নীলফামারী জেলা শহর থেকে ডোমার সড়কে তিন কিলোমিটারের মতো এগোলে ঐতিহ্যবাহী স্থান নীলফামারী নটখানা। বিশাল জায়গা নিয়ে একতলা ভবন। যে ভবনের পরতে পরতে লুকিয়ে আছে নিপীড়নের গল্প, শোষণের গল্প। ভবনটির দিকে চোখ পড়লেই হৃদয়পটে ভেসে ওঠে দরিদ্র কৃষকের ওপর অত্যাচারী নীলকরদের নির্যাতনের বীভৎস দৃশ্য।

ব্রিটিশ আমলে এ জেলায় প্রচুর পরিমাণে নীল চাষ হতো। সে মোতাবেক ব্রিটিশরা নির্মাণ করে নীলকুঠি। আজও এ জেলার বিভিন্ন স্থানে নীলকুঠি দেখতে পাওয়া যায়। এটি ছিল তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের নীলকুঠিয়ালাদের নীল চাষের কেন্দ্রস্থল।

১৭৬০ সালে ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লব ঘটলে কলকারখানায় তৈরি কাপড়ের রঙের জন্য নীলের প্রয়োজন দেখা দেয়। ভারত উপমহাদেশ তখন ব্রিটিশদের অধীনে। সেই সূত্র ধরে পূর্ব বাংলার কৃষককে তারা জোর করে নীল চাষ করতে বাধ্য করত। নীল চাষ ছিল বর্গাপদ্ধতি। জমি বর্গা নিয়ে নীল চাষ করতেন এ অঞ্চলের কৃষকরা। কিন্তু নীলকর, জমির মালিকের পাওনা, চাষ খরচ― সবকিছু বাদ দিয়ে কৃষকের ভাগ্যে হতাশা বৈ কিছুই জুটত না। ফলে কৃষকরা নীল চাষে অস্বীকৃতি জানান। আর এ কারণে তাদের ওপর নেমে আসত অপমান ও নির্যাতন। তাদের স্ত্রী-সন্তানকে ধরে নিয়েও অত্যাচার করা হতো। এমন অনেক মর্মস্পর্শী ঘটনা নতুন করে মনে করিয়ে দেয় এ ভবনটি।

আগে স্থানটির নাম ছিল ‘লটখানা’। অবাধ্য নীলচাষিদের এ নীল খামারে এনে লটকিয়ে শাস্তি দেওয়া হতো বলে এর নাম ছিল ‘লটখানা’। কালের আবর্তে লটখানা শব্দটি উচ্চারিত হতে থাকে ‘নটখানা’ রূপে। তারপর নটখানা থেকে ‘নীলফামারী’ শব্দটির প্রচলন। ধারণা করা হয়, স্থানীয়দের বাচনভঙ্গির কারণে ‘নীল খামার’ রূপান্তরিত হয় ‘নীলখামারী’তে। পরে অপভ্রংশ হয়ে নীলখামারী হয়ে যায় নীলফামারী নামে। আরেক মতে, নীল ফার্মার পরিবর্তিত হয়েও নীলফামারী হতে পারে। তবে যত বিতর্কই থাকুক না কেন, নীল চাষকে কেন্দ্র করেই যে নীলফামারী শব্দের উৎপত্তি, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

এদিকে নীলফামারী ডিসি গার্ডেনের সামনের নীলকুঠি ১৯৯৯ সাল থেকে নীলফামারী অফিসার্স ক্লাব হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। ঔপনিবেশিক স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত ৬৩ ও ৫১ ফুট এ টিনশেড ভবনে ২টি ফায়ার পেন্টস, ২টি বেড রুম, ১টি ড্রয়িংরুম, ২টি বাথরুম ও পেছন দিকে একটি বারান্দা রয়েছে নীলকুঠিতে। এখন সময় বদলে গেছে। সঙ্গে সঙ্গে বদলে গেছে নীলকুঠির বাসিন্দাদের জীবনযাত্রা।

১৮৮২ সাল থেকে এ নীলকুঠিটি মহাকুমা প্রশাসকের বাসভবন, ১৯৮৪ সাল থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত এটি ছিল জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের বাসভবন। বর্তমানে এটি নীলফামারী অফিসার্স ক্লাব হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। তবে অবাক তথ্য হচ্ছে, প্রায় ১৫০ বছর পুরোনো এ ভবনটি, কোনো ধরনের পরিবর্তন ছাড়াই আজও অটুট আছে।

ইতিহাসের প্রয়োজনে নীলকুঠিগুলোকে সরকারিভাবে সংরক্ষণ করা জরুরি। জনমনে আজ এসবের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়। স্থানীয় জনগণ মনে করে, স্মৃতিময় এ ভবনটি সংরক্ষণ করে জাদুঘরে পরিণত করা হোক, যাতে নীলফামারীর আগামী প্রজন্ম জানতে পারে আমাদের অস্তিত্বের সঙ্গে জড়িত থাকা ইতিহাস।

নীলফামারী সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রুবাঈয়াত হোসাইন হিয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, নীলচাষ ও নীলকুঠির সঙ্গে নীলফামারী জেলার অতীত ইতিহাস সম্পৃক্ত। নীল চাষকে কেন্দ্র করেই এ জেলার নামকরণ করা হয়েছে। আমাদেরসহ ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে নীলফামারীর ইতিহাস ও ঐতিহ্য জানতে এই ভবনের সংরক্ষণ খুবই জরুরি।

প্রবীণ সাংবাদিক আতিয়ার রহমান ঢাকা পোস্টকে জানান, নীলকরদের অন্যায়-অত্যাচার আর নিপীড়নের স্মৃতিচিহ্ন বয়ে বেড়াচ্ছে নীলফামারী জেলা। জমি উর্বর থাকায় অনাগ্রহী কৃষকদের নীল চাষে বাধ্য করেছিল শাসক ব্রিটিশরা। ব্রিটিশ বেনিয়ারা অনেক আগে চলে গেছে। দেশও আজ স্বাধীন। আগামী প্রজন্মকে ব্রিটিশদের এসব অত্যাচার-নিপীড়নের ইতিহাস জানার জন্য এই ভবনগুলো সংরক্ষণ করা জরুরি।

নীলফামারী জেলা প্রশাসক হাফিজুর রহমান চৌধুরী ঢাকা পোস্টকে জানান, নীলকুঠি নীলফামারীর ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক। ইতোমধ্যে প্রাচীন নীলকুঠি সরকার কর্তৃক সংরক্ষিত পুরাকীর্তি ঘোষণার কাজ চলমান রয়েছে। আর অফিসার্স ক্লাবে নীলকুঠির আবেদন ঠিক রেখে আমরা সংস্কারকাজ করতে চাই।

এনএ