‘বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর’— সাম্যের কবি কাজী নজরুল ইসলাম লাইনগুলো লিখেছিলেন নারী-পুরুষের সমান অধিকার নিয়ে। কিন্তু আজও নারী নির্যাতিত, নিপীড়িত। নারীর অধিকার সব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। আজও পুরুষের চেয়ে বেশি কাজ করে তারা পান কম পারিশ্রমিক। 

বুধবার (৮ মার্চ) বিশ্ব নারী দিবস উপলক্ষ্যে শরীয়তপুরের আরবিএম ইটের ভাটায় শ্রমিক হেলেনা খাতুনের সঙ্গে কথা হয় ঢাকা পোস্টের। তিনি বলেন, ইটের ভাটায় আমরা কাজ করি। নারী দিবস কী জানি না। কাজ করি, ট্যাকা (টাকা) পাই। তবে, পুরুষের চেয়ে বেশি কাজ করার পরও কম বেতন পাই।

শিউলি নামের আরেক নারী শ্রমিক বলেন, আমরা ইটের ভাটায় কাজ করি। গাড়ি টানি। স্বামী নির্যাতন করে আমাকে দিয়ে গাড়ি টানায়। রৌদ্রের মধ্যে কষ্ট করি। কিন্তু পুরুষের তুলনায় কম বেতন পাই। আমাদের নির্যাতন করে কাজ করায়। তবুও বেশি টাকা দেয় না।

তাবিয়া রহমান নামের এক শিক্ষার্থী বলেন, চলাচলের পথে নারীদের যাতায়াত ব্যবস্থা আজও নিরাপদ নয়। পাবলিক পরিবহনে নারীর জন্য সিট বরাদ্দ থাকলেও তারা তা পান না। পুরুষরা সাধারণত নারীর পোশাক, চলাচল নিয়ে বাজে মন্তব্য করে। এতে নারীর অধিকার ক্ষুণ্ন হয়। নারী পরিবার বা সমাজ কোথাও নিরাপদ নয়। 

আইনজীবী রাবেয়া খানম সম্পা বলেন, নারীরাই নারীদের দাবিয়ে রাখে। এ কারণে পুরুষরা সুযোগ পায়। আমার মা আমাকে বলেন, উচ্চ স্বরে কথা বলতে নেই। রাত দুপুরে বের হতে নেই। এভাবে মা-খালারা আমাদের দমিয়ে থাকতে শেখায়। তবে স্বাধীনতা মানে এই নয় যে আমরা নোংরাভাবে, উচ্ছৃঙ্খলভাবে চলব। এমন স্বাধীনতা আমরা চাই না। নারীকে যোগ্যতা দিয়ে স্বাধীনতার অধিকার আদায় করে নিতে হবে।

সরকারি গোলাম হায়দার খান মহিলা কলেজের শিক্ষক সামসুন্নাহার আফরোজা ঢাকা পোস্টকে বলেন, এক সময় নারীরা অনেক পিছিয়ে ছিল। সেই তুলনায় এখন কিন্তু অনেক এগিয়ে যাচ্ছে। এক সময় কিছু কিছু ক্ষেত্রে নারীরা কাজ করার কথা চিন্তাই করতেন না। পুলিশ, আর্মি, পাইলট, ডিফেন্সে নারীরা কিন্তু অংশগ্রহণ করছে। মেট্রোরেল চালাচ্ছে নারী। এটা একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন। নারীরা পুরুষের পাশাপাশি সমান তালে এগিয়ে যাচ্ছে। নারীকে তার সংসার সামলে কর্মক্ষেত্রে কাজ করতে হয়। নারীর অধিকার নিশ্চিত করার পথটা মসৃণ নয়। আমি চাই পুরুষরা নারীকে সম্মানের সঙ্গে তাদের প্রাপ্য অধিকার দিক।

শারীরিক প্রতিবন্ধী হয়েও আছমা বেগম একজন সফল নারী উদ্যোক্তা। তিনি বলেন, অনেক বাধা পেরিয়ে আজ আমি সফল উদ্যোক্তা হয়েছি। আমি যখন পেরেছি ইচ্ছাশক্তি থাকলে বাকি নারীরাও পারবে। সবার নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে।

শরীয়তপুরের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনের পরিচিত মুখ সামিনা ইয়াসমিন। তিনি একাধারে একজন সফল মা, সংগীত শিক্ষক ও সদর উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান। নারী দিবসে তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ৮ মার্চ এলে অনেকের মনে পড়ে নারীদের কত প্রতিবন্ধকতা, বাধা-বিপত্তি। সেগুলো আমি ছোট থেকে দেখে এসেছি। আজকের সফলতায় পৌঁছতে কত যে বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে, তার হিসেব নেই। নারী যখনই কোথাও পা ফেলে তখনই বাধার সৃষ্টি হয়। পুরুষরা বাঁকা চোখে দেখে। এগিয়ে যাওয়ার পথে কারও কোনো কথা না শুনে আমি এগিয়ে গিয়েছি। আমি প্রথম থেকেই চিন্তা করেছি এগিয়ে যাব। আমাকে আল্লাহ মেধা দিয়েছেন, শক্তি দিয়েছেন। কেন আমি পুরুষদের থেকে পিছিয়ে থাকব? আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী একজন নারী, স্পিকার একজন নারী।

‘আমি শিক্ষকতা করেছি, প্রতিবন্ধীদের জন্য স্কুল তৈরি করেছি, প্রায় ২৮ বছর ধরে সংগীতে শিক্ষকতা করি। নারীদের এগিয়ে নিতে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ নিয়েছি। প্রত্যন্ত গ্রামের নারীদের খবর দিয়ে এনে সেলাই মেশিনসহ অন্যান্য প্রশিক্ষণ দিয়েছি। আমি একজন রাজনীতিবিদ, জনগণের প্রতিনিধি। শরীয়তপুরের মহিলা ক্রীড়া জগতেও নারীদের নিয়ে কাজ করি আমি। সংগীত, রাজনীতি, নারী অধিকার নিয়ে কাজ করার পরও আমি আমার সংসার কিন্তু সুন্দরভাবে সাজিয়েছি। আমার শরীয়তপুর অনেক পিছিয়ে থাকা একটি জেলা। এই জেলার পুরুষরা যদি নারীদের সমদৃষ্টিতে দেখে তাহলে জেলার অনেক প্রতিভাবান নারী বাংলাদেশকে অনেক দূরে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে’— বলেন সামিনা ইয়াসমিন।

আরকে