পাহাড়ি নারীরা স্বপ্ন বোনেন থামি শাড়িতে
খাগড়াছড়িতে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব বৈসু, বিজু, সাংগ্রাই (বৈসাবি) আবার দোরগোড়ায়। এ উৎসব সামনে রেখে বাজারে, পাড়ায়, বটতলায় চলছে হাতে বোনা থামি শাড়ি বিক্রি। সারা বছর অন্য ধরনের পোশাক পরলেও বৈসাবি উপলক্ষে পাহাড়ি নারীদের পছন্দের তালিকায় প্রথমে থাকে থামি শাড়ি।
পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় এই প্রাণের উৎসব ঘিরে নানা আয়োজন মাতিয়ে রাখে সবাইকে। আয়োজন রঙিন করতে নানা রঙের থামি শাড়ি পরেন পাহাড়ি নারীরা। সারা বছর তারা এই থামি পরে থাকলেও নতুন বছর ঘিরে থাকে উৎসবের আমেজ। তাই নিজেদের চাহিদা অনুসারে দাম দিয়ে কিনে থাকেন হাতে বোনা থামি শাড়ি।
বিজ্ঞাপন
বাজারে বিক্রি হওয়া থামি শাড়ি পাওয়া যায় সব বয়সী নারীর মাপ অনুসারে। ৩ হাজার থেকে শুরু করে ৯ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয় এই শাড়ি। পাহাড়ি নারীদের ব্যবহারের জন্য একটি থামি হাতে বোনাতে সময় লাগে ১০ থেকে ১৫ দিন। কাপড়ের মান অনুসারে আরও একটু বেশি সময়ও লাগে। ফলে এই শাড়ির দাম অন্য কাপড়ের তুলনায় একটু বেশি বাজারে।
পার্বত্য অঞ্চলের পাহাড়ি নারীরা গোষ্ঠীগতভাবে ব্যবহার করে আসছেন থামি শাড়ি। তারই ধারাবাহিকতায় এখন সব ধর্মীয় অনুষ্ঠানে এই থামির প্রচলন রয়েছে অনেক বেশি। নারীরা বাজার থেকে সুতা কিনে নিজের পছন্দমতো করে বানিয়ে ব্যবহার করে থাকেন। তাদের গোষ্ঠীগত ঐতিহ্যবাহী পোশাক বলেই এই থামি পরতে হয়। যত দামই হোক, বাজার থেকে কিনে অথবা নিজে বানিয়ে এই থামি পরে থাকেন তারা।
জানা গেছে, সুতার বিম একটু উঁচু খুঁটির সঙ্গে বেঁধে কাপড়ের বিমের সঙ্গে দড়ি বা বেল্ট বেঁধে সেই দড়ি বা বেল্ট কোমরে পেঁচিয়ে টানটান করে কাপড় বোনা হয় কোমর তাঁতে।
এই তাঁতের গঠনকাঠামো খুবই সরল। কখন, কোথায় এই তাঁতের জন্ম হয়েছিল, সেটা জানেন না তারা কেউ। প্রয়োজনের সময় এই তাঁত খুলে নিয়ে যেকোনো জায়গায় চলে যাওয়া যায়। বাংলাদেশে এখনো চাকমা, মারমা, মণিপুরি প্রভৃতি সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে এই তাঁতের ব্যবহার রয়েছে। এ তাঁতযন্ত্রে মোটা কাপড় তৈরি করা হয়।
পানছড়ি থেকে খাগড়াছড়ি বাজারে থামি শাড়ি বিক্রি করতে আসা শুভরানী চাকমা ঢাকা পোস্টকে বলেন, ২৫ বছর ধরে এই থামি শাড়ি জেলার বিভিন্ন বাজারে বিক্রি করে থাকি। এগুলোর দাম আগের তুলনায় এখন অনেক বেশি। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে দাম অনেক বেড়ে গেছে। এ কারণে এখন আর আগের মতো লাভ হয় না। কিন্তু দীর্ঘদিন এই ব্যবসা করার কারণে এখন এ ব্যবসা ছাড়তে পারছি না। থামি শাড়ি বিক্রি করে যা লাভ হয়, তা দিয়ে সংসারে বাড়তি জোগান দিতে পারি।
খাগড়াছড়িতে ১৭ বছর ধরে এই ব্যবসার সঙ্গে জড়িত মৌসুমী চাকমা বলেন, দেশে সবকিছুর দাম বাড়ছে। থামি শাড়ি ৩ থেকে ৯ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি করা যায় মান অনুসারে। বেশি দামি শাড়িগুলোর চাহিদা থাকে বিজু উৎসবে। থামি শাড়ি রাঙামাটিতে বেশি উৎপাদিত হয়। তাই ওখান থেকে আমরা পাইকারি কিনে এনে এখানকার বিভিন্ন বাজারে খুচরা বিক্রি করে আয় দিয়েই সংসার চালাই কোনোরকমে।
থামি শাড়ি কিনতে আসা খুশি চাকমা ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রতিবছরই বিজু উৎসবে থামি শাড়ি কিনে থাকি। পাড়ার বান্ধবীরা একই রঙের শাড়ি কিনে একসঙ্গে ঘোরাঘুরি করি। আগের তুলনায় এবার দাম অনেক বেশি। এত বেশি দাম দিয়ে কেনা সম্ভব হয় না।
খাগড়াছড়ির নারী উদ্যোক্তা শাপলা দেবী ত্রিপুরা ঢাকা পোস্টকে বলেন, থামি শাড়ির চাহিদা অনেক বেশি। প্রান্তিক এলাকার নারীরা এই থামি বানিয়ে থাকেন। নিজ অর্থে যা সুতা কিনতে পারেন, তা দিয়েই কাজ করেন। এই শিল্পে পৃষ্ঠপোষকতার প্রয়োজন আছে কি না, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, সরকারিভাবে কোনো ঋণ তারা পান না বিভিন্ন জটিলতার কারণে। যদি ব্যাংক থেকে সহজ শর্তে ঋণ পেতেন তারা, তাহলে পাহাড়ি এলাকায় এটি উৎপাদন আরও বেড়ে যেত বাণিজ্যিকভাবে। লাভবান হতো পাহাড়ের হতদরিদ্র মানুষগুলো।
খাগড়াছড়ি মহিলাবিষয়ক অধিদফতরের উপপরিচালক মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, দেশের অসহায়, হতদরিদ্র নারীদের কর্মক্ষম করে তুলতে মহিলা অধিদফতর বিভিন্ন রকমের প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে। পরবর্তীতে যেসব নারী উদ্যোক্তা হয়ে কাজ করতে চান, তাদের জন্য অধিদফতর থেকে একটা ছোট ঋণের ব্যবস্থা আছে। এই ঋণ যেকোনো নারী কাজের জন্য নিতে পারেন। কারও যদি এর ছেয়ে বেশি পরিমাণ ঋণের প্রয়োজন হয়, তাহলে নিয়ম অনুসারে পর্যাপ্ত কাগজপত্র দিয়ে বড় আকারের ঋণ নিতে পারবেন কৃষি ব্যাংক থেকে।
এনএ