ছাদে মাছ চাষ করে সফল
কুষ্টিয়ার দৌলতপুরে কয়েকজন শিক্ষিত তরুণ প্রথমবারের মতো শুরু করেছেন বায়োফ্লক বা ঘরোয়া পদ্ধতিতে মাছ চাষ। বাড়ির আঙিনা ও ছাদে মাছ চাষ করেছেন তারা।
ইউটিউবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ চাষের আধুনিক পদ্ধতি ‘বায়োফ্লক’ দেখে এবং জেনে চাষ শুরু করে চার-পাঁচ মাসেই সফলতা পেয়েছেন এসব তরুণ।
বিজ্ঞাপন
তেলাপিয়া, শিং, মাগুর ও পাবদাসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ বায়োফ্লক পদ্ধতিতে চাষ করেছেন তারা। পুকুর কেটে কিংবা লিজ নিয়ে মাছ চাষের চেয়ে বায়োফ্লক পদ্ধতিতে চাষ সহজ এবং লাভজনক বলে মনে করছেন তরুণরা।
দৌলতপুর উপজেলার ফিলিপনগর ইউনিয়নের পূর্ব ফিলিপনগর গ্রামের গোলাবাড়িয়া পাড়ার মৃত মো. হাফিজুর রহমানের ছেলে শিহাব উদ্দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনে অনার্স-মাস্টার্স করেছেন। বেকার বসে না থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে বায়োফ্লক পদ্ধতিতে বাড়ির আঙিনায় ৭৫ হাজার লিটারের দুটি ট্যাংকে ৫০ হাজার তেলাপিয়া মাছের চাষ করছেন।
শিহাব উদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, চাকরির পেছনে না ছুটে ২০১৯ সাল থেকে বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ করছি। বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ সহজ এবং লাভজনক। আমি এই পদ্ধতিতে চাষ করে সফলতা পেয়েছি। প্রথমে পোনা কিনে ঠকেছি; না হয় দ্বিগুণ লাভ হতো।
তিনি বলেন, আমি শিং, কই, মাগুর ও পাবদাসহ বেশ কয়েক ধরনের মাছ চাষ করেছি। অবকাঠামো ও সেড নির্মাণ করতে এক লাখ টাকা খরচ হয়েছে। জেনারেটর, এয়ার মেশিন, প্যারামিটারসহ বিভিন্ন যন্ত্রপাতি বাবদ এক লাখ টাকা খরচ হয়েছে। দেড় টাকা দরে প্রতি পিস পোনা কিনেছিলাম। পোনা বাবদ মোট ৯০ হাজার ও মাছের খাবার ৩০ হাজার টাকা ব্যয় হয়েছিল। খরচ বাদ দিয়ে লাখ টাকার ওপরে লাভ হওয়ার সম্ভবনা রয়েছে।
শিহাব উদ্দিনের পরামর্শ ও সহযোগিতায় বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ শুরু করেছেন একই এলাকার শাহিনুর রহমান।
শাহিনুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, বায়োফ্লক পদ্ধতিতে শিহাব উদ্দিনের মাছ চাষ দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে চাষ করেছি। এ পদ্ধতিতে অল্প পুঁজিতে বেশি লাভ করা যায়। কারণ মাছের বর্জ্য থেকে খাদ্য তৈরি হয়। ৫০ হাজার টাকা খরচ করে যে কেউ পাঁচ হাজার লিটার পানির ট্যাংকে বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ করতে পারেন। খরচ বাদ দিয়ে ৬০-৭০ হাজার টাকা লাভ হবে।
তিনি বলেন, ৫০ হাজার লিটারের ট্যাংকে ৪০ হাজার তেলাপিয়া মাছ চাষ করেছি। খরচ বাদ দিয়ে আমার এক লাখ টাকার মতো লাভ হবে।
কতদিনে মাছ বিক্রির উপযোগী হয় জানতে চাইলে শাহিনুর রহমান বলেন, মাছ বড় হতে বেশি সময় লাগে না। বিক্রির উপযোগী হতে চার-পাঁচ মাস সময় লাগে।
টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার স্বপন বাড়ির ছাদে ১০ হাজার লিটার ট্যাংকে ৩৬ হাজার তেলাপিয়া মাছের চাষ করেছেন। এরই মধ্যে একবার মাছ বিক্রি করেছেন তিনি।
তিনি বলেন, প্রশিক্ষণ নিয়ে বায়োফ্লক পদ্ধতিতে ভালোভাবে মাছ চাষ করতে পারলে যে কেউ লাভবান হবেন। তবে প্রাথমিক অবস্থায় খরচটা একটু বেশি। তবু লাভজনক এই চাষ পদ্ধতি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে দৌলতপুর উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা খোন্দকার শহিদুর রহমান বলেন, বায়োফ্লক পদ্ধতিতে বেশি ঘনত্বে মাছ চাষ করা সম্ভব। যেখানে খাদ্য খরচ প্রচলিত পদ্ধতির তুলনায় অনেক কম। মাছের উৎপাদন হার পুকুর বা জলাশয়ের চেয়ে অনেক বেশি। তরুণরা প্রশিক্ষণ নিয়ে বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ করতে পারেন।
তিনি বলেন, দৌলতপুরে প্রায় ১০-১২টি বায়োফ্লক মাছের খামার গড়ে উঠেছে। মৎস্য অফিসের পরামর্শ নিয়ে তারা খামার দিয়েছেন। বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ করে দেশে আমিষের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি বেকারত্ব দূর করা সম্ভব।
প্রসঙ্গত, বায়োফ্লক প্রযুক্তিকে মাছ চাষের আধুনিক ও টেকসই এবং পরিবেশবান্ধব পদ্ধতি বলে মনে করা হয়। বায়োফ্লক হলো প্রোটিন সমৃদ্ধ জৈব পদার্থ এবং অণুজীব। যেমন- ডায়াটম, ব্যাকটেরিয়া, প্রোটোজোয়া, অ্যালগি (শেওলা), ফেকাল পিলেট (মাছের মল হতে পারে), জীবদেহের ধ্বংসাবশেষ এবং অন্যান্য অমেরুদণ্ডী প্রাণী ইত্যাদির ম্যাক্রো-অ্যাগ্রিগেট বা সমন্বয়।
নতুন পদ্ধতির এ চাষ দেশে দ্রুত বাড়াতে পারে মাছের উৎপাদন। বাড়ির আঙিনা ও ছাদে ছোট ছোট ট্যাংক বসিয়ে অল্প সময়ে ও স্বল্প খরচে অধিক মাছ উৎপাদন করা যায়।
মাছ চাষের এই পদ্ধতি বাংলাদেশে এসেছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে। এটি এমন একটি পদ্ধতি যেখানে বিশেষ ব্যবস্থাপনায় অল্প জায়গায় বিপুল পরিমাণ মাছ চাষ করা হয়।
তবে সরকারের মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট বলছে, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এটা কতটা সঠিক হবে কিংবা চাষিরা কতটা লাভবান হবেন, তা নিয়ে গবেষণা করছেন তারা।
বায়োফ্লকে মাছের ট্যাংক যেমন হয়:
সাধারণত একটি খাঁচার মতো তৈরি করা হয়, যার নিচের দিকে ঢালাই দিয়ে মাটির সঙ্গে আটকে দেওয়া হয়। এর ঠিক মাঝামাছি জায়গায় পানির পাইপ দেওয়া হয়। অনেকে ঢালাই না করে পলিথিন দিয়েও মেঝের জায়গা প্রস্তুত করা হয়। ওপর থেকে খাঁচাটি ঢেকে দিতে হবে। আর মেঝেতে পুরু পলিথিন দিয়ে পানি রাখতে হবে। পানির তাপমাত্রা ২৪-৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখতে হবে। পানির রং হবে সবুজ, হালকা সবুজ বা বাদামি। এর দ্রবীভূত অক্সিজেন, পিএইচ, ক্ষারত্ব, খরতা, ক্যালসিয়াম, অ্যামোনিয়া, নাইট্রেইট, ফসফরাস, আয়রন, পানির স্বচ্ছতা, গভীরতা, লবণাক্ততা; এগুলোসহ সবকিছুর সুনির্দিষ্ট পরিমাণ মেনে ব্যবস্থা নিতে হয়। এরপর পানিতে দরকারি সব উপাদান ঠিক মতো দিয়ে ফ্লক তৈরি করতে হয়, যার জন্য দরকার হয় সার্বক্ষনিক অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা। ঠিক মতো ফ্লক তৈরি হলে পানির রং হবে সবুজ বা বাদামি, আর পানিতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণা দেখা যাবে।
এএম