২ মাসে আড়াই লাখ টাকার বরই বিক্রি করেছি
পাঁচ সদস্যের পরিবারে অভাবে কারণে লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়। ইচ্ছা থাকলেও লেখাপড়া বাদ দিয়ে পরিবারে চাহিদা মেটাতে বেরিয়ে পরেন কাজের সন্ধানে। কোনো কাজ না পেয়ে শুরু করেন কৃষিকাজ। কিন্তু ১০ বছর কৃষিকাজ করলেও পিছু ছাড়ছিল না দারিদ্র্য।
১৯ বছর আগে (২০০২ সালে) শখের বসে নিজ বাড়ির আঙিনায় দুটি বরইগাছের চারা রোপণ করেন। প্রথম বছর ওই দুটি বরইগাছে প্রচুর ফলন পাওয়ায় ক্ষুদ্র পরিসরে বাণিজ্যিকভাবে বরই চাষাবাদে শুরু করেন কৃষক দুলাল হোসেন। সেই থেকে শুরু বরই চাষাবাদ। দীর্ঘ ১৯ বছর ধরে তিল তিল করে গড়ে তুলেছেন বেশ কয়েকটি বরই-বাগান।
বিজ্ঞাপন
চলতি মৌসুমে ১০ বিঘা জমিতে বিভিন্ন জাতের বরই চাষাবাদ করেছেন দুলাল। কৃষিকাজে সাফল্য না পেলেও বরই চাষাবাদে দারিদ্র্য থেকে মুক্তি পেয়েছেন মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার জাগীর ইউনিয়নের চর উকিয়ারা গ্রামের কৃষক দুলাল হোসেন।
আপেলকুল, কাশ্মীরি আপেলকুল, নারিকেল কুল, সিটলেস কুল, বল সুন্দরী বরইসহ বিভিন্ন জাতের বরই রয়েছে তার বাগানে। কৃষিকাজে তেমন সাফল্য না পেলেও বরই চাষাবাদে দারিদ্র্য ঘুচে জীবন বদলে গেছে দুলাল হোসেনের। শুরুর দিকে মুনাফা কম হলেও এখন বরই চাষাবাদে বেশ লাভবান তিনি। বরই চাষাবাদে তার সাফল্য দেখে আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় দিন দিন বাড়ছে বরইচাষির সংখ্যা।
সরেজমিনে দুলাল হোসেনের তিনটি বরই-বাগান ঘুরে দেখা যায়, বাগানের বরইগাছ থেকে বরই সংগ্রহের কাজে ব্যস্ত শ্রমিকরা। বরইয়ের মৌসুম শেষের দিকে হলেও এখনো প্রতিটি গাছে প্রচুর পরিমাণ বরই রয়েছে। শ্রমিকরা গাছ থেকে বরই সংগ্রহ করছেন। স্কুল বন্ধ থাকায় দুলালের এক ছেলে রাসেলও বাবার সঙ্গে বরই-বাগানে এসেছে বরই সংগ্রহ করতে।
শুধু নিজেই সফল হননি। তার উদ্যোগের কারণে বরই-বাগানে স্থায়ীভাবে কাজের সুযোগ পেয়েছেন ৮ থেকে ১০ জন শ্রমিক। বরই-বাগানে ১৯ বছর ধরে কাজ করেন নারী শ্রমিক রেজিয়া (৭৫)। তার বাড়ি মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার চর উকিয়ারা গ্রামে। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় তার স্বামী মৃত কিতাব আলী তাকে ছেড়ে অন্যত্র চলে যান। তার একটি মেয়ে। মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন অনেক আগেই। নিজের জীবিকা জোগাতে কৃষিকাজ করেন।
তিনি আরও বলেন, মাটিও কাটাছি। বয়সের ভারে এখন আর ভারী কাজ করবার পারি না। তাই দুলালে বরই বাগানে কাজ করি। এইহান থাইক্কা যা পাই, তা দিয়া আমার দিন চলে যায়। দুলালও একসময় মেলা কষ্ট করছে। এহন আল্লাহ তারে বেশ ভালোই রাখছে।
বগুড়ার ধুনট উপজেলার পাঁচথবি গ্রামের শ্রমিক জামাল উদ্দিন বলেন, লেহাপড়া করি নাই আমরা মুখ্যুসুখ্যু মানুষ। কৃষিকাজ কইরা চলি। আগে কাজের লাইগা নানা জায়গায় ঘুরছি আর নিয়মিত কাজও পাওয়া কষ্টকর ছিল। তয় এহন আর সেই কষ্ট নাই। নিয়মিত দুলাল হোসেনের বরই-বাগানে কাজ করতে পারছি। ৪০০ টাকা রোজে কাজ করি। তাতে মাসে ১২ হাজার টাকা পাই। এই আয় দিয়েই দেশের বাড়িত খরচ চালাই আর পোলামাইয়াও বিয়াশাদি দিছি। এখানে কাজ কইরা বেশ ভালো আছেন বলে মন্তব্য করেন তিনি।
দুলাল হোসেন ঢাকা পোস্টেকে বলেন, ২০০২ সালে দুটি বরইগাছ দিয়ে চাষাবাদ শুরু করেন। ১৯ বছর পর সফলতার মুখ দেখেছেন। ১০ বিঘা জমি ভাড়া নিয়ে গড়ে তুলেছেন ছোট-বড় পাঁচটি বরই-বাগান। উন্নত এসব বরইয়ের স্থানীয় পাইকারি বাজারে বেশ চাহিদাও রয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
তিনি বলেন, তার এসব বরই-বাগানে মৌসুমে ৮ থেকে ১০ জন শ্রমিক কাজ করেন। আর সারা বছর কাজ করেন তিন থেকে চারজন শ্রমিক। নিজের ভাগ্যোন্নয়নের পাশাপাশি তার স্থায়ীভাবে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাও হয়েছে এসব শ্রমিকের। অন্যের ভাড়া করা জমিতে গড়ে তোলা এই পাঁচটি বরই-বাগানে বিভিন্ন জাতের প্রায় ৮০০ বরইগাছে বয়েছে।
ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, ১০ বিঘা জমির ভাড়া বাবাদ প্রতিবছর দিতে হয় ৮০ থেকে ৯০ হাজার টাকা। এ ছাড়া শ্রমিকের খরচসহ অন্যান্য সব খরচ মিলে প্রতিবছর মোট খরচ হয় প্রায় দুই লাখ টাকা। তাতে বিঘা প্রতি খরচ পরে প্রায় ২০ হাজার টাকা। আর এক বিঘা জমিতে ১০০টি চারাগাছ রোপন করা যায়। রোপণের এক বছর পর থেকেই বরইগাছ থেকে ফল পাওয়া যায়। প্রথম বছর প্রতিটি গাছ থেকে ২০ থেকে ২৫ কেজি ফল পাওয়া যায়। তবে বরইগাছে বয়স চার থেকে পাঁচ বছর হলেই ফলন বেড়ে যায়। তখন ১০০টি গাছ থেকে ৫০ মণ বরই পাওয়া যায় অনায়াসে। যার বাজার মূল্য প্রায় এক লাখ টাকা।
তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, চলতি বছর পাইকারি বাজারদর কিছুটা কম। করোনার কারণে স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকায় পাইকাররা তেমন বরই কিনছেনন না। তবে এবার পাইকারি বাজারে দেড় থেকে দুই হাজার টাকা মণ বরই বিক্রি করেছি। প্রতিবছর জানুয়ারির শেষের দিকে গাছ থেকে বরই সংগ্রহ শুরু হয় আর ফলন তোলা শেষ হয় মার্চে। দেড় দুই মাস থাকে এই বরইয়ের বাজার।
এ বছর মোট খরচ হয়েছে প্রায় দুই লাখ টাকা। আর এখন পর্যন্ত বরই বিক্রি করেছি আড়াই লাখ টাকা। সামনে আরও ৫০ হাজার টাকার বরই বিক্রি করতে পারবেন বলে জানান কৃষক দুলাল হোসেন।
মানিকগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক মো. শাহ্জাহান আলী বিশ্বাস ঢাকা পোস্টকে বলেন, গত মৌসুমে মানিকগঞ্জে ৭৭ হেক্টর জমিতে বাণিজ্যিকভাবে বিভিন্ন জাতের বরই চাষাবাদ হয়েছিল। তবে চলতি মৌসুমে বরই চাষাবাদের পরিমাণ আরও বাড়বে। অল্প খরচে বেশি লাভবান হওয়ায় দিন দিন জেলার কৃষকদের মাঝে বরই চাষাবাদে আগ্রহ বাড়ছে বলে জানান তিনি।
সোহেল হোসেন/এনএ