‘মেয়েটাকে পড়াতে চেয়েছিলাম, কিন্তু শিক্ষকরা তা হতে দিলো না’
ফরম পূরণের ফি জমা দিয়েও চলমান এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেনি প্রতিবন্ধী নাছিমা। ঘটনাটি ঘটেছে শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জ উপজেলার সখিপুরে। এ ঘটনায় এক শিক্ষকের বিচার চেয়ে শিক্ষা অফিসারের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছে ভুক্তভোগী পরীক্ষার্থী নাছিমা।
রোববার (১৪ মে) সখিপুর থানার সোলাইমানিয়া ইসলামিয়া দাখিল মাসরাসার শিক্ষার্থী প্রতিবন্ধী নাছিমার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে না পেরে বিমর্ষ হয়ে অলস সময় পার করছে সে।
বিজ্ঞাপন
নাছিমা ঢাকা পোস্টকে বলে, বন্ধুরা পরীক্ষার পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছে আর এদিকে আমার সময় কাটছে না। পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে না পেরে আমি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছি। পরীক্ষার ফরম পূরণের ফি মাদরাসার সহকারী শিক্ষিকা টিউলিজ রহমানের কাছে জমা দিলেও আমার ফরম পূরণ হয়নি। আমি প্রতিবন্ধী মানুষ। আমার বাবা কৃষক। দুর্গম এই চরে এমনিতেই বাবা-মায়েরা মেয়েদের পড়াশোনা করাতে চায় না। অনেক কষ্ট করে পরীক্ষার ফি জমা দিয়েছি। আমার বাবার সামর্থ্য নেই নতুন করে আবার খরচ দেওয়ার। এক পায়ে সমস্যার কারণে প্রতিবন্ধী হওয়াতে আমার অনেক চ্যালেঞ্জ নিয়ে চলতে হয়। পরীক্ষা দিতে না পেরে এখন আমার বাবা-মায়ের কাঁধের বোঝা হয়ে থাকা ছাড়া উপায় নেই। তাই আমি ক্ষতিপূরণ দাবি করছি।
নাছিমার কৃষক বাবা মজিবল মাঝি বলেন, আমি খুব কষ্ট করে সংসারের খরচ বহন করি। নিজে মূর্খ হলেও মেয়েটাকে পড়াতে চেয়েছিলাম। কিন্তু শিক্ষকরা তা হতে দিলো না। আমি এর বিচার চাই।
এ বিষয়ে অভিযুক্ত শিক্ষিকা টিউলিজ রহমান কলি ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি সব শিক্ষার্থীর থেকে টাকা উত্তোলন করে মাদসারার সুপারের কাছে জমা দিয়েছি। কেন তিনি ফরম পূরণ করেননি তা আমি বলতে পারব না। আমি এই এলাকার মেয়ে। আমার পরিবারে জোড়ায় জোড়ায় শিক্ষক। আমি কম টাকা জমা দেয়নি। পরীক্ষার ফরম পূরণের ফি আমি রিসিটের মাধ্যমে জমা দিয়েছি।
মাদরাসাটির ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি বলছেন, অভিযুক্ত ওই শিক্ষিকা অসচেতনভাবে চলাফেরা করেন। চলমান দাখিল পরীক্ষার ফরম পূরণের টাকা উত্তোলনের দায়িত্ব তার থাকলেও সব টাকা তিনি মাদরাসার ফান্ডে জমা দেননি।
মাদরাসাটির ভারপ্রাপ্ত সুপার আব্দুল মান্নান বলেন, যখন ফরম পূরণের নির্ধারিত সময় ছিল তখন সুপারের দায়িত্ব পালন করেছেন মাহবুবুর আলম। তার সঙ্গে ফরম পূরণে সহযোগিতা করেছেন শিক্ষিকা টিউলিজ রহমান ও অফিস সহকারী হাসান আলী। তারা বোর্ডে ৪৫ জন শিক্ষার্থীর ডকুমেন্টস পাঠিয়েছেন, পরবর্তীতে বিলম্ব ফিসহ মোট ৪৬ জন শিক্ষার্থীর ফরম পূরণ হয়েছে। গত ১৩ মার্চ সুপার মাহবুবুর আলম চাকরি ছেড়ে অন্য প্রতিষ্ঠানে চাকরি নিয়েছেন। তৎকালীন সুপার, টিউলিজ ও হাসান কী কারণে প্রতিবন্ধী মেয়েটার ফরম পূরণ করেনি তা আমি বলতে পারব না। মানুষের মৃত্যু হলে যেমন ফেরত পাওয়া যায় না তেমনি ওই শিক্ষার্থীর যে ক্ষতি হয়েছে তা কোনোভাবে ফেরত পাওয়া সম্ভব না। আমি বিষয়টি প্রতিষ্ঠানের সভাপতিসহ ম্যানেজিং কমিটিকে জানিয়েছি, তা শিগগিরই একটা সিদ্ধান্ত নেবেন বলে আশা করছি।
তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত সুপার মাহবুবুর আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, টিউলিজ ও হাসান আলী আমার কাছে যে ডকুমেন্টস দিয়েছেন সেই ডকুমেন্টসের আলোকে আমি ফরম পূরণ করেছি। যেসব শিক্ষার্থী সমস্যার কারণে ফরম পূরণ করেনি, তাদের সরাসরি আমি খোঁজ খবর নেইনি। খোঁজ খবর নেওয়ার দায়িত্ব ছিল টিউলিজ রহমানের।
মাদরাসাটির ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি মাহবুবুর রহমান বড় মিয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, টিউলিজ রহমান তৎকালীন সুপারকে ৪৫ জন শিক্ষার্থীর ডকুমেন্টসসহ টাকা জমা দিয়েছেন। ওই ৪৫ জন শিক্ষার্থীর ফরম পূরণ হয়েছে। পরবর্তীতে বিলম্ব ফি দিয়ে বর্তমান সুপার আরও একজন শিক্ষার্থীর ফরম পূরণ করেছেন। ফরম পূরণের সরকারি ফিসহ সব মিলিয়ে প্রত্যেক শিক্ষার্থীর থেকে ২৫০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছিল। ৪৫ জন শিক্ষার্থীর মোট টাকা হয় ১ লাখ ১২ হাজার ৫০০ কিন্তু টিউলিজ মাদরাসায় জমা দিয়েছেন ১ লাখ ১ হাজার ৭০০ টাকা। প্রতিবন্ধী যে শিক্ষার্থীর ফরম পূরণ হয়নি, তা নিয়ে আমরা অস্বস্তিতে আছি। মেয়েটার কষ্ট দেখে আমাদের খারাপ লাগছে।
ভেদরগঞ্জ উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার এ কে এম জাহাঙ্গীর আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, কয়েকটি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার পর আমি লিখিত অভিযোগ পেয়েছি। মেয়েটা প্রতিবন্ধী ও চরাঞ্চলের শিক্ষার্থী হওয়ায় আগে বুঝতে পারেনি কী করতে হবে। প্রতিষ্ঠানের ভুলের কারণে পাবলিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে না পারা গুরুতর বিষয়। আমি একাডেমিক সুপার ভাইজারকে বলেছি নোটিশ দিতে। বিষয়টির গুরুত্ব সহকারে তদন্ত হবে। আমি তদন্ত করে কর্তৃপক্ষের নিকট তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেব। তারা ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।
আরকে