রাঙামাটি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের ৬ষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র কাইয়ুম (১২)। প্রতিদিন স্কুল শেষে বাসায় গিয়ে খেলার জন্য বিকেলে আবারো ফিরে আসে স্কুল প্রাঙ্গণে। কারণ তার বাসার আশপাশে কোনো খেলার মাঠ নেই। স্কুল থেকে বাসা অনেক দূরে হওয়া সত্ত্বেও কাইয়ুমের মত অনেকেই বিকেলে স্কুলে ফিরে আসে খেলাধুলার জন্য। পার্বত্য জেলা রাঙামাটিতে শিশু-কিশোরদের জন্য পর্যাপ্ত খেলার মাঠ না থাকায় তাদের খেলাধুলার জন্য দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হয়।

রাঙামাটি জেলা সদরে মোট দুটি বড় খেলার মাঠ রয়েছে। যার একটি শহরের রিজার্ভ বাজারের শহীদ আব্দুল শুক্কুর স্টেডিয়াম ও অন্যটি শহরের রাজবাড়ী এলাকায় অবস্থিত রাঙামাটি চিং হ্লা মারী স্টেডিয়াম, যেটি রাঙামাটি শহরের কেন্দ্রীয় স্টেডিয়াম হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এছাড়া ছোটবড় আর যে কয়টি খেলার মাঠ রয়েছে তার সবকটিই বিভিন্ন স্কুলের সামনের মাঠ। যে-সব স্কুলকলেজের নিজস্ব মাঠ রয়েছে তার মধ্যে রাঙামাটি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, রাণী দয়াময়ী উচ্চ বিদ্যালয়, লেকার্স পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ, শাহ বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়, রাঙামাটি সরকারি কলেজ ও রাঙামাটি পাবলিক কলেজ অন্যতম। তবে অধিকাংশ প্রাইমারি ও উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব মাঠও নেই। ফলে স্কুল থেকে শুরু করে কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থী পর্যন্ত সবাই দিন দিন আসক্ত হয়ে পড়ছে মোবাইল ফোনে।

মনঘোর প্রি-ক্যাডেট স্কুলের ৮ম শ্রেণির শিক্ষার্থী জেসিকা চাকমা বলেন, আমি নিয়মিত ফুটবল প্র্যাকটিস করি। কিন্তু আমার বাসার আশপাশে কোনো মাঠ নেই। তাই আমাকে আমার বাসা থেকে ৪ কিলো দূরে রাঙামাটি মারী স্টেডিয়ামে এসে অনুশীলন করতে হয়। আমার অনেক বন্ধুরা মাঠের অভাবে খেলতে না পেরে মোবাইলে আসক্ত হয়ে পড়ছে।

মোবাইলের ভার্চুয়াল গেইম কিংবা ফেসবুকিংয়ের কারণে বিঘ্নিত হচ্ছে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা থেকে শুরু করে মানসিক বিকাশ। দিন দিন শিশু-কিশোরদের মোবাইলে আসক্তিতে উদ্বেগ জানিয়েছেন অভিভাবকরা।

রাঙামাটি শহরের কয়েকটি মাঠের বাইরে তেমন মাঠ না থাকায় মোবাইলে আসক্ত হয়ে পড়ছে শিক্ষার্থীরা

লেকার্স পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের অভিভাবক শর্মিষ্ঠা দত্ত বলেন, শিশুদের উপযুক্ত মানসিক ও শারীরিক বিকাশের জন্য খেলাধুলা ও কালচারাল কার্যক্রমের খুবই প্রয়োজন। পাশাপাশি পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ভালো সময় কাটানোটাও গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু ব্যস্ততার কারণে শিশু-কিশোরদের সময় দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ছে। এই গ্যাপটা ওরা পূরণ করছে মোবাইলের মাধ্যমে। দীর্ঘক্ষণ মোবাইল ব্যবহার ওদেরকে শারীরিক ও মানসিকভাবে দুর্বল করে দিচ্ছে। মোবাইল আসক্তি দূর করতে হলে ওদের খেলাধুলা করার সুযোগ দিতে হবে। কিন্তু রাঙামাটিতে পর্যাপ্ত খেলার মাঠ না থাকায় সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে তারা।

আরেক অভিভাবক মো. রনি বলেন, বর্তমানে প্রেক্ষাপটে আমাদের সন্তানদের খেলাধুলা করার জন্য পর্যাপ্ত জায়গা ও খেলার সঙ্গী নেই। নিরাপত্তার কারণে হলেও বেশিরভাগ সময় বাসায় রাখতে হয় বাচ্চাদের। এতে তাদের বিনোদনের একমাত্র মাধ্যম হয়ে উঠেছে মোবাইল। মোবাইল ফোনের ব্যবহারের ফলে যে চোখের ক্ষতি ও মানসিকভাবে সমস্যায় পড়ছে সেটি আমরা অভিভাবকরা বুঝতে পেরেও কিছু করতে পারছি না। এক্ষেত্রে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর উচিত আরও বেশি বেশি খেলাধুলা ও সহশিক্ষা কার্যক্রমে বাচ্চাদের যুক্ত করা।

অভিভাবকদের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের মোবাইল ব্যবহারের আসক্তি বিষয়ে উদ্বিগ্ন শিক্ষকরাও। শিক্ষার্থীদের নিয়মিত ক্লাসে উপস্থিত না হওয়া, আচরণগত পরিবর্তনসহ নানান সমস্যার কথা জানাচ্ছেন তারা।

রাণী দয়াময়ী উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক মো. আমিনুল ইসলাম বলেন, পড়ালেখার বাইরে শিক্ষার্থীদের যে অবসর সময়টা থাকে, ঐ সময়টাতে তারা খেলাধুলা করে কাটায়, যা খুবই প্রয়োজনীয়। কিন্তু রাঙামাটি সদরে পর্যাপ্ত খেলার মাঠ না থাকার কারণে সেই সময়টাতে তারা মোবাইলে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এর ক্ষতিকর প্রভাব আমাদের শিক্ষার্থীদের মধ্যে দেখতে পাই। প্রশাসনের উচিত প্রতিটি ওয়ার্ডে অন্তত একটি খেলার মাঠের ব্যবস্থা করা।

মাঠ অনেক দূরে হওয়ায় অনেকেই বঞ্চিত হচ্ছে খেলাধুলা থেকে

রাঙামাটি সিএইচটি পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটের আর.এস বিভাগের শিক্ষিকা জিসান উল শারমিন বলেন, শিক্ষার্থীরা মোবাইলের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ার নানান লক্ষণ আমরা ক্লাসে দেখতে পাই। যার মধ্যে নিয়মিত ক্লাসে না আসা, অমনযোগী থাকা, পড়া বুঝতে না পারা উল্লেখযোগ্য। যতই দিন যাচ্ছে শিশু-কিশোররা মাঠে খেলাধুলা বাদ দিয়ে মোবাইল গেমিংয়ে আসক্ত হয়ে পড়ছে।

রাঙামাটি সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর তুষার কান্তি বড়ুয়া বলেন, একটা সময় আমার কলেজে অ্যান্ড্রয়েড ফোন ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা ছিল। কিন্তু করোনাকালীন সময়ে অনলাইন ক্লাস, বিভিন্ন নোটিশ প্রদান, অ্যাসাইনমেন্ট ডাউনলোডসহ বিভিন্ন কাজে অ্যান্ড্রয়েড ফোন ব্যবহারটা জরুরি হয়ে পড়েছিল। মহামারি সময় অতিক্রান্ত হয়ে গেলেও শিক্ষার্থীসহ বয়স্করা পর্যন্ত এখন মোবাইলে আসক্ত। নিষেধাজ্ঞা আরোপ কিংবা কড়াকড়ি করে আমরা মোবাইল আসক্তিটা খুব বেশি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবো না। এক্ষেত্রে পরিবারকে ভূমিকা রাখতে হবে। পাশাপাশি অতিরিক্ত মোবাইল ফোন ব্যবহারের ক্ষতিকর দিকগুলো নিয়ে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও প্রচার মাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধিমূলক প্রচার চালানো উচিত বলে মন্তব্য করেন তিনি।

মোবাইল ফোনের আসক্তি হ্রাসকরণে শিক্ষার্থীদের নিয়ন্ত্রিত মোবাইল ফোন ব্যবহারের বিষয়ে গুরুত্ব দিয়েছেন সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা। রাঙামাটির স্থানীয় পত্রিকা দৈনিক পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পাদক ফজলে এলাহী বলেন, মোবাইল বর্তমানে প্রযুক্তির খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান। মোবাইলে শিক্ষার্থীদের আসক্তিটা কোন পর্যায়ে যাচ্ছে সেটিই দেখার বিষয়। শিক্ষার্থীরা যাতে তার শ্রেণি কার্যক্রম ও পড়ালেখা সম্পর্কিত অনলাইন সাইট ব্যতীত অন্যকিছু ভিজিট করতে না পারে সেটি পারিবারিক এবং প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি যেহেতু অনিয়ন্ত্রিত মোবাইল ব্যবহারের ফলে চোখ ও মানসিক সমস্য তৈরি হয়, তাই দিনের একটি নির্দিষ্ট সময়ের বাইরে যাতে মোবাইল ব্যবহার করতে না পারে সেদিকে অভিভাবকদের সজাগ দৃষ্টি রাখা উচিত।

রাঙামাটিতে খেলার মাঠের অপর্যাপ্ততা বিষয়ে রাঙামাটি জেলা ক্রীড়া সংস্থার সদস্য ও রাঙামাটি জেলা ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক মো. নাছির উদ্দিন সোহেল বলেন, রাঙামাটির কয়েকটি ঐতিহ্যবাহী স্কুল ব্যতীত অধিকাংশ স্কুলেরই খেলার মাঠ নেই। রাঙামাটিতে যে খেলাধুলার আয়োজনগুলো হয় সেগুলো প্রায়ই মারী স্টেডিয়ামেই হয়। বৃহত্তর বনরুপা ও পুরাতন বাস স্টেশন পর্যন্ত কোনো খেলার মাঠ না থাকায় শিশু-কিশোররা মোবাইলে আসক্ত হয়ে পড়ছে। আমরা জেলা ক্রীড়া সংস্থার পক্ষ থেকে বিকল্প উপায়ে মাঠ সৃষ্টির চেষ্টা করছি। তবে এতে জেলা প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট সকলের সহযোগিতা ও আন্তরিকতা প্রয়োজন।

এএএ