ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’ আতঙ্কে উপকূলবাসী
বঙ্গোপসাগরে রোববারের মধ্যে লঘুচাপ সৃষ্টির বার্তায় আতঙ্ক নেমেছে উপকূলে। ‘মোখা’ নামের এই ঘূর্ণিঝড়ের পূর্ব প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে উপকূলের ঝুঁকিতে থাকা কয়েক হাজার মানুষ।
বিগত বছরগুলোর দুর্যোগের ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার আগেই নতুন করে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন পটুয়াখালীর কলাপাড়ার উপকূলবাসী। দুর্বল এবং কাজ চলমান বেড়িবাঁধ নিয়ে আতঙ্কে দিন কাটছে তাদের।
বিজ্ঞাপন
অধিকাংশ এলাকায় বহু আগে নির্মাণ করা এখানকার বেড়িবাঁধগুলো আর পুনর্নির্মাণ করা হয়নি। কুয়াকাটা সমুদ্র এলাকায় চলছে বেড়িবাঁধ সংস্কারের কাজ। তবে এসব বাঁধ এখন আর সামাল দিতে পারছে না ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের ধাক্কা। জিও ব্যাগের বালুর বস্তা আর রিং বাঁধ দিয়ে কোনোরকম টিকিয়ে রাখা হয়েছে ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধগুলো।
কলাপাড়া উপকূলীয় এলাকায় ২০০৭ সালের আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড় সিডরে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া উপকূলীয় এলাকাগুলোর মধ্যে পটুয়াখালী কলাপাড়া একটি। এরপর ২০০৯ সালের ২৫ মে আইলা, ২০১৩ সালের ১৬ মে মহাসেন, ২০১৫ সালের ৩০ জুলাই কোমেন, ২০১৬ সালের ২১ মে রোয়ানু, ২০১৭ সালের ৩০ মে মোরা, ২০১৯ সালের ৩ মে ফণী, ২০১৯ সালের ৯ নভেম্বর বুলবুল আঘাত হানে। সর্বশেষ ২০২০ সালের ২০ মে কলাপাড়া উপকূলে আছড়ে পড়ে ঘূর্ণিঝড় আম্পান। মূলত উপকূলের মানুষগুলোর প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গেই বসবাস করছে।
বঙ্গোপসাগরের কূলঘেঁষা কুয়াকাটা পৌরসভার শেষ প্রান্তে বেড়িবাঁধের কাছে বসবাস করেন ষাটোর্ধ্ব এছাহাক। তিনি বলেন, ‘২০০৭সালে ঘূর্ণিঝড় সিডরে আমার সবকিছু বিলীন হয়ে যায়। তখন থেকে আমরা বেড়িবাঁধের পাশে একটি ঘর তৈরি করে বসবাস করছি। যদিও সরকার আমাদের ঘর দিয়েছে কিন্তু তা দূরে হওয়ায় আমরা সাগরের তীরেই বসবাস করছি, কারণ আমাদের উপার্জনের একমাত্র মাধ্যম সাগরে মাছ ধরা।
তিনি আরও বলেন, এখানেও আমরা শান্তিতে নেই। গেল একযুগ ধরে ঝড় বন্যার সঙ্গে লড়াই করে টিকে আছি আমরা। এখন আবার পানি উন্নয়ন বোর্ডের বেড়িবাঁধ উন্নয়নমূলক কাজ চলে। তাই আমাদের উচ্ছেদ করেছে।
এছাহাক ফরাজীর মতোই আতঙ্কে দিন পার করছে কলাপাড়া উপকূলীয় এলাকায় বিভিন্ন বেড়িবাঁধের পাশে বসবাসরত হাজারো পরিবার। দুর্যোগ এলেই সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকেন এখানকার মানুষ। দুর্যোগে সাগর এবং নদীতে জোয়ারের পানি বাড়লেই আতঙ্কে ছড়িয়ে পড়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে। দুর্বল বেড়িবাঁধ তাদের উদ্বেগের প্রধান কারণ।
মহিপুর ইউনিয়নের শুধীরপুর গ্রামের বাসিন্দা মতি মুন্সি ঢাকা পোস্টকে বলেন, সিডরে আমার দুইটি মেয়ে মারা গেছে। সিডরের রাতে পরিবারের সবাইকে নিয়ে সাইক্লোন শেল্টারে যাচ্ছিলাম হঠাৎ পানির স্রোতে আমার হাতে থাকা দুই মেয়ে ছুটে যায়। তারপর ওদের আর খুঁজে পাইনি। সকাল বেলা ওদের মরদেহ পাওয়া যায়। সেই থেকে ঘূর্ণিঝড়ের নাম শুনলেই ভয় ও আতঙ্কে থাকি।
লতাচাপলী ইউনিয়নের গোড়াখালের বাসিন্দা জলিল বলেন, ঝড় এলেই সবাই সাইক্লোন শেল্টারে যেতে বলে। কিন্তু আমাদের মালামাল কোথায় রেখে যাব। আমরা গরিব মানুষ সম্পদের মধ্যে আছেই শুধু গরু, ছাগল এবং মাছ ধরার জাল ও নৌকা। এইগুলো রেখে কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না।
এ বিষয়ে লতাচাপলী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আনছার উদ্দীন মোল্লা ঢাকা পোস্টকে বলেন, লতাচাপলী ইউনিয়নে বাসিন্দা প্রায় ২০ হাজার অথচ এখানে সাইক্লোন শেল্টার আছে মাত্র ২০টি। এত মানুষকে এ কয়েকটি সাইক্লোন শেল্টারে আশ্রয় দেওয়া সম্ভব নয়। এছাড়া স্কুল, মাদরাসাসহ বিভিন্ন পাকা ভবনে অল্প কিছু মানুষকে আশ্রয় দেওয়া সম্ভব। এত মানুষকে এ কয়েকটি সাইক্লোন শেল্টারে আশ্রয় দেওয়া সম্ভব নয়। তবে যেকোনো পরিস্তিতি মোকাবিলা করার জন্য আমরা ইনশাআল্লাহ প্রস্তুত রয়েছি।
ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচির (সিপিপি) কলাপাড়ার ৭নং লতাচাপলী ইউনিয়ন ও কুয়াকাটা পৌরসভার দলনেতা মো. শফিকুল আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, এখন পর্যন্ত আবহাওয়া খারাপের সংকেত আমরা পাইনি,তবে আবহাওয়া খারাপ হলে আমাদের সিপিপি টিমগুলো মাঠে সর্বদা কাজ করার জন্য প্রস্তুত রয়েছে।
পটুয়াখালী জেলা আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মাহবুবা সুখী ঢাকা পোস্টকে বলেন, ৭ মে বঙ্গোপসাগরে একটি লঘুচাপ সৃষ্টি হয়ে সেটি ঘণীভূত হতে পারে। তবে এখন পর্যন্ত আবহাওয়া অফিসের সদর দপ্তর থেকে কোন নির্দেশনা পাইনি আমরা।
কলাপাডা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. জাহাঙ্গীর হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, এখন পর্যন্ত ঘূর্ণিঝড় হবে তেমন কোন সংবাদ আমরা এখনো পাইনি তবে সাগরে লঘুচাপ সৃষ্টি হবে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অফিস। তবে আগের কয়েকটি দুর্যোগে অগ্রীম প্রস্তুতি থাকায় জানমালের ক্ষয়ক্ষতি কমানো গেছে। আমরা সার্বিকভাবে প্রস্তুত রয়েছি।
এসএম আলমাস/আরকে