করোনা সংক্রমণ রোধে মানুষকে সচেতন করছে পুলিশ

করোনা মহামারিতে বিপর্যন্ত জনজীবন। এক বছরেরও বেশি সময় ধরে চলছে এই মহামারি। সাধারণ মানুষকে সুরক্ষিত রাখতে গিয়ে এ পর্যন্ত করোনায় প্রাণ হারিয়েছেন রাজশাহী রেঞ্জ পুলিশের ৯ সদস্য। সংক্রমণ ছড়িয়েছে প্রায় প্রতিটি ইউনিটেই।

এরই মধ্যে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় বিভাগে করোনা শনাক্ত হয়েছে ১০৭ জনের। এর মধ্যে মারা গেছেন পাঁচজন। এই পরিস্থিতিতে করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে ফের মাঠে নেমেছেন পুলিশ সদস্যরা।

তবে এবার পাল্টেছে কৌশল। অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া করোনা পরিস্থিতিতে মানুষকে সচেতন করছে পুলিশ। সুরক্ষা সামগ্রী পৌঁছে দিচ্ছে সাধারণ মানুষের হাতে। তবে এক বছর আগে এই দৃশ্যপট ছিল ভিন্ন। করোনা শনাক্ত হলেই ছেড়ে যাচ্ছিল স্বজনরা। মারা যাওয়ার পর দাফন কিংবা সৎকার করার লোকও পাওয়া যায়নি। এলাকায় মরদেহ দাফনে বাধা দিয়েছে লোকজন।

জনসচেতনতায় মাঠে নেমেছে পুলিশ

এই সংকটকালে পুলিশ পরম বন্ধু হয়ে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ায়। জীবনের মায়া তুচ্ছ করে করোনা আক্রান্তদের হাসপাতালে নিয়ে যায়। করোনায় মারা যাওয়া ব্যক্তিদের মরদেহ দাফনের ব্যবস্থা করে। লকডাউনে থাকা আক্রান্ত পরিবারের ঘরে কাঁধে করে খাবারও পৌঁছে দেয়। রাস্তায় রাস্তায় মাস্কসহ স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রী বিতরণ করে পুলিশ। এমনকি জীবাণুনাশক পানিও ছেটায়। এক কথায় এই দুর্যোগে এক অন্যরকম পুলিশ দেখেছে জনগণ। পুলিশের এই মানবিক আচরণ সব মহলেই প্রশংসিতও হয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, করোনায় দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে এখন পর্যন্ত রাজশাহী রেঞ্জ পুলিশের ৯ জন সদস্য প্রাণ হারিয়েছেন। করোনা ধরা পড়েছে বিভিন্ন পর্যায়ের ৮২৫ জন সদস্যের। এছাড়াও নতুন করে করোনা সংক্রমণ নিয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন পাঁচজন। 

সংক্রমণ ধরা পড়ায় কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়েছে তিনজনকে। যদিও এ পর্যন্ত বিভাগের আট জেলা পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটের ৫ হাজার ৮১৬ জন সদস্যের নমুনা পরীক্ষা হয়।

রাস্তায় রাস্তায় মাস্কসহ স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রী বিতরণ

মহামারি ছড়িয়ে পড়ার পর থেকেই বিভাগে করোনার হট স্পট হিসেবে চিহ্নিত হয় বগুড়া। করোনা মোকাবেলায় নেমে আক্রান্ত হয়েছেন এই জেলার ১৬৯ পুলিশ সদস্য। এর মধ্যে মারা গেছেন একজন। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১৪০ জন পুলিশ সদস্যের করোনা ধরা পড়েছে রাজশাহীতে। এই জেলায় দুই পুলিশ সদস্যের প্রাণ নিয়েছে করোনা। 

সিরাজগঞ্জ জেলা পুলিশের ১৩৮ জন সদস্যের করোনা শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে মারা গেছেন একজন। নাটোরে করোনায় মারা গেছেন দুই পুলিশ সদস্য। এই জেলায় ১১১ পুলিশ সদস্যের করোনা ধরা পড়ে।

এছাড়াও নওগাঁয় ৯৫ জন, জয়পুরহাটে ৫৪ জন, পাবনায় ৪৪ জন, চাঁপাইনবাবগঞ্জে ২৪ জন, আরআরএফ-এ ৪০ জন, রেঞ্জ সদর দফতরে ১১ জন পুলিশ সদস্যের করোনা শনাক্ত হয়। এর মধ্যে রেঞ্জ সদর দফতর ও পাবনা জেলা বাদে অন্যান্য  প্রত্যেক জেলা ও আরআরএফ-এ একজন করে করোনায় প্রাণ হারিয়েছেন।

রাজশাহী রেঞ্জ পুলিশ সূত্রে জানা গেছে,  সম্মুখযোদ্ধা ৪৪২ কনস্টেবলের করোনা ধরা পড়েছে এই আট জেলায়। এর মধ্যে ৪০২ জন পুরুষ এবং ৪০ জন নারী কনস্টেবল। ১৫৫ জন এসআই, সার্জেন্ট ও টিএসআইয়ের করোনা ধরা পড়ে। দায়িত্ব পালনে গিয়ে করোনা আক্রান্ত হন ১১৯ জন এএসআই ও এটিএসআই। 

এছাড়াও ৪৩ জন পরিদর্শক, ২৬ জন নায়েক, সাতজন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, ছয়জন সহকারী পুলিশ সুপার, চারজন পুলিশ সুপারের করোনা শনাক্ত হয়। তাদের সেবা দিতে দিয়ে করোনা ধরা পড়ে রেঞ্জ পুলিশের ৩৫ জন সিভিল স্টাফের।
 
এ বিষয়ে রাজশাহী রেঞ্জ পুলিশের সহকারী পুলিশ সুপার (মিডিয়া ও আইসিটি) সাকিব হোসাইন বলেন, করোনাকালে সবচেয়ে কম জনবলে বেশি সেবা দেওয়ার কৌশল নিয়ে পুলিশ কাজ করছিল। কিন্তু এখন নতুন করে করোনার ঢেউ আসছে। ফলে নতুন করে পরিকল্পনা সাজানো হচ্ছে। বিশেষ করে পেট্রোলিং টিমকে সাধারণ মানুষের সংস্পর্শে না গিয়ে সেবা দেয়ার কথা বলা হচ্ছে। মাস্ক পরতে সাধারণ মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে জোর দেওয়া হচ্ছে।
 

করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে ফের মাঠে নেমেছেন পুলিশ সদস্যরা

তিনি বলেন, চিকিৎসার জন্য জেলা পর্যায়ের পুলিশ হাসপাতাল আগে থেকেই চালু রয়েছে। নতুন করে পুলিশ সদর দফতর থেকে কিছু ওষুধ পাঠানো হয়েছে। তাছাড়া বিষয়টি যেহেতু পুরোনো হয়ে গেছে, তাই ব্যবস্থাপনায় কোনো ঘাটতি থাকবে না।

সাকিব হোসাইন বলেন, পুলিশ করোনায় প্রাণ হারানো সদস্যদের পরিবারের পাশে রয়েছে। প্রত্যেকটি পরিবারকে পুলিশ মহাপরিদর্শকের পক্ষ থেকে নানাভাবে সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। সরকারি সহায়তা দেওয়ার কথা থাকলেও এখনো মেলেনি। তবে বিভিন্ন ইউনিট প্রধান নিজস্ব উদ্যোগে সহায়তা দিচ্ছেন। আক্রান্তরাও নানাভাবে সহায়তা পাচ্ছেন। 

বিভাগীয় স্বাস্থ্য দফতরের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, রাজশাহী বিভাগে করোনা সংক্রমণ ফের বাড়তে শুরু করেছে। গত ২৪ ঘণ্টায় রাজশাহী বিভাগের আট জেলায় করোনায় প্রাণ হারিয়েছেন পাঁচজন। এই পাঁচজনই বগুড়ার বাসিন্দা। এই একদিনে বিভাগজুড়ে করোনা শনাক্ত হয়েছে ১০৭ জনের। এর মধ্যে ৫০ জন বগুড়া জেলার বাসিন্দা। 

নতুন করে রাজশাহীতে ২৭ জন, পাবনায় ১৪ জন, নাটোরে ১১ জন, সিরাজগঞ্জে তিনজন, নওগাঁ ও জয়পুরহাটে একজন করে করোনা আক্রান্ত হয়েছে। তবে এই সাত জেলায় নতুন করে করোনায় প্রাণহানির খবর নেই। গত ২৪ ঘণ্টায় করোনা জয় করেছেন বিভাগের ২৭ জন। তবে করোনা হাসপাতালে এসেছেন তিনজন। 

এ পর্যন্ত রাজশাহী বিভাগে ২৬ হাজার ৫৯৯ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে প্রাণ হারিয়েছেন ৪০৮ জন। বিভাগজুড়ে এ পর্যন্ত করোনা জয় করেছেন ২৪ হাজার ৭৩২ জন।

ফেরদৌস সিদ্দিকী/আরএআর