অভাবে কিডনি বিক্রি করে কাঁদছেন তারা
জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার আহম্মেদাবাদ বোড়াই গ্রামের জোছনা বেগম। কয়েক বছর আগে তার স্বামী মারা যান। স্বামীর মৃত্যুর পর দুই মেয়েকে নিয়ে পড়েন বিপাকে। শুরু হয় খুব কষ্টের দিন। এক বেলা খেলে অন্য বেলা না খেয়ে থাকতে হতো। এরই মধ্যে ঋণ নিয়েও চলতে হয় তাকে। এদিকে মেয়েরা বড় হয়ে উঠছে। তাদের বিয়ে দিতে হবে। নানা চিন্তা তাকে ঘিরে ধরে।
হঠাৎ তার কানে আসে, একজনের একটি কিডনি নষ্ট। জোছনা মনে মনে সিদ্ধান্ত নেন, তিনি তাকে একটি কিডনি দেবেন এবং বিনিময়ে প্রচুর টাকা পাবেন। সেই টাকা দিয়ে মেয়েদের বিয়ে দেবেন। এমন আশায় একদিন জোছনা তার কাছে গিয়ে বলেন, আপনার যে কিডনি লাগবে, তা আমি দেব। এরপর জোছনা তার একটি কিডনি বিক্রি করেন। সেটি বিক্রি করে তিন লাখ টাকা পান।
বিজ্ঞাপন
নিজ জীবনে ঘটে যাওয়া এমন রোমহর্ষক গল্প ঢাকা পোস্টকে জানান জোছনা বেগম। তিনি বলেন, অভাবে আমার শরীরের একটি কিডনি বিক্রি করি। এখন শরীর নিয়ে খুব কষ্টে আছি। বসে থাকতে পারি না। মাঝেমধ্যে শরীর খুব খারাপ লাগে, জ্বর আসে, শরীর ব্যথা হয়, মাথা ঘোরে, বমি হয়। কিডনি দেওয়ার পর থেকেই অনেক সমস্যায় ভুগছি। এই সমস্যা আগে আমার ছিল না। এখন সব সময় ওষুধ খেতে হয়।
কিডনি বিক্রি করে কত পেয়েছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, তিন লাখ টাকা পেয়ে গ্রামে এসে দুই মেয়েকে বিয়ে দিই। তারপরও ধারদেনা থেকেই যায়। পরে জোছনাও এক কিডনি বিক্রেতা বেলাল হোসেনকে বিয়ে করেন বলে জানান।
একই গ্রামের আয়নুল ইসলামও অভাবের তাড়নায় তার শরীরের বাঁ কিডনি বিক্রি করেন। আয়নুল বিভিন্ন এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে বেকায়দায় পড়েন। এনজিও সংস্থা তাকে টাকার তাগাদা দিলে তিনি তা পরিশোধ করতে না পেরে ঢাকায় যায়। সেখানে গিয়ে তার এই কিডনি বিক্রি করেন। তারপর কিডনি বিক্রি করে যে টাকা পান, তা দিয়ে বিভিন্ন ঋণ শোধ করেন।
আয়নুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, এই ভুলটা যেন কেউ না করে। নিজের অঙ্গ কেটে আরেকজনকে দেওয়া যে কত কষ্ট, সেটা তো আমি বুঝি ভাই। আমি এখন ভারী কোনো কাজ করতে পারি না। বাম দিক হয়ে ১০ মিনিট শুয়ে থাকতে পারি না। আমাকে সব সময় ব্যথার বড়ি খাওয়া লাগে। পরে ডাক্তারের কাছে মোবাইল করেছি, ডাক্তার বলছে, তোমার কিডনি একটা, তাই বেশি ব্যথার বড়ি খাওয়া যাবে না। এখন শরীর নিয়ে কষ্টে আছি।
মাত্রাই কুসুমসাড়া লক্ষ্মীচাপড় গ্রামের ওহাব সরদার। কোথায় থাকবেন, স্ত্রী ও সন্তানদের কোথায় রাখবেন, এমন পরিস্থিতিতে পড়ে অন্যের বাড়িতে থেকে দিন কাটত তার। অন্যদিকে ধারদেনা করে পলায়নপর অবস্থা। রাজ্যের চিন্তা মনে। উপায় পাচ্ছিলেন না কোনো। এ অবস্থায় দেড় বছর আগে এক ব্যক্তির সঙ্গে পরিচয় হয় তার। ওই ব্যক্তি পরামর্শ দেয় একটি কিডনি বিক্রি করার জন্য। পরে সাড়ে ৩ লাখ টাকার বিনিময়ে একটি কিডনি বিক্রি করেন।
শারীরিক ঝুঁকি জেনেও কেন এমন সিদ্ধান্ত এমন প্রশ্নের জবাবে ঢাকা পোস্টকে ওহাব বলেন, জমি নাই আর অভাবের জন্য কিডনি বিক্রি করি। সেই টাকা দিয়ে স্ত্রী-সন্তানদের থাকার জন্য জায়গা কিনে, সেই জায়গায় বাড়ি নির্মাণ করে বসবাস শুরু করি।
আমাদের আগে খুবই কষ্ট আছিল। কষ্টের জন্য কিডনি বিক্রি করি। খুবই দুঃখ করেছি বলেই কান্নায় ভেঙে পড়েন ওহাব সরদারের স্ত্রী রেশমা বেগম। ওহাবের মা আফরোজা বেগম বলেন, জায়গা নেই, স্থল নেই। মানষের বাড়িত থাকে, লাত্তি, কদই, ঐ জন্য কিডনি বিক্রি করে। এখন ভালোই আছে, জায়গা-স্থল কিনিচে, বাড়ি ঠিক মোতন করোচে, খাওচে, কাজকাম করোচে।
এদিকে দিন দিন বিভিন্ন এনজিওতে ঋণের পরিমাণ বাড়তে থাকে একই গ্রামের ফুলমিয়া সরদার। স্ত্রী ও দুই সন্তানকে নিয়ে খুব অভাবের সংসার তার। একসময় ঋণের বোঝা সইতে না পেরে ঢাকায় চলে যান ফুলমিয়া। সেখানে রিকশা চালিয়ে কিছু ঋণ শোধ করেন। কিন্তু ঋণের সুদ তরতর করে বাড়তে থাকে। একদিন পরিচয় হয় রাজশাহীর নওদাপাড়া থেকে আসা ঢাকার কলাবাগানের এক ব্যক্তির (দালাল চক্রের সদস্য) সঙ্গে।
ওই ব্যক্তি ফুলমিয়াকে জানান, আমাকে তোমার একটি কিডনি দাও, আমি তোমাকে টাকা দেব। এতে গ্রামে তোমার সব লোন পরিশোধ হয়ে যাবে। এতে লোভে পড়ে যান ফুলমিয়া। উপায় না পেয়ে রাজি হয়ে যান তিনি। তিন লাখ টাকার বিনিময়ে তার কাছে বিক্রি করে একটি কিডনি।
ফুলমিয়া সরদার বলেন, আমি শারীরিকভাবে খুবই খারাপ অবস্থায় আছি এখন। ভারী কিছু বহন করলে শরীর খুব ব্যথা করে। পাঁজর টেনে ধরে। বাম সাইট খালি খালি লাগে। আমি ভুল করেছি। এ কাজ যেন আর কেউ না করে।
ফুলমিয়া সরদারের স্ত্রী ববিতা বলেন, আগে এনজিওতে ঋণ ছিল। আশার দ্বারাই কিডনিটা দিছিল যে আমাদের ঋণ শোধ হবে, ছেলেটার লেখাপড়া হবে, ভবিষ্যতে কিছু করা যাবে। এখন দেখছি তো কিছুই নয়। যে ভাই কিডনি নিয়েছিল, সে বলেছিল আমি যতদিন বাঁচব, তত দিন দেখব। কিন্তু আর যোগাযোগ করেনি। এখন আবার এক লাখ টাকা ঋণের চাপে পড়েছেন বলে জানান তিনি।
একইভাবে অভাবে পড়ে নিজের কষ্ট চেপে রেখে কিডনি বিক্রি করেন কুসুমসাড়া গ্রামের মোস্তফা। মোস্তফা বলেন, অভাবের তাড়নায়, বিভিন্ন এনজিওদের চাপে আমি এই কাজটা করেছি। এখন মোটামুটি সুস্থই আছি। মাঝেমধ্যে ব্যথা করে। কার মাধ্যমে এমন সিদ্ধান্ত নিলেন বা কার কাছে গেলেন, এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, দালালের মাধ্যমেই গেছি। নাম তো ওরা সঠিক বলে না। আমাদের কাছে একটা বলে অন্যদের কাছে আরেকটা বলে। তাদের মোবাইলেও পাওয়া যায় না। কোনো রকম যোগাযোগ করে না। যা টাকা পাইছলাম, তা আর নেই। ঋণ শোধ করে এখন আবার শূন্য।
বছর কয়েক আগে জোছনা, আয়নুল, ওহাব, ফুলমিয়ার মতোই অভাবে পড়ে কিডনি বিক্রি করেছিলেন কালাই আহম্মেদাবাদ ইউনিয়নের রাঘবপুর, বোড়াই, নওপাড়া, হারুঞ্জা, বালাইট গ্রাম; মাত্রাই ইউনিয়নের উলিপুর, সাঁতার, ভাউজাপাতার, শিবসমুদ্র, অনিহার, ভেরেন্ডি, কুসুমসাড়া, ছত্রগ্রাম, পাইকশ্বর, ইন্দাহার; উদয়পুর ইউনিয়নের বহুতি, মোহাইল, বাগইল, দুধাইল, জয়পুর বহুতি, নওয়ানা, দুর্গাপুর, উত্তর তেলিহার, ভুষা, কাশিপুর, বিনইল গ্রামসহ কয়েক গ্রামের মানুষ।
এ বিষয়ে আহম্মেদাবাদ ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মো. আলী আকবর মন্ডলের কাছে জানতে চান ঢাকা পোস্ট প্রতিনিধি।
মুঠোফোনে তিনি জানান, অভাবের তাড়নায় অনেক মানুষ কিডনি বিক্রির মতো ভয়ংকর এ কাজে নিজেকে জড়িয়েছেন। দালালদের খপ্পরে পড়ে স্বেচ্ছায় কিডনি দিয়ে দেন। অভাব দূরে করতে কিডনি বিক্রি করলেও অভাব দূর হয়নি। বরং তারা অসুস্থ ও আবার কর্মহীন হয়ে পড়ে। কোনো রকম ভারী কাজ করতে পারে না তারা। বর্তমানে আহম্মেদাবাদ ইউনিয়নে কিডনি বিক্রির চক্র নেই।
বর্তমানে এসব নেই বললেই চলে দাবি করে উদয়পুর ইউপি চেয়ারম্যান ওয়াজেদ আলী ঢাকা পোস্টকে বলেন, এর আগে এ এলাকার অনেক মানুষ তাদের কিডনি বিক্রি করেছে। বিষয়টি জানার পর থেকে আমরা তাদেরসহ সবাইকে সচেতন করেছি। তারপরও শোনা যাচ্ছে বিভিন্ন গ্রামের মানুষ কিডনি গোপনে দিয়ে আসছেন। আমরা চেষ্টা করতেছি মানুষ যেন নিজের গুরুত্বপূর্ণ কিডনি অন্যকে না দেয়।
কালাই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সেলিম মালিক ঢাকা পোস্টকে বলেন, কালাই থানা এলাকায় ইতোপূর্বে কিডনি-সংক্রান্ত কিছু মামলা রয়েছে। বর্তমানে কোনো মামলা বা অভিযোগ পাওয়া যায়নি। এ বিষয়ে কালাই থানা পুলিশ প্রতিটি ইউনিয়নের বিট পুলিশিং অফিসের মাধ্যমে জনগণকে সচেতন করাসহ পুলিশি অভিযান তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে এবং থাকবে।
মানবদেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন আইন-১৯৯৯-এর ৯ ধারায় অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ক্রয়-বিক্রয় বা উপহার বিনিময়ে কোনো প্রকার সুবিধা লাভ এবং সেই উদ্দেশ্য কোনো প্রকার বিজ্ঞাপন প্রদান বা অন্য কোনোভাবে প্রচারণা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
একই আইনের ১০(১) ধারা অনুযায়ী কেউ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিক্রি বা ক্রয় কিংবা সহায়তা করলে সর্বনিম্ন তিন বছর থেকে সর্বোচ্চ সাত বছর পর্যন্ত সশ্রম কারাদণ্ড এবং কমপক্ষে তিন লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার বিধান রয়েছে। শান্তির বিধান অক্ষুণ্ন রেখে ২০০৯ সালে ভ্রাম্যমাণ আদালত আইনেও সংযোজন করা হয়েছে।
কিডনি মানবদেহের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। স্ত্রী ও পুরুষ দুজনের শরীরেই সাধারণত দুটি কিডনি থাকে। কিডনি প্রত্যেক ব্যক্তির আহারের ধরন ও মাত্রা প্রতিদিন পরিবর্তিত রাখে। আহারের মধ্যে বৈচিত্র্যের কারণে শরীরে জল, অম্ল ও ক্ষারের মাত্রা নিরন্তর পরিবর্তিত হয়। আহারের পাচনপ্রক্রিয়ার সময় অনেক অনাবশ্যক পদার্থ শরীরে উৎপন্ন হয়। শরীরে জল, অম্ল বা ক্ষারের সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য রাসায়নিক পদার্থের মাত্রার ভারসাম্য নষ্ট না হলে তা মানুষের পক্ষে ক্ষতিকর বা মৃত্যুর কারণ হতে পারে। কিডনি শরীর থেকে অনাবশ্যক দ্রব্য বা পদার্থ মূত্র হিসেবে শরীর থেকে বের করে রক্তের পরিশোধন করে এবং শরীরে ক্ষার ও অম্লের ভারসাম্য বজায় রাখে। এভাবে কিডনি শরীরকে স্বচ্ছ ও সুস্থ রাখে।
জয়পুরহাট জেলা সিভিল সার্জন ডা. মো ওয়াজেদ আলী ঢাকা পোস্টকে বলেন, কিডনি মানবদেহের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। কিডনি দেহের এসব অনাবশ্যক দ্রব্য শরীর থেকে বের করে শরীরকে সুস্থ রাখে। কেউ কিডনি বিক্রি করলে শারীরিক সমস্যা দেখা দিতে পারে।
এনএ/এএম