দেশীয় অস্ত্র ও কালো রশি নিয়ে রাত গভীর হওয়ার আগেই সড়কে তাদের অবস্থান। সড়কের দুই পাশের গাছে রশি টেনে প্রতিবন্ধকা সৃষ্টি। এরপর সেই রশিতে পথ আটকে ফিল্মি স্টাইলে মোটরসাইকেল আরোহীর সর্বস্ব লুট। 

গত ১১ জুলাই রাত সাড়ে ৯টায় এমন এক দুর্ধর্ষ ছিনতাইয়ের শিকার হয়েছেন নওগাঁর পত্নীতলা উপজেলার সদর ইউনিয়নের নাদৌড় গ্রামের আব্দুল লতিফ।

সেই রাতের লোমহর্ষক বর্ণনায় আব্দুল লতিফ বলেন, প্রতিবেশী এক মামাকে সঙ্গে নিয়ে মোটরসাইকেলে নজিপুর বাজার থেকে বাড়িতে ফিরছিলাম। ফেরার পথে নাপিতপুকুর এলাকায় পৌঁছালে রাস্তার দুই পাশে ফাঁদ পেতে রাখা ছিনতাইকারীদের কবলে পড়তে হয়। এরপর মোটরসাইকেলসহ সর্বস্ব লুট করে নেয় ছিনতাইকারীরা। পরে আমাদের দুজনের হাত পা বেঁধে রাস্তার পাশের জঙ্গলে ফেলে দেওয়া হয়। মুহূর্তের মধ্যেই আরও একটি মোটরসাইকেল আসলে সেটিকেও একইভাবে লুট করা হয়। এ বিষয়ে থানায় অভিযোগ দেওয়ার দুই সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও মোটরসাইকেল উদ্ধারে পুলিশের দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই।

শুধু ফিল্মি কায়দায় ছিনতাই নয়। সীমান্তবর্তী এ উপজেলায় সম্প্রতি বেড়েছে চুরি ও মাদক ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য। উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ফেরি করে প্রকাশ্যে গাঁজা, ইয়াবা, ফেন্সিডিলসহ বিভিন্ন মাদক খুচরা ও পাইকারি দরে বিক্রি করছেন ব্যবসায়ীরা। যা রীতিমতো উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে স্থানীয় সচেতন মহলের। সেখানকার সাম্প্রতিক সময়ের রমরমা মাদক ব্যবসার বেশ কিছু ছবি ও ফুটেজ এসেছে ঢাকা পোস্টের হাতে।

মাঝি উত্তম কুমার ডুবিয়ে রাখা ফেন্সিডিল বের করে বিক্রি করেন

পত্নীতলা উপজেলার কৃষ্ণপুর ইউনিয়ন ঘেঁষে বয়ে যাওয়া আত্রাই নদীর ডাঙ্গাপাড়া খেয়াঘাটে নৌকার মাঝিকে প্রকাশ্যে ফেন্সিডিল বিক্রি করতে দেখা গেছে। ভিডিওতে নৌকার ভেতরে লুকিয়ে রাখা এবং নদীর পানিতে অভিনব কায়দায় ডুবিয়ে রাখা ফেন্সিডিল মাদক সেবনকারীদের কাছে প্রকাশ্যে বিক্রি করতে দেখা যায়। 

মাঝি উত্তম কুমার মানভেদে প্রতি বোতল ফেন্সিডিলের দাম নেন ১ হাজার ৫০০ টাকা থেকে ১ হাজার ৯০০ টাকা। ওই গ্রামের আরেক প্রখ্যাত নারী মাদক ব্যবসায়ী ‘বুলুর বৌ’ নামে বেশ পরিচিত। প্রতিদিন অন্তত অর্ধ শতাধিক ফেন্সিডিলের কারবারের অভিযোগ রয়েছে এই নারীর বিরুদ্ধে। ‘বুলুর বৌ’ এর ফেন্সিডিল বিক্রি ও দরকষাকষির ভিডিও রয়েছে এই প্রতিবেদকের হাতে।

মাদকের বিস্তার রোধে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি হিসেবে কোন পদক্ষেপ নিয়েছেন কি না? জানতে চাইলে কৃষ্ণপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম বলেন, সীমান্তবর্তী উপজেলা হওয়ায় এখানে বরাবরই মাদক ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য বেশি থাকে। উপজেলার শিহাড়া সীমান্ত ও পার্শ্ববর্তী ধামইরহাট উপজেলার আগ্রাদ্বিগুন সীমান্ত মাদক চোরাচালানের নিরাপদ রুট হিসেবে ব্যবহার করেন মাদক ব্যবসায়ীরা। এখানে কাজ করে ৩০-৩৫ জনের সক্রিয় একটি সিন্ডিকেট। ডাঙ্গাপাড়াসহ পুরো উপজেলায় মাদকের বিস্তার রোধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে প্রায়ই মাদক ব্যবসায়ীদের তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করা হয়। নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করলে তাদের দৌরাত্ম্য কমে আসবে।

মাঝি উত্তম কুমার নৌকা চালিয়ে মাদক বিক্রি করছেন

নজিপুর সদর ইউনিয়নের বাবনাবাজ গ্রামের বাসিন্দা সাব্বির ইসলাম বলেন, পুরো উপজেলায় মাকদের অভয়ারণ্যে পরিণত এক গ্রামের নাম ‘বাবনাবাজ’। গাঁজা, ইয়াবাসহ বাংলা মদের পাইকারি ব্যবসা হয় এখানে। ঘরে বসে প্রতিদিন কমপক্ষে ১০-১৬ মণ বাংলা মদ উৎপাদন ও বিপণন করেন এখানকার ব্যবসায়ীরা। তাদের দৌরাত্ম্যে এলাকায় মা-বোনকে নিয়ে টিকে থাকায় দায় হয়ে পড়েছে। মাঝেমধ্যে পুলিশ এসে টাকা খেয়ে চলে যায়। কাউকে আটক করা হয় না। ব্যবসায়ীরাও পুলিশকে টাকা দিয়ে ম্যানেজ করার কথা প্রকাশ্যে বলেন। কয়েক মাস যাবৎ মাদক ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে।

২০২২ সালের ১০ ডিসেম্বর পত্নীতলা থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হিসেবে যোগদান করেন পলাশ চন্দ্র দেব। তার যোগদানের পর থেকেই মাদক ব্যবসায়ীদের থেকে নিয়মিত মাসোহারা নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে থানা পুলিশের বিরুদ্ধে। এতেই উপজেলাজুড়ে মাদক ব্যবসায়ী ও সেবনকারীদের দৌরাত্ম্য বৃদ্ধির পাশাপাশি চুরি ও ছিনতাই উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। 

ফেন্সিডিল ব্যবসায়ী বুলুর বৌ

অভিযোগের বিষয়ে জানতে এই পুলিশ কর্মকর্তার মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেন। এক পর্যায়ে তিনি বলেন, চুরি ও ছিনতাই সংক্রান্ত বিষয়ে এজাহার হলে তাৎক্ষণিক মামলা নেওয়া হয়। ফেরি করে মাদক বিক্রির কোনো তথ্য আমাদের কাছে নেই। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চান না বলে কল কেটে দেন তিনি।

সাম্প্রতিক সময়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির কথা স্বীকার করলেন নওগাঁর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (পত্নীতলা সার্কেল) মো. আব্দুল মমীন। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, ১১টা ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত একটা উপজেলায় দু’একটা চুরি-ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটতেই পারে। ছিনতাইয়ের রহস্য উদঘাটনে অনেকটাই এগিয়েছে পুলিশ। মাদকের কিছু কিছু পয়েন্টে পুলিশ পৌঁছাবার আগেই ব্যবসায়ীরা সটকে পড়েন। এজন্য তাদের গ্রেপ্তার করা কঠিন হয়ে পড়েছে। তবে মাদক ব্যবসায়ীদের আইনের আওতায় আনতে পুলিশের নিয়মিত অভিযান অব্যাহত আছে।

আরমান হোসেন রুমন/এএএ