ট্রেন দুর্ঘটনা রুখতে চার শিক্ষার্থী উদ্ভাবন করেছে অ্যাডভান্স রেলগেট সিস্টেম। ট্রেন আসার আগে রেলক্রসিংয়ের ব্যারিয়ার স্বয়ংক্রিয়ভাবে পড়বে এবং উঠবে, এর জন্য প্রয়োজন হবে না গেটম্যানের। রোববার (২১ মে) জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও রংপুর বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয় আয়োজিত বিভাগীয় উদ্ভাবনী মেলায় এটি প্রদর্শন করা হয়।

আজমাইন আরাফাত সামি, রাজিন শাহরিয়ার, রায়হান আল নাফি ও মোস্তাকিম সাম্য এটি উদ্ভাবন করেছে। তারা গাইবান্ধা সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। ডিজিটাল উদ্ভাবনী মেলায় মাধ্যমিক পর্যায়ে  ব্যাপক সাড়া ফেলেছে তাদের উদ্ভাবিত প্রজেক্টটি। গেটম্যান ছাড়াই রেলক্রসিংয়ে নিরাপদ পারাপারে ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের এই উদ্ভাবন মেলায় আসা দর্শনার্থীদের কাছে টানছে। চতুর্থ শিল্প প্রযুক্তির ব্যবহারে ট্রেন দুর্ঘটনার শঙ্কা থাকবে না বলে দাবি উদ্ভাবকদের।

প্রজেক্টের দলনেতা আজমাইন আরাফাত সামি জানায়, দেশে প্রতিনিয়ত রেলক্রসিংয়ে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনা দেখে তা প্রতিরোধে নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনের উদ্যোগ নেয় তারা। এরপর প্রয়োজনীয় বিভিন্ন ইলেক্ট্রনিক কিট সংগ্রহ করে সেন্সর ব্যবহৃত প্রযুক্তির উদ্ভাবন করেন। অ্যাডভান্স রেলগেট সিস্টেম নামের এ প্রজেক্টটিতে ব্যবহার করা হয়েছে আরডিনো, আল্ট্রাসোনিক সেন্সর, জাম্পার ওয়্যার, ব্রেড বোর্ড, সার্বো মোটর, সর্বোপরি বিদ্যুৎ সংযোগ। প্রজেক্টটি তৈরি করতে শিক্ষার্থীদের খরচ হয়েছে ২ হাজার টাকা।

প্রজেক্টটিতে দেখা যায়, রেল ক্রসিংয়ের কিছু দূরে লাগানো হয়েছে আল্ট্রাসোনিক সেন্সর। যার ফলে ট্রেনে আসার উপস্থিতি টের পেয়ে স্বয়ংক্রিয় মোটরের মাধ্যমে রেল ক্রসিংয়ের ব্যারিয়ার পড়ে যায়। আবার ট্রেন চলে গেলে পুনরায় ব্যারিয়ারটি উঠে যায়। শুধু তাই নয় ট্রেন আসার সংকেত বোঝাতে ব্যবহার করা হয়েছে সাংকেতিক বাতি ও সতর্ক শব্দ। আর এ প্রযুক্তিটি সঞ্চালিত হচ্ছে বৈদ্যুতিক উপায়ে। ফলে প্রয়োজন হচ্ছে না গেটম্যানের।

ডিজিটাল এ উদ্ভাবন প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আজমাইন আরাফাত বলে, ২০০৫ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত দেশে রেলক্রসিংয়ে ৪ হাজার ১৯৪টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় ৪১৯ জন মারা গেছেন, আহত হয়েছে দুই হাজারেরও বেশি। এর মধ্যে ৯৬১টি দুর্ঘটনা সরাসরি গেটম্যানের অসতর্কতার কারণে ঘটেছে। এ প্রেক্ষাপটে রেলক্রসিং নিরাপদ ও দুর্ঘটনা রোধে আমরা উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহারের উপর গুরুত্ব দিয়েছি।

এই প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত হলে দুর্ঘটনা অনেকাংশে হ্রাস পাবে। কারণ ট্রেন রেলক্রসিং করার আগেই সর্তক সংকেত এবং এ্যলার্ম বেজে উঠবে। এতে করে লোকজন সতর্ক হয়ে যাবে। ট্রেনটি যখন সেকেন্ড সেন্সরে আসবে তখন গেটটি অটোমেটিক নেমে যাবে এবং থার্ড সেন্সরে যাবে তখন আবার গেটটি উঠে যাবে। আমাদের প্রথম দুটি সেন্সর থাকবে রেলগেটের ডান ও বাম দিকে। গেটের নিচে যানবাহন আটকা পড়ার আশঙ্কা খুবই কম থাকবে। কারণ ফাস্ট সেন্সর থেকে সেকেন্ড সেন্সরের দূরত্ব প্রায় তিন কিলোমিটার থাকবে এবং এটি অতিক্রম করতে তিন মিনিট সময় লাগবে। এর মধ্যে মানুষজন দ্রুত রেলক্রসিং পারাপারের সময় পাবে।

১০ম শ্রেণি পড়ুয়া আজমাইনের দাবি, ডিজিটাল এ প্রযুক্তির ব্যবহারে দুর্ঘটনার শঙ্কা একদম কমে যাবে। এটি চতুর্থ শিল্প বিপ্লব প্রজেক্ট। বাংলাদেশ এখন সবদিক থেকে ডিজিটাল হচ্ছে, সেক্ষেত্রে রেল দুর্ঘটনা প্রতিরোধে এটি একটি উন্নত প্রযুক্তি। সরকার চাইলে এটি পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহার করে এর সুফল সম্পর্কে যাচাই-বাছাই করতে পারে।

বিজ্ঞান বিভাগের এই শিক্ষার্থী বলে, দুর্ঘটনা ঘটে গেটম্যান না থাকায় কারণে আবার কখনো কখনো গেটম্যানের অসতর্কতায়। আবার একজন গেটম্যানের পক্ষে সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালন করা বা জেগে থাকাটাও কষ্টকর। একটানা ২৪ ঘণ্টা দুর্ঘটনারোধে কেউই সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতেও পারে না। এ কারণে দায়িত্বে অবহেলার ঘটনা ঘটে। আমরা প্রায়ই শুনি ক্লান্তি দূর করতে গেটম্যান চা খেতে গেছে নয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে। এক্ষত্রে আমাদের প্রজেক্টটি একটি অটোমেটেড বিষয়, এ প্রযুক্তির ব্যবহার হলে গেটম্যানের প্রয়োজন হবে না। দুর্ঘটনার রোধে রেলক্রসিংয়ের সময় অটোমেটিক গেট পড়বে এবং উঠবে। যার কারণে দুর্ঘটনার আশঙ্কা থাকবে না।  

সে আরও বলেন, প্রতিবছর রেলখাতে অনেক ব্যয় হচ্ছে। গেটম্যানদের সংখ্যা অনেক, তাদের বেতন-ভাতার পরিমাণটাও কম নয়। থাকা-খাওয়াসহ অন্যান্য সুযোগ সুবিধা দিতে হয় তাদের। এখন দেশে উন্নত ও ডিজিটাল প্রযুক্তির ছোঁয়া সবখানে পৌঁছতে শুরু করেছে। আমাদের উদ্ভাবিত প্রযুক্তি ব্যবহারে গেটম্যান ছাড়াই নিরাপদ রেলক্রসিং নিশ্চিত করতে পারবে সরকার। এতে ব্যয় কমে আসবে সঙ্গে রেলপথ আরও বেশি নিরাপদ হবে। শুধু তাই না, এই অতিরিক্ত ব্যয় কমে এলে সরকার অন্যান্য প্রকল্পে ওই টাকা ব্যয় করতে পারবে।  

গাইবান্ধা সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের শিক্ষক জহুরুল ইসলাম বলেন, গাইবান্ধা শহরে অনেকগুলো রেলক্রসিং রয়েছে। বিভিন্ন সময়ে একাধিকবার দুর্ঘটনাও ঘটেছে। এ ঘটনাগুলো বিদ্যালয়ের ছাত্রদের নজরে এসেছে এবং তারা কয়েকজন মিলে একটা উদ্যোগ নিয়ে ট্রেন দুর্ঘটনারোধে গতবছর অ্যাডভান্স রেলগেট সিস্টেম প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে। গাইবান্ধায় বিজ্ঞান মেলায় এটি প্রদর্শন করা হলেও বিভাগীয় পর্যায়ে ডিজিটাল উদ্ভাবনী মেলায় এটি প্রথম প্রদর্শনী।

তিনি আরও বলেন, মেলায় সবার কাছ থেকে আমাদের শিক্ষার্থীরা ভালো সাড়া পেয়েছেন। এমন একটি ডিজিটাল ও উন্নত প্রযুক্তির উদ্ভাবনের জন্য আমরাও খুশি। আমাদের ছেলেরা বিভিন্ন ইলেক্ট্রনিক কিট সংগ্রহ করে এ ডিজিটাল রেল ক্রসিংটি বানিয়েছে। সরকার যদি এটি উদ্যোগ নিয়ে বাস্তবায়ন করতে পারে তাহলে ট্রেন দুর্ঘটনা অনেকাংশে কমে আসবে।

এর আগে শনিবার (২০ মে) সকালে রংপুর জেলা পরিষদ কমিউনিটি মিলনায়তন চত্বরে ডিজিটাল উদ্ভাবনী মেলার উদ্বোধন করেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব আব্দুস সবুর মণ্ডল। রংপুর বিভাগীয় কমিশনার হাবিবুর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে আরও ছিলেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব ড. আবু শাহীন আসাদুজ্জামান, রংপুরের জেলা প্রশাসক ড. চিত্রলেখা নাজনীনসহ বিভাগের বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।

ফরহাদুজ্জামান ফারুক/আরকে