২০১৭ সাল। পদ্মার ভয়াল ভাঙনে বাপ-দাদার স্মৃতিসহ ভিটেমাটি হারিয়েছিলেন পঁচাত্তর বছর বয়সী আব্দুল মান্নান রাড়ী। বসতবাড়িসহ ফসলি জমি নদীভাঙনে হারিয়ে ছেলে-মেয়ে ও স্ত্রীসহ পথে-প্রান্তরে রাত কেটেছে তার। আত্মীয়স্বজন থেকে ঋণ করে চার শতাংশ জমি কিনতে পারলেও বসতঘর তৈরি করতে পারেননি বলে থাকতে হতো জীর্ণ ভাড়া বাড়িতে।

এবার কাঙ্ক্ষিত সেই স্বপ্ন পূরণ হতে যাচ্ছে আব্দুল মান্নানের। বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী ঘর তৈরির জন্য নগদ সাড়ে তিন লাখ টাকা পেয়ে ভিটেমাটি হারানো মান্নানের বসতঘর তৈরির স্বপ্ন পূরণ হতে যাচ্ছে।

শনিবার (৫ আগস্ট) দুপুরে আব্দুল মান্নানসহ ২৬ জনের মধ্যে বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী শরীয়তপুর জেলা কমান্ড্যান্ট কার্যালয়ে মোট ৩৬ লাখ টাকার চেক বিতরণ করেছে।

জানা যায়, শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার মোক্তারের চর ইউনিয়নের মূলপাড়া গ্রামের আব্দুল মান্নান রাড়ী নদীভাঙনে বসতবাড়িসহ ৮০ শতাংশের বেশি জমি হারিয়ে অসহায় হয়ে পড়েন। পেশায় একজন ভিডিপি সদস্য আব্দুল মান্নান স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে, পুত্রবধূ ও নাতনি নিয়ে ঘরবাড়ি হারিয়ে বিপাকে পড়েন। আত্মীয়স্বজনদের কাছ থেকে ২ লাখ ৬০ হাজার টাকা ঋণ করে নড়িয়ার লুংসিংহ গ্রামে চার শতাংশ জমি ২০২০ সালে ক্রয় করলেও অর্থাভাবে বসতঘর নির্মাণ করতে পারেননি। মাসিক ১ হাজার ৫০০ টাকায় জীর্ণ একটি বাড়ি ভাড়া নিয়ে বসবাস করতেন আব্দুল মান্নান।

বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর পক্ষ থেকে গৃহ নির্মাণের জন্য নগদ সাড়ে তিন লাখ টাকা পেয়ে আনন্দে কেঁদে ফেলেন আব্দুল মান্নান। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, ভয়াল পদ্মা চিরদিনের জন্য বাপ-দাদার স্মৃতি কেড়ে নিয়েছে। মাথা গোঁজার ঠাঁই বসতঘরটুকুও রক্ষা পায়নি ভাঙন থেকে। নদীভাঙনের পর পদ্মায় বেড়িবাঁধ হয়েছে। কিন্তু আমার যা সর্বনাশ হওয়ার তা তো হয়েই গেছে। স্ত্রী, ছেলে ও স্বজনদের নিয়ে পথে-প্রান্তরে ঘুরেছি। বৃদ্ধ বয়সে ভারী কাজও করতে পারি না। ছেলেরা যা উপার্জন করে তা দিয়ে সংসার ও ওষুধের খরচ বহন করতেই কষ্ট হয়। জীবনের শেষ বয়সে এসে মাথা গোঁজার ঠাঁই হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়ছিলাম। আনসার বাহিনী আমাকে বৃদ্ধ বয়সে মাথা গুঁজতে বসতঘর নির্মাণ করতে টাকা দিয়েছে। আমার চেয়ে আনন্দিত ব্যক্তি পৃথিবীতে আর কেউ নাই এখন।

আব্দুল মান্নানের ছেলে শহিদুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, বৃদ্ধ মা-বাবার ওষুধ ও সংসার খরচ ছাড়াও বসতঘর নির্মাণের জন্য জমি ক্রয় করতে যে টাকা ঋণ করেছিলাম তা পরিশোধ করতেই আমাদের দুই ভাইয়ের উপার্জন শেষ হয়ে যেত। বসতঘর নির্মাণের বিষয়টি ছিল আমাদের জন্য স্বপ্নের মতো। আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী ঘর নির্মাণ করতে নগদ অর্থ দেওয়ায় তাদের কাছে চির কৃতজ্ঞ থাকবে আমার পরিবার।

বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী শরীয়তপুর জেলার কমান্ড্যান্ট মো. মইনুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল থেকে অসহায় দরিদ্রদের খুঁজে নিয়ে আর্থিক অনুদান প্রদানের চেষ্টা করছি। এই কর্মসূচির অংশ হিসেবে আমরা প্রায় ৩৬ লাখ টাকার চেক বিতরণ করেছি। আব্দুল মান্নানদের মতো গৃহহীন গরিব-অসহায়দেরকে খুঁজে বের করতে পরামর্শ দিয়েছেন আমাদের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল একেএম আমিনুল হক। আব্দুল মান্নানরা যদি গৃহ নির্মাণ করে পরিবার নিয়ে সুখে-শান্তিতে বসবাস করতে পারে, তাহলেই আমাদের এই প্রচেষ্টা সার্থক। আইনশৃঙ্খলা রক্ষার পাশাপাশি আনসার বাহিনী ক্ষুধা ও দারিদ্রমুক্ত স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে কাজ করে যাচ্ছে।

চেক বিতরণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন জেলা পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান এমএ কাইয়ুম পাইক, আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর শরীয়তপুর সার্কেলের অ্যাডজুট্যান্ট আব্দুল মান্নান মিয়া, উপজেলা আনসার ও ভিডিপি প্রশিক্ষক মো. নাজমুল হক, নড়িয়া উপজেলার আনসার ও ভিডিপি কর্মকর্তা আব্দুর রহিম মিয়া, জাজিরা উপজেলার বকুল আক্তার, ভেদরগঞ্জ উপজেলার তাহমিনা আক্তার প্রমুখ।

সাইফুল ইসলাম সাইফ রুদাদ/এমজেইউ