স্বপ্ন নিয়ে শিল্পাঞ্চল সাভারে আসেন লাখ লাখ মানুষ। তাদের মধ্যে অনেকেই স্বপ্ন পূরণ করতে কাজ নিয়েছিলেন রানা প্লাজায়। কিন্তু তাদের সেই স্বপ্ন দুমড়ে-মুচড়ে গেছে ধসে পড়া রানা প্লাজার কনক্রিটের চাপায়। ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সেই দুর্ঘটনায় এভাবেই কনক্রিটের চাপায় শেষ হয়ে গেছে কুষ্টিয়ার খোকসা থেকে আসা হাওয়া বেগমের স্বপ্ন। এক সময় তিনি শ্রমিক পরিচয়ে অবস্থা পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখলেও রানা প্লাজা আজ তাকে ভিক্ষার ঝুলি কাঁধে নামিয়ে দিয়েছে রাস্তায়।

জানা গেছে, শুধু হাওয়া বেগম নয়, এমন আরও অন্তত ১০ জন রয়েছেন সাভারেই। এক রানা প্লাজা তাদের স্বপ্ন ভেঙে কেড়ে নিয়েছে কর্মক্ষমতা, কেড়ে নিয়েছে মুখের হাসি। সেই স্মৃতি আর শারীরিক যন্ত্রণা যেন তাদের এখন নিত্যদিনের সঙ্গী। পর্যাপ্ত সহযোগিতার অভাবেই রানা প্লাজার সেই ট্রাজেডিতে ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকরা ভিক্ষাবৃত্তি করতে বাধ্য হচ্ছেন বলে দাবি একাধিক শ্রমিক নেতার। তারা আহত শ্রমিকদের জন্য পর্যাপ্ত সহযোগিতা দাবি করেছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রান্না প্লাজায় আহতের মধ্যে এখনও সাভারেই বসবাস করছেন চার থেকে পাঁচ শতাধিক শ্রমিক। যদিও এ দুর্ঘটনায় দুই হাজারেরও বেশি শ্রমিক আহত হয়েছিলেন। আহতরা সেই দুঃসহ স্মৃতি আকড়ে ধরে এখনও বসবাস করছেন এখানেই। তাদের মধ্যে অন্তত ১০ জন শ্রমিক কর্মক্ষমতা হারিয়ে শুরু করেছেন ভিক্ষাবৃত্তি। এদের তালিকা লম্বা হচ্ছে দিন দিন। এদের মধ্যে রয়েছেন সাফিয়া, সালমা, নিলুফাসহ (ছদ্মনাম) আরও অনেকে।

হাওয়া বেগম ভিক্ষাবৃত্তি করেন সাভারের নিউমার্কেট এলাকার ফুটওভার ব্রিজের ওপর, সিআরপি রোডের মসজিদ এলাকাসহ বিভিন্ন মার্কেটের সামনে। সোমবার (১০ এপ্রিল) বিকেলে সাভারের নিউমার্কেট এলাকার ফুটওভার ব্রিজের ওপর দেখা মেলে হাওয়া বেগমের। সেখানে বসে তিনি হাত পেতে ভিক্ষা নিচ্ছেন নানা মানুষের কাছে থেকে। 

সেখানেই হাওয়া বেগমের সঙ্গে কথা হয় ঢাকা পোস্টের। তিনি বলেন, 'আমি আমার ছোট বাচ্চা রেখে রানা প্লাজার ৮ তলায় ক্লিনার হিসেবে কাজ নিয়েছিলাম। ঘটনার দিন আমি সেখানেই ছিলাম। ভবন ধসে চাপা পড়ে আমি হাতে, কোমড়ে ও মেরুদণ্ডে আঘাত পাই। কোনোরকমে হাঁটাচলা করতে পারলেও কাজ করতে পারি না। কেউ বাসাবাড়ির কাজ করতেও নেয় না। তাই বাধ্য হয়ে কাধে তুলে নিয়েছি ভিক্ষার ঝুলি। কোনো দিন ১০০, কোনো দিন ৩০০, কোনো দিন ৪০০ টাকা পাই। এই টাকা দিয়ে কোনোমতে বাবা-মা ও এক সন্তান নিয়ে খেয়ে না খেয়ে দিন পার করছি। 

কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, অনেকে অনেক কিছুই পেয়েছে। আর আমাকে বান্দাও দিচ্ছে না আল্লাহ্ও দিচ্ছে না। আমি তেমন কোনো সহযোগিতা পাইনি। আমার বেতন বাবদ ৬ হাজার ও এককালীন ৬০ হাজার টাকা পেয়েছিলাম। সেই টাকা দিয়ে একটি রিকশা কিনে ভাড়া দিয়েছিলাম। কিন্তু আজ নষ্ট হয়, কাল নষ্ট করে আরও বেশি টাকা খরচ হত। তাই সেটি বিক্রি করে দিয়েছি। সেই টাকা দিয়ে চিকিৎসাসহ অন্য খরচ চালিয়েছি। এখন আমি পথের ভিখারি। পথে পথে ভিক্ষা করে খেয়ে না খেয়ে বেঁচে আছি। প্রতি বছরই সাংবাদিক আসে কিন্তু আমাদের আর ব্যবস্থা হয় না। আমরা মাথা গোঁজার ঠাঁই চাই।

স্বপ্নহারা সাফিয়া নামের আরও একজনের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, এখন তো কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছি। রানা প্লাজায় এসেছিলাম একটু খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকতে। কিন্তু হলো বিপরীত। রানা প্লাজা আমারে পথের ভিখারি বানিয়ে দিল। মান-মর্যাদাটুকুও আর শেষ পর্যন্ত রইল না। এখন মানুষের কাছে হাত পাততে বাধ্য হতে হয়। আমরা এই অভিশাপ থেকে মুক্তি চাই। আমরা আমাদের পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন চাই।

রানা প্লাজার আহত শ্রমিক লিপি আক্তার বলেন, আমাদের ক্ষতিপূরণ না দিলে বিষ কিনে দিলেই হবে। আমরা সবাই একসঙ্গে খেয়ে মরে যাব। এভাবে মানুষ বেঁচে থাকতে পারে না। এভাবে বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়া অনেক ভালো। আমরা তো বায়ারদের কাজ করতে গিয়ে আহত হয়েছি। তাদের কী কোনো দায়িত্ববোধ নেই? তারাও তো আমাদের ব্যবস্থা করতে পারেন। আমাদের ক্ষতিপূরণ না দিলে আমাদের মেরে ফেলার অনুরোধ করছি। তাহলে আমরা মুক্তি পাই।

রানা প্লাজা ধস থেকে শ্রমিক উদ্ধার/ ফাইল ছবি

রানা প্লাজার আহত শ্রমিকদের নিয়ে গঠিত রানা প্লাজা সার্ভাইভ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মাহমুদুল হাসান হৃদয় বলেন, 'আমার জানা মতে রানা প্লাজায় ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকের প্রায় ১০ জন শ্রমিক ভিক্ষাবৃত্তি করে তাদের জীবন চালাচ্ছেন। তারা যদি পর্যাপ্ত সহযোগিতা পেতেন তাহলে হয়ত আজ ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে রাস্তায় নামতেন না। এছাড়া অনৈতিক কাজেও অনেকে নেমে পড়েছেন। তারা ভালো থাকার জন্য বিভিন্ন জেলা থেকে এসেছিলেন। কিন্তু রানা প্লাজা তাদের সব কিছু কেড়ে নিয়েছে। মানুষের সব চেয়ে বড় সম্পদ তার কর্মক্ষমতা। আজ সেটাই তারা হারিয়ে পথে নামতে বাধ্য হয়েছেন। আমরা পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ বাস্তবায়নের দাবি জানাচ্ছি। এছাড়া আমি নিজেও রানা প্লাজার শ্রমিক। আমিও আহতবস্থায় কষ্টে দিন পার করছি। ঠিকমতো চিকিৎসাটাও করতে পারছি না।

গার্মেন্টস শ্রমিক ঐক্য লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক সারোয়ার হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আসলে রানা প্লাজা ধসে শ্রমিকরা কাজ করতে এসে আহত হয়ে কর্মক্ষমতা হারিয়েছে অনেকে। এখন তারা ভিক্ষাবৃত্তি করছেন এটা সবার কাছে কষ্টের ব্যাপার। আমি শ্রমিক নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করি। এতো দিনের অভিজ্ঞতায় যতটুকু জানি শ্রমিকদের খুব বেশি চাহিদা নেই। তারা খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকতে পারলেই খুশি। তারা এমন স্বপ্ন দেখে যা সহজেই পূরণ হয়ে যায়। তবে কর্মক্ষমতা হারালে মানুষের আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। সে অন্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। রানা প্লাজার শ্রমিকরা আহত হয়ে কর্মক্ষমতা হারিয়েছে। এমনকি নির্ভরশীলতার জায়গাটুকুও অনেকের নেই। তাই রাস্তায় নামতে বাধ্য হয়েছেন। এটা অত্যন্ত বেদনাদায়ক ব্যাপার। আমরা চাই যারাই বাধ্য হয়ে ভিক্ষাবৃত্তি শুরু করেছেন তাদের পুনর্বাসন করে এই অভিশাপ থেকে যেন মুক্তি দেওয়া হয়।

আরকে