুক ব্যবহার করে। সেই সুবাদে বিভিন্ন জগতে ঢুকছে। গেমসসহ নানা ধরনের অ্যাপস ব্যবহার করছে। মোবাইলে আসক্ত হয়ে পড়ছে। আমার নিজের বাচ্চাও মোবাইলে ঝুঁকে পড়ছে। অভিভাবকরা এটিকে নিয়ন্ত্রণ করার কোনো পথ পাচ্ছে না। 

আরেক সাবেক সভাপতি গিয়াস উদ্দিন মিলন বলেন, মোবাইল আসক্তি ইয়াবার মতো হয়ে গেছে। এটি আমাদের উঠতি বয়সী ছেলে-মেয়েদের ধ্বংস করে দিচ্ছে। আমাদের এ থেকে পরিত্রাণ পেতে হবে। তা না হলে আগামী প্রজন্ম একেবারেই একটা ব্যর্থ প্রজন্ম হিসেবে গড়ে উঠবে। বাবা-মায়েরা সন্তানের মোবাইল ব্যবহারের কারণে উদ্বিগ্ন।

চাঁদপুর সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ডা. মো. আসিবুল আহসান চৌধুরী জানান, অতিরিক্ত মোবাইল ব্যবহারের ফলে শিশুসহ সকলের চোখে বড় ধরনের ক্ষতি হয়। ঘুম কম হয়। ফলে ব্রেন ক্যান্সারের সম্ভাবনা রয়েছে। মোবাইল যত বেশি ব্যবহার করতে থাকবেন আরও ব্যবহার করতে ইচ্ছা করবে। অতিরিক্ত মোবাইল ব্যবহাকারী ব্যক্তির মনে জাগবে তিনিই পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি কষ্টে আছেন। তাই মোবাইল ব্যবহার কম করতে হবে। 

চাঁদপুর সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর অসিত বরণ দাশ জানান, স্মার্টফোন ব্যবহার বেড়েছে। মোবাইলকে আমি একটি ডিজিটাল ডিভাইস হিসেবে দেখি। মোবাইলে পারস্পারিক কথাবার্তা ছাড়াও আর কিছু ফিচার রয়েছে। সেটি দিয়ে আমরা গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে থাকি। যেমন ফটোগ্রাফি থেকে শুরু করে লার্নিং সেশন পর্যন্ত। এটি নিয়ে অভিভাবকদের উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। নতুন প্রজন্মের কাছে মোবাইলের ইতিবাচক ও নীতিবাচক দিকগুলোকে তুলে ধরে সচেতন করতে হবে। মোবাইল ব্যবহার মনিটরিং করতে হবে।

চাঁদপুর সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম দেওয়ান নাজিম জানান, আমাদের উতক্তি বয়সের ছেলে- মেয়েদের এখনই মোবাইল ব্যবহার করা প্রয়োজন পড়ে না। তারা অকারণে মোবাইল ব্যবহার করে। এতে তাদের জীবন ভাল চেয়ে খারাপের দিকে ধাবিত হচ্ছে। আমি অবিভাবকের অনুরোধ করছি, তারা যে অপ্রয়োজনে তাদের সন্তানদের মোবাইল কিনে না দেন।

আরএআর