নিহত আব্দুল নবীর ভাই ও মা

দালালের মাধ্যমে লিবিয়া হয়ে সমুদ্র পথে ইতালি যাওয়ার সময় ভূমধ্যসাগরে ডুবে নরসিংদীর এক যুবকের মৃত্যু হয়েছে। আরও ৯ জন যুবক নিখোঁজ রয়েছেন বলে খবর পাওয়া গেছে। তারা সবাই নরসিংদীর বিভিন্ন উপজেলার বাসিন্দা। 

এদের মধ্যে নিহত যুবকের নাম আব্দুল নবী (৩০)। তিনি রায়পুরা উপজেলার উত্তর বাখরনগর ইউনিয়নের  বড়চর গ্রামের মৃত হযরত আলীর ছোট ছেলে। 

শুক্রবার (২৩ জুন) সন্ধ্যায় ঢাকা পোস্টকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন উত্তরবাখরনগর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হাবিবুল্লাহ হাবিব।

জানা গেছে, নিখোঁজদের মধ্যে আটজনের বাড়ি পার্শ্ববর্তী বেলাবো উপজেলার টান লক্ষ্মীপুর, চর লক্ষ্মীপুর ও জালালাবাদ গ্রামে। স্থানীয়রা আটজন নিখোঁজের কথা বললেও পরিচয় মিলেছে ছয়জনের।

তারা হলেন- বেলাবো উপজেলার টান লক্ষ্মীপুর ও চর লক্ষ্মীপুর এলাকার বিল্লাল মিয়ার ছেলে সৈকত (২০), রহিম মিয়ার ছেলে আবু তাহের (২৭),  রতন মিয়ার ছেলে জহিরুল ইসলাম (১৯), আউয়াল মিয়ার ছেলে উজ্জল (১৮), ওবায়দুল্লাহর ছেলে রহমত উল্লাহ (২০) ও মোক্তার হোসেনের ছেলে জিহাদ (১৯)। এছাড়া কুলিয়ারচর উপজেলার বড় ছয়সুতি এলাকার বাছেদ মিয়ার ছেলে স্বপন (২৭) নামেও একজন নিখোঁজের খবর পাওয়া গেছে। তারা ১০ থেকে ১২ লাখ টাকা খরচ করে দালাল চক্রের মাধ্যমে অবৈধভাবে ইতালি যাওয়ার উদ্দেশ্যে দেশ ছাড়েন।

শুক্রবার (২৩ জুন) দুপুরে নিহত আব্দুল নবীর বাড়িতে গেলে তার ভাই শাহ আলম ও মা পরিষ্কার বেগম সাংবাদিকদের জানান, আব্দুল নবী এর আগে ৫ বছর সৌদিতে ছিলেন। সৌদি থেকে দেশে ফিরে চার মাস আগে তিনি দালাল চক্রের মাধ্যমে লিবিয়া হয়ে ইতালি পাড়ি দেওয়ার উদ্দেশ্যে দেশ ছাড়েন। এক মাস আগে পরিবারের সঙ্গে শেষ যোগাযোগ হয়েছিল আব্দুল নবীর। এরপর আর তার সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। গতকাল বৃহস্পতিবার (২২ জুন) রাত আনুমানিক ৯টার দিকে খবর আসে আব্দুল নবীর মরদেহ পাওয়া গেছে।

একই চিত্র বেলাবো উপজেলায়। সেখানে গিয়ে নিখোঁজ যুবকদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, লিবিয়া থেকে সমুদ্র পথে ইতালি যাওয়ার সময় তাদের সঙ্গে বাবা-মায়ের শেষ কথা হয় প্রায় এক মাস আগে। তখন তারা পরিবারকে জানিয়েছিল গেম ঘর নামে একটি স্থানে তাদের নেওয়া হচ্ছে। এরপর অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেও কথা বলতে পারেনি। তাদের সন্তান জীবিত আছে নাকি মারা গেছে, এ নিয়ে বাবা-মা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। 

এদিকে লিবিয়া হয়ে ইতালি যাওয়ার পথে ভূমধ্যসাগরে নিখোঁজ হওয়ার খবরে দালাল আলমের বাড়িতে আহাজারি করছেন নিখোঁজদের স্বজনরা। এমন খবরে সেখানে ভিড় জমিয়েছে আশপাশের কয়েকটি গ্রামের লোকজন। দালাল চক্রের সদস্য আলম বেলাবো উপজেলার টান লক্ষ্মীপুর এলাকার মনা মিয়ার ছেলে। 

নিহত আব্দুল নবীর বড় ভাই শাহ আলম জানান, এর আগেও তারা ইতালি যাওয়ার পথে ৮-১০ কিলোমিটার যেতে না যেতেই বোট ফেটে যাওয়ায় ভয়ে ফিরে আসে। পরে দালালের বাবার সঙ্গে গ্রাম্য সালিসে বসে আমাদের পাসপোর্ট ফেরত দিতে বলি। কিন্তু তিনি (দালাল) দেননি। জোড় করে তিনি লোকগুলোকে নিয়ে যান। 

কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচর উপজেলার বরতেরশতী গ্রামের নিখোঁজ স্বপন মিয়ার বোন আলেহা বেগম ঢাকা পোস্টকে জানান, ২২ মে বড় ভাই শেষ কথা বলেছিলেন। তারপর থেকে আর কোনো যোগাযোগ নেই। বেলাবো উপজেলার আলম নামে এক দালাল ১০ লাখ টাকার বিনিময়ে লিবিয়া থেকে ইতালি নিয়ে যাবে বলে আমার ভাইকে নিয়ে যান। এখন দালালের ফোনে কল দিলে তা বন্ধ পাওয়া যায়। তবে দালাল আলমের পরিবারের লোকজনের সঙ্গে কথা বলার পর তারা বলেছে- দালালও নাকি ইতালি যাওয়ার জন্য যে বোট ছেড়েছিল সেখানে ছিল। এখন নাকি সেও নিখোঁজ। যতদূর শুনেছি সেই বোটে ২৮ জন যাত্রী ছিল। তারা সকলেই কুলিয়ারচর, কিশোরগঞ্জ ও নরসিংদী জেলার বিভিন্ন উপজেলার বাসিন্দা।

তিনি বলেন, বেশ কিছুদিন আগে ভাইসহ অনেকেই এভাবে ইতালি যাবে না বলায় আলমের বাড়িতে সেখানকার স্থানীয় ইউপি সদস্যকে নিয়ে দরবার করা হয়েছিল। তবে দালালের কাছে টাকা দেওয়ায় আমরা জিম্মি ছিলাম। পরে সেখানে দালালের বাবা তার ছেলের সঙ্গে কথা বলবেন বলে পাঁচদিনের সময় চান। পরে সে সময় পার হওয়ার তিন দিনের মাথায় খবর পেলাম তারা লিবিয়া থেকে ইতালির উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছেন।

বেলাবো উপজেলার নারায়ণপুর ইউনিয়নের ১ নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য আমির হোসেন দরবার (বৈঠক) হয়েছিল স্বীকার করে ঢাকা পোস্টকে জানান, যারা যাত্রী ছিল তাদের স্বজনদের দাবি ছিল তারা কেউই লিবিয়া থেকে ইতালি যাবে না। তাই তারা তাদের টাকা ফেরত চেয়েছিল। সেখানে দালাল আলমের বাবা মননাফ মিয়া ছেলের সঙ্গে কথা বলে জানানোর জন্য ৪-৫ দিনের সময় চান। পরে সেখানে থাকা সকলের সম্মতিতে তাকে সেই সময়টা দেওয়া হয়। পরে তার ঠিক তিন দিনের মাথায় খবর পেয়েছি দালাল আলমসহ লিবিয়া থেকে ইতালির উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছে। তারপর থেকেই তাদের কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। তবে খবর পেয়েছি সেই বোটে বিভিন্ন স্থানের ২৮ জন যাত্রী ছিল। সবাই আলমের লোক নয়। আলমের ৮-১০ জন লোক ছিল। 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে নরসিংদীর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) অনির্বাণ চৌধুরী বলেন, বিষয়টি আমরাও কিছুটা শুনেছি, তবে পুরোপুরি ক্লিয়ার না। আমরা বিষয়টি আরও ভালোভাবে জানার জন্য সেখানে পুলিশ পাঠিয়ে খোঁজ নিচ্ছি।

আরএআর