পদ্মা সেতুর এক বছরে বদলে গেছে গোপালগঞ্জের চিত্র
পদ্মা সেতু উদ্বোধনের এক বছর পূর্ণ হলো রোববার (২৫ জুন)। গত বছর এদিনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতু উদ্বোধন করেন। পরদিন ২৬ জুন সকাল থেকে যান চলাচলের জন্য সেতুটি উন্মুক্ত করা হয়। এরপর থেকে দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটতে শুরু করে। এই ২১ জেলার মধ্যে অন্যতম গোপালগঞ্জ। এই সেতু যোগাযোগ ব্যবস্থায় এনেছে আমূল-পরিবর্তন। বদলে গিয়েছে জেলার চিত্র।
পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর থেকে এ জেলার মানুষ অর্থনৈতিকভাবে আরও সমৃদ্ধশালী হচ্ছে। সহজ হয়েছে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের সঙ্গে গোপালগঞ্জ জেলার যোগাযোগ ব্যবস্থা। পিছিয়ে পড়া এই জেলা ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে আরও মনোযোগ বাড়িয়েছে, গড়ে উঠছে নতুন নতুন শিল্প কলকারখানা। অর্থনীতির চাকা ঘোরার পাশাপাশি বাড়ছে বেকারদের কর্মসংস্থান।
বিজ্ঞাপন
পদ্মা সেতু শুধু যোগাযোগব্যবস্থা সহজ করছে না, এতে শিক্ষা, কৃষি, মৎস্য, জরুরি স্বাস্থ্যসেবা ও শিল্প পর্যটনসহ বেশ কিছু খাতে অর্থনৈতিক উপযোগও সৃষ্টি হচ্ছে।
কৃষি
গোপালগঞ্জ জেলাকে অর্থনৈতিকভাবে সবচেয়ে সমৃদ্ধ করেছে কৃষিখাত। জেলার প্রায় দেড়লাখ হেক্টর জমিতে কৃষকেরা নানান ফসল উৎপাদন করে। এর মধ্যে ব্যতিক্রম সবজি। একসময় পদ্মা সেতু ছিল না। ফেরি পারাপারের বিড়ম্বনায় ফেরিঘাটেই পচে যেত সবজি। ফলে বড় ধরনের লোকসান গুনতে হতো কৃষকদের।
পদ্মা সেতুর কারণে যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হওয়ায় কৃষকদের নিজস্ব ক্ষেতে উৎপাদিত কৃষিপণ্য এ জেলার চাহিদা মিটিয়ে পৌঁছে যাচ্ছে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। এতে কৃষকেরা তাদের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে। এছাড়া সবজি চাষে বিনিয়োগও বাড়িয়েছে এ জেলার কৃষকেরা।
এ বিষয়ে সদর উপজেলার রঘুনাথপুর গ্রামের কৃষক আবদুল মতিন মিয়া বলেন, আমি প্রায় পঞ্চাশ বিঘা জমিতে বছরের ১২মাস বিভিন্ন শাকসবজি চাষ করি। এ জেলা ছাড়া বাইরে বিক্রি করতে পারতাম না। তাই ন্যায্যমূল্যও পেতাম না। পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় রাজধানী ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হয়েছে। ফেরীঘাটের ভোগান্তি ছাড়াই সরাসরি সবজি নিয়ে সময়মতো ঢাকায় পৌঁছতে পারছি। কষ্ট করে ফলানো সবজির ন্যায্যমূল্য পাচ্ছি।
স্বাস্থ্য
পদ্মা সেতু গোপালগঞ্জের স্বাস্থ্যখাতে বড় ভূমিকা রাখছে। আগে এ জেলায় রাজধানী ঢাকা থেকে কোন চিকিৎসক আসতেন না। রোগীদের উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় নেওয়ার সময় ফেরিঘাটে সময় ব্যয় হওয়ার জন্য বেশিরভাগ রোগী ফেরিঘাটেই মারা যেতেন। পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় এ জেলার মানুষ ভোগান্তি ছাড়াই অল্প সময়ে ঢাকা পৌঁছাতে পারছে। ঢাকায় গিয়েও নিতে পারছেন জরুরি স্বাস্থ্যসেবা। এছাড়া বাইরে থেকেও ডাক্তার আসছে এ জেলায়।
গোপালগঞ্জের সিভিল সার্জন ডা. নিয়াজ মাহমুদ বলেন, পদ্মা সেতু চালু হওয়ার ফলে রাজধানী ঢাকার সঙ্গে গোপালগঞ্জের যোগাযোগ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন হয়েছে। পদ্মা সেতু না থাকায় ঢাকার অনেক বড় বড় চিকিৎসক আমাদের জেলায় আসতে চাইতেন না। পদ্মা সেতু খুলে দেওয়ার পর চিকিৎসাক্ষেত্রে অনেক পরিবর্তন দেখছি। ভালো চিকিৎসক এ জেলায় এসে মানুষকে চিকিৎসা দিতে পারছে। অনেক সময় নদী পার হতে গিয়ে রোগী মারা যেত। জরুরি ওষুধ আনতে অনেক সময় লাগত। ওষুধের জন্য অনেক রোগী মারা যেত। পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় ওষুধ, চিকিৎসকসহ আর কোন সমস্যা হচ্ছে না।
পর্যটন
পদ্মা সেতু গোপালগঞ্জের পর্যটন খাতে অর্থনৈতিকভাবে বড় ভূমিকা রাখছে। এ জেলায় রয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধিস্থল, উলপুর জমিদার বাড়িসহ বেশ কিছু পর্যটনস্পট। ইতোমধ্যে জাতির পিতার সমাধিস্থলকে ঘিরে তৈরি করা হয়েছে স্থাপত্য শৈলীর নানান নিদর্শন। আর চোখ জুড়ানো বিস্তীর্ণ সবুজের মাঠ। এ সমাধিস্থলকে ঘিরে সারা বছর পর্যটকদের ভিড় এমনিতে লেগে থাকতো। পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর থেকে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আরও বেশি পর্যটক আসছে বঙ্গবন্ধুর সমাধি সৌধ কমপ্লেক্সে। এর ফলে এ জেলার পর্যটন শিল্প আরো বিকশিত হয়েছে। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু ও টুঙ্গিপাড়াকে নিয়ে বিশ্বমানের গবেষকরা গবেষণায় আগ্রহী হচ্ছেন।
শিক্ষা
গোপালগঞ্জ জেলায় দুটি বিশ্ববিদ্যালয়সহ বেশ কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। পদ্মা সেতুর কারণে যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হওয়ায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মেধাবী শিক্ষার্থীরা এসব প্রতিষ্ঠানে ভর্তির জন্য আগ্রহী হচ্ছেন।
এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজিএমই বিভাগের সহকারী প্রভাষক ইমদাদুল হক সোহাগ বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে একইসঙ্গে জ্ঞান বিতরণ এবং জ্ঞান সৃষ্টির জায়গা। জ্ঞান সৃষ্টির জন্য প্রথমত যে জিনিসটা প্রয়োজন সেটা হচ্ছে বিশ্বমানের গবেষক। পদ্মা সেতু চালু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জাতির জনকের পুণ্যভূমি গোপালগঞ্জ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি বিশ্ব মানের গবেষকরা আরো আকৃষ্ট হচ্ছেন। সেই সঙ্গে মেধাবী শিক্ষার্থীরাও এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছেন।
শেখ সায়েরা খাতুন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান বলেন, পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হওয়ায় এ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের শিক্ষার্থীরা আগ্রহী হচ্ছেন।
শিল্প কলকারখানা
পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীরা এ জেলায় বিনিয়োগে আকৃষ্ট হচ্ছেন। এ জেলায় গড়ে উঠছে বিভিন্ন শিল্প কলকারখানা। এতে জেলার বেকারদের কর্মসংস্থান হচ্ছে। ভাগ্যের পরিবর্তন হচ্ছে।
কর্মসংস্থান
পদ্মা সেতুকে ঘিরে এ জেলায় তৈরি করা বিশাল বিশাল সরকারি-বেসরকারি স্থাপনার কাজ প্রায় শেষ। এর পাশাপাশি বিনিয়োগ হচ্ছে বেসরকারি খাতে। নির্মাণ করা হচ্ছে বেসরকারি শিল্প কলকারখানাও। যা এখন শুধু উদ্বোধনের অপেক্ষায়। এ সব চালু হলে এ জেলার অর্থনীতিতে বড় পরিবর্তন আনবে। কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে হাজারো বেকারের।
আশিক জামান/এমজে