গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ার আশুতিয়া গ্রামের রবিউল ইসলাম ওরফে আপন। যাকে নিয়ে চলছে নানা আলোচনা-সমালোচনা। বিশেষ শাখার (এসবি) পুলিশ সদস্যের হত্যা মামলার পলাতক আসামি রবিউল ইসলাম বর্তমানে দুবাইয়ের ‘আরাভ খান’। সেখানে তার স্বর্ণ ব্যবসায়ী ও কোটিপতি বনে যাওয়ার খবরটি বর্তমানে আলোচনার মূল বিষয়বস্তু। সপ্তম শ্রেণির গণ্ডি না পেরোনো ছেলেটি কী করে হলেন দুবাইয়ের কোটিপতি তা নিয়ে কৌতূহলের শেষ নেই অনেকের।

‘আরাভ জুয়েলার্স’ নামে একটি গয়নার দোকানের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান, ইউটিউবার হিরো আলমসহ দেশের বিনোদন জগতের বেশ কয়েকজন তারকা দুবাই যাওয়ার পর থেকেই বিষয়টি সবার নজর কাড়ে। পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, ওই দোকানের মালিক আরাভ খানই পুলিশ ইন্সপেক্টর মামুন হত্যা মামলার ৬ নম্বর আসামি রবিউল ইসলাম ওরফে আপন। 

বুধবার (১৫ মার্চ) বিভিন্ন গণমাধ্যমে আপনকে নিয়ে সংবাদ প্রকাশের পর তার গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ার আশুতিয়ায় যায় ঢাকা পোস্ট। বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তার গ্রামের বাড়ির পাকা ওয়ালের টিনশেডের বাড়িটি তালাবদ্ধ। পরে সেখান থেকে বাড়ির পাশে একটি চায়ের দোকানে গেলে দেখা মেলে আপনের কয়েকজন বাল্যবন্ধু ও প্রতিবেশীর সঙ্গে। দীর্ঘ সময় কথা হয় তাদের সঙ্গে। তাদের ভাষ্যমতে উঠে আসে নানা তথ্য। 

জানা যায়, আপনের আদি বাড়ি বাগেরহাটের চিতলমারী উপজেলায়। সেই সুবাদে প্রথম শ্রেণি থেকে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেন সেখানকার এস এম মডেল স্কুলে। যদিও ওই এলাকার মানুষ তাকে রবিউল নামে চেনে। সপ্তম শ্রেণিতে ফেল করার পর তাকে কোটালীপাড়ায় নিয়ে আসে তার পরিবার। কোটালীপাড়ায় এসে তার বাবার সঙ্গে মাছ ধরার কাজে সহযোগিতা করতেন তিনি। এরপর এলাকায় বিভিন্ন অপকর্মে জড়িয়ে পড়েন। 

রবিউল ইসলাম ওরফে আপনের গ্রামের বাড়ি

নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক আপনের একজন প্রতিবেশী জানান, আপনের বাবার নাম মতিউর মোল্লা। তিনি এক সময় খুলনায় থাকতেন। জীবিকার তাগিদে যুবক বয়সেই কোটালীপাড়ায় এসেছিলেন। মাছ মেরে বাজারে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করত আপনের বাবা। তিন ভাইবোনের মধ্যে আপন ছিলেন বড়। আপনও প্রায়ই বিলে তার বাবার সঙ্গে মাছ ধরতে যেতেন। ক্লাস সেভেনে ফেল করার পর বিভিন্ন সময়ে জড়িয়ে পড়েন নানান অপকর্মে। প্রথম দিকে গ্রাম থেকে হাস-মুরগি চুরি করে বাজারে বিক্রি করে খেলতেন জুয়া। গ্রামে একাধিকবার আপনকে নিয়ে বিচার শালিস হলে তাকে বাড়ি থেকে ঢাকা পাঠিয়ে দেয় তার পরিবার। ১০ বছর আগে একবার আপন গ্রামের বাড়িতে এসেছিল। এরপর আর তাকে গ্রামে আসতে দেখেনি কেউ। আপনের দুই বোনেরই বিয়ে হয়েছে বাগেরহাট জেলায়।  

তিনি আরও বলেন, এই বাড়িতে আপনের স্ত্রী-সন্তান শ্বশুর-শাশুড়ির সঙ্গে থাকতেন। তবে কয়েক মাস হলো বাড়িতে তাদের কাউকে দেখা যাচ্ছে না। সম্ভবত তারা বিদেশে চলে গেছেন।

এ বিষয়ে আপনের বাল্যবন্ধু রহমান মোল্লা জানান, আপনের ছোটবেলা কেটেছে তার বাবার সঙ্গে মাছ ধরে। পড়ালেখায় খুবই অমনোযোগী ছিল সে। ১৪ থেকে ১৫ বছর আগে আপন এলাকা ছেড়ে ঢাকায় চলে যায়। বছর দশেক আগে একবার এসেছিল। তখনও তাকে দেখে এতো টাকার মালিক মনে হয়নি। দুই থেকে তিনদিনের মতো গ্রামে কাটিয়েছিল। তখনও আমরা তাকে আপন নামেই চিনতাম। কিছুদিন আগে ফেসবুকে দুবাইয়ের স্বর্ণের দোকানের উদ্বোধনের বিষয়টি দেখে আমরা সবাই অবাক হয়েছি। আমরা টিভিতে দেখেই আপনকে চিনে ফেলেছি। আমাদের মাথায় প্রশ্ন ঘুরছে, আপন কী করে আরাভ খান হলো।

তিনি যদি অবৈধ পথে ধন সম্পদের মালিক হন ও প্রকৃত হত্যা মামলার আসামি হন তাহলে তাকে আইনের আওতায় এনে বিচারের মুখোমুখি করার দাবি জানিয়েছেন গ্রামবাসী। 

দুবাইয়ের স্বর্ণ ব্যবসায়ী আরাভ খানই কোটালীপাড়ার আশুতিয়া গ্রামের রবিউল ইসলাম আপন বিষয়টি নিশ্চিত করে হিরণ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মাজহারুল আলম পান্না বলেন, প্রায় এক যুগ অগে আপন একবার বাড়ি এসেছিল। এরপর তাকে গ্রামে আর দেখা যায়নি। তাই তার সম্পর্কে আমরা তেমন কিছুই জানতাম না। তবে কিছুদিন আগে ফেসবুকে দেখে আমরা এলাকাবাসী অবাক হই। কী করে সে এতো টাকার মালিক হলো, বিদেশে গিয়ে নাম বদলে আরাভ খান হলো তা আমাদের মাথায় আসছে না। আমরা তাকে টিভিতে দেখেই ফেলি,সে মতিউর জেলের ছেলে আপন মোল্লা। এত অল্প সময়ে বিপুল পরিমাণ টাকার মালিক হওয়া সম্ভব না। আমরা মনে করি, অবৈধ পথে এই টাকা সে আয় করেছে। এর সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া উচিত। সে দোষী হলে তার বিচার হওয়া উচিত।

জানা যায়, ২০১৮ সালে পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) স্কুল অব ইন্টেলিজেন্স পরিদর্শক মামুন ইমরান খানকে (৩৪) পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। সেই হত্যা মামলার ৬ নম্বর আসামি রবিউল ইসলাম আপন ওরফে আরাভ খান।

মামুন হত্যার ঘটনায় তার ভাই ডিএমপির বনানী থানায় ২০১৮ সালের ১০ জুলাই একটি মামলা দায়ের করেন। ওই মামলায় ২০১৯ সালে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে পুলিশ। মামলার এজাহার অনুযায়ী আরাভের আসল নাম রবিউল ইসলাম আপন ওরফে সোহাগ ওরফে হৃদয়। মামলায় আপনের ঠিকানা গোপালগঞ্জের কোটালিপাড়ায় উল্লেখ করা হয়েছে। 

এ হত্যা মামলার সাজা থেকে বাঁচতে একেছিলেন বাংলা সিনেমার আয়নাবাজির ছক। আবু ইউসুফ লিমন নামে এক তরুণকে বিকেএসপিতে খেলার সুযোগের প্রলোভন দেখান আরাভ। সেই প্রলোভনে পড়ে লিমন আদালতে আরাভের বদলে আত্মসমর্পণ করে। পরে আদালত লিমনকে কারাগারে পাঠায়। এই ফাঁকে আরাভ ঊর্ধ্বতন এক সরকারি কর্মকর্তার সহায়তায় নকল পাসপোর্ট বানিয়ে দেশ ত্যাগ করে দুবাই চলে যান। পরে এ বিষয়টি জানাজানি হলে লিমনের বিরুদ্ধে প্রতারণার মামলা হয়। তিনি এখনও প্রতারণার মামলার হাজিরা দিয়ে যাচ্ছেন। ২০২০ সালের অক্টোবর থেকে প্রায় ৯ মাস জেল খাটার পর জামিনে মুক্তি পান লিমন।

দুবাইয়ের আরাভ খানই পুলিশ পরিদর্শক মামুন হত্যার ৬ নম্বর পলাতক আসামি বলে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের মতিঝিল বিভাগ বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। ডিবি জানায়, পুলিশের জমা দেওয়া অভিযোগপত্রেও তাকে পলাতক আসামি দেখানো হয়েছে। সম্প্রতি একটি গণমাধ্যমে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ডিবি পুলিশের প্রধান হারুন অর রশীদ বলেছেন, ইন্টারপোলের মাধ্যমে আপনকে দেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে। 

আরকে