ধানে সমৃদ্ধ উত্তরের জেলা নওগাঁ এখন আমেও সমৃদ্ধ। স্বাদের দিক থেকে সেরা হওয়ায় দেশ-বিদেশে এ অঞ্চলের আম ব্যাপক সুনাম কুড়িয়েছে। দুই সপ্তাহ যাবত জমে উঠেছে জেলার সবকটি আমের বাজার। যেখানে দুই হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য হবে বলে আশা কৃষি বিভাগের। তবে সবচেয়ে বেশি সাড়া ফেলেছে ফ্রুট ব্যাগিং পদ্ধতিতে উৎপাদিত নিরাপদ আম। 

এ মৌসুমে জেলায় উৎপাদিত ২৫০ কোটি টাকার নিরাপদ আমের চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে দেশীয় সুপারশপ ও বিদেশে। এতে লাভবান হচ্ছেন আম চাষিরা। এ বাণিজ্যের প্রসার ঘটাতে জেলায় আম কেন্দ্রিক সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান নির্মাণের দাবি জানিয়েছেন তারা।

কৃষি বিভাগের তথ্য মতে, এ বছর জেলার ১১টি উপজেলায় ৩০ হাজার হেক্টর জমিতে আম্রপালি, নাক ফজলি, ল্যাংড়া বা হাড়িভাঙ্গা, ক্ষিরশাপাতি, বারি-৪, ব্যানানা ম্যাংগোসহ দেশি-বিদেশি ১৬টি জাতের আম চাষ করেছেন চাষিরা। যেখানে সবচেয়ে বেশি চাষ হয়েছে আম্রপালি আম। এ মৌসুমে জেলায় আম্রপালি আমের বাগানের পরিমাণ ১৮ হাজার ৩১৩ দশমিক ৫ হেক্টর। ৩০ হাজার হেক্টর বাগান থেকে এ মৌসুমে ৩ লাখ ৭৮ টন আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে কৃষি বিভাগ। 

এর মধ্যে ১ কোটি ২০ লাখ পিস আম ফ্রুট ব্যাগিং করা হয়েছে। যার পরিমাণ প্রায় ৩ হাজার টন। এর মধ্যে এ বছর ৪৫০ টন আম বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করা হবে। 

১০ বছর আগেও এ জেলায় এতো আমের বাগান ছিল না। ২০১৪ সালে জেলায় ৯ হাজার ৪৮০ হেক্টর জমি থেকে ১ লাখ ১৩ হাজার ৫২২ টন আম উৎপাদিত হয়েছিল। সেই হিসেবে ১০ বছরের ব্যবধানে জেলায় আমের বাগান বেড়েছে তিনগুণ। গত ২২ মে গুটি আম পাড়ার মধ্য দিয়ে নওগাঁয় সরকারিভাবে আম সংগ্রহ শুরু হয়। এরপর ২৮ মে গোপালভোগ, ২ জুন ক্ষিরশাপাতি বা হিমসাগর, ৭ জুন নাক ফজলি এবং ১০ জুন ল্যাংড়া/হাড়িভাঙ্গা আম বাজারে আসে। এছাড়া আগামী ২০ জুন ফজলি, ২২ জুন আম্রপালি এবং ৮ জুলাই আশ্বিনা, বারি-৪, গৌরমতি ও কাটিমন আম বাজারে আসার কথা থাকলেও তীব্র গরমের কারণে আম্রপালি আম নির্ধারিত সময়ের আগেই বাজারে উঠেছে।

সরেজমিনে জেলার বৃহত্তর আমের হাট সাপাহারে গিয়ে দেখা যায়, গত ২ সপ্তাহ যাবত সব ধরনের আমের সরবরাহ বাড়তে শুরু করেছে। বর্তমানে এই হাটে মানভেদে প্রতি মণ ল্যাংড়া আম ১ হাজার ২০০ টাকা থেকে ১ হাজার ৬০০ টাকা, ক্ষিরশাপাতি বা হিমসাগর আম ১ হাজার ৮০০ টাকা থেকে ২ হাজার ৪০০ টাকা, নাক ফজলি আম ১ হাজার ৪০০ টাকা থেকে ১ হাজার ৮০০ টাকা এবং আম্রপালি আম ২ হাজার টাকা থেকে ৩ হাজার টাকায় কেনাবেচা হচ্ছে। এই চারটি জাতের আমের মধ্যে আম্রপালি জাতের আমের সরবরাহ এবং চাহিদা বর্তমানে সবচেয়ে বেশি। সকাল থেকে বিকেল অবধি আড়তগুলোতে পুরোদমে চলছে আম বেঁচা-কেনা। 

আম সংগ্রহ ও প্যাকেটজাত করাকে কেন্দ্র করে এবার কর্মস্থান হয়েছে হাজারো মৌসুমী বেকার শ্রমিকদের। প্রতিদিন তারা আয় করছেন কমপক্ষে চার লাখ টাকা। এতে যুক্ত হয়েছে স্কুল-কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীরাও। আমের ক্যারেট, পুরোনো পত্রিকা, বিভিন্ন প্যাকেট বিক্রিকে কেন্দ্র করেও কোটি টাকার ব্যবসায় মেতেছেন অনেকেই। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে ব্যবসায়ীরা এসে প্রতিদিন সাপাহার থেকে ২২ হাজার ৫০০ মণ থেকে ৩ হাজার মণ আম কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। যেখানে একটি উপজেলার মাত্র ৩০ থেকে ৩৫টি আড়ত থেকেই প্রতিদিনের বাণিজ্যের পরিমাণ সাড়ে ৪ কোটি টাকা থেকে ৬ কোটি টাকা। সাপাহার থেকে কেনা এসব আম প্রতিদিন ১৫০ থেকে ২০০টি ট্রাকে করে দেশের বিভিন্ন জেলায় নিয়ে যাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা।

পত্নীতলা উপজেলার নির্মইল ইউনিয়নের আমচাষি মাসুদ রানা বলেন, ৩৩ বিঘা জমিতে আম্রপালি ও বারি-৪ জাতের আমের বাগান করেছিলাম। এর মধ্যে এ মৌসুমে ২৪ বিঘায় ফল এসেছে। যেখানে ১০০ টনের বেশি আম পরিপক্ক হয়েছে। ১ সপ্তাহ যাবত স্বল্প পরিসরে আম নামানো হচ্ছে। আম্রপালি ১ হাজার ৮০০ টাকা থেকে ৩ হাজার ৫০০ টাকা মণ করে বিক্রি বিক্রি করছি। এ বছর কমপক্ষে ৭০ লাখ টাকার আম বিক্রি করতে পারবো বলে আশাবাদী।

পোরশা উপজেলার তেঁতুলিয়া ইউনিয়নের ইসলামপুর মাদ্রাসা গ্রামের আমচাষি জোনায়েদ শাহ বলেন, ১০ বিঘা জমিতে গৌরমতি জাতের বাগান করেছিলাম। অতিরিক্ত খরায় কিছু আম ঝড়ে পড়েছে। তবে যেটুকু আম আছে সেটা পরিপক্ব হতে আরও এক মাস সময় লেগে যাবে। এর মধ্যে ৪ বিঘায় প্রায় ৩০ হাজার পিস আম ফ্রুট ব্যাগিং করা হয়েছে। ফ্রুট ব্যাগিং করায় কীটনাশকের খরচ কম পড়ছে। দেশের বিভিন্ন সুপারশপের সঙ্গে আলোচনা চলছে। প্রতি কেজি আম এবার কমপক্ষে ১০০ টাকা কেজি দরে সুপারশপে বিক্রি করতে পারবো বলে আশা করছি। আমে সম্পৃদ্ধ জেলায় আম কেন্দ্রিক সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান নির্মাণের দাবি জানান তিনি।

মান্দা উপজেলার মৈনম ইউনিয়নের দুর্গাপুর গ্রামের আমচাষি রফিকুল ইসলাম বলেন, বিদেশে আম আম রপ্তানির আগে কয়েকটি ধাপ অনুসরণ করতে হয়। আমে যাতে ব্যাকটেরিয়া আক্রমণ করতে না পারে, সেজন্য প্রথমে ফ্রুট ব্যাগিং বা ওয়াটার প্রুফ কাগজ দিয়ে প্রতিটি আমের শরীর জড়িয়ে দেওয়া হয়। বাগান থেকে আম রপ্তানির ১৫ দিন আগে থেকে গাছে কীটনাশক স্প্রে সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দিতে হয়। এরপর আম পেড়ে বিশেষ প্রক্রিয়ায় মোড়কজাত করা হয়। এতে আম নিরাপদ হওয়ার পাশাপাশি আমের গায়ের রং সুন্দর ও আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। আমার ৪ বিঘা বাগানে আম্রপালি ও বারী-৪ জাতের প্রায় ১৬০ মণ রপ্তানিযোগ্য আম রয়েছে। দেশীয় সুপারশপ এবং বিদেশে কমপক্ষে সাড়ে ৫ লাখ টাকায় এসব আম বিক্রি করতে পারবো বলে আশা করছি।

সাপাহার উপজেলার বরেন্দ্র অ্যাগ্রো পার্কের মাালিক তরুণ কৃষি উদ্যোক্তা সোহেল রানা বলেন, নিরাপদ আমে খরচ কিছুটা বেশি হলেও লাভজনক। ফ্রুট ব্যাগিং করা আম দেরিতে পরিপক্ব হওয়ায় বাজারে ভালো দাম পাওয়া যায়। প্রতি বছর সুপারশপে নিরাপদ আমের চাহিদা বেড়েই চলেছে। আমার ১৫০ বিঘা বাগানে এ বছর প্রায় ২৫০ টন আম আছে। এর মধ্যে ২০০ টন আম স্থানীয় বাজারে বিক্রি করে বাকি ৫০ টন নিরাপদ আম দেশীয় সুপারশপ ও বিদেশে রপ্তানি করতে পারবো। সুপারশপ ও বিদেশে রপ্তানিকে কেন্দ্র করে এ বছর জেলায় কমপক্ষে ২৫০ কোটি টাকার নিরাপদ আম ফ্রুট ব্যাগিং করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।

দেশীয় আম রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান গো ফোর বাংলাদেশের সমন্বয়ক তৌফিক ফেরদৌস বলেন, গণমাধ্যমের সূত্র ধরে নওগাঁর আমের গুণাগুণ সম্পর্কে জেনেছিলাম। সেখানকার আম অনেক সুস্বাদু হওয়ায় স্থানীয় চাষিদের থেকে নিরপদ আম সংগ্রহের জন্য এ বছর উদ্যোগ নিয়েছি। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে ইতালিতে দেড় টন আম্রপালি আম রপ্তানি করা হবে। নওগাঁ থেকে এই আম সংগ্রহ করা হবে। এ মৌসুমে ইতালিতে রপ্তানির জন্য কমপক্ষে ২০ টন আম নওগাঁ থেকে সংগ্রহের লক্ষ্য রেখেছি।

নওগাঁ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আবুল কালাম আজাদ বলেন, এ অঞ্চলের মাটি ও জলবায়ুর বিশেষত্বের কারণে দেশের অন্য অঞ্চলের তুলনায় নওগাঁর আম অনেক সুস্বাদু হয়। যেটাকে নিজেদের ভাগ্য বদলের চাবিকাঠি হিসেবে নিয়েছেন স্থানীয় চাষিরা। বাহিরের জেলাগুলোতে যখন আমের মৌসুম শেষের পথে তখনো এখানে প্রচুর পরিমাণে আম্রপালি আম পাওয়া যায়। আগস্টে ১০ হাজার টাকা থেকে ১৫ হাজার টাকায় এসব আম বিক্রি হয়। এ জন্য প্রতি বছর জেলায় আমের বাগান উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে। এ মৌসুমে জেলায় কমপক্ষে ২ হাজার কোটি টাকার আম কেনাবেচা হবে বলে আশাবাদী তিনি।

তিনি বলেন, স্বাদে সেরা হওয়ায় দেশীয় সুপারশপে নওগাঁর নিরপদ আম ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। এ বছর ৪৫০ মেট্রিক টন আম রপ্তানি হবে। ১ কোটি ২০ লাখ নিরাপদ আম ফ্রুট ব্যাগিং করা হয়েছে। এসব আম দেশীয় সুপারশপসহ বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করে কোটি টাকা আয় করবেন চাষিরা। নিরাপদ আম উৎপাদনে চাষিদের আগ্রহ বাড়াতে রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদন প্রকল্পে ফ্রুট ব্যাগিংয়ের ব্যাগসহ বিভিন্ন প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদান করা হয়েছে চাষিদের। জেলায় কেন্দ্রীয় প্যাকিং হাউস নির্মাণে কৃষি বিভাগের পরিকল্পনা রয়েছে। যা আগামীতে চাষিদের নিরাপদ আম উৎপাদনে আরও আগ্রহী করে তুলবে।

আরমান হোসেন রুমন/আরএআর