ব্যবহৃত একটি মোটরসাইকেল পিরোজপুর থেকে কিনে মালিকানা পরিবর্তনের জন্য জেলা বিআরটিএতে এসে ১৬ হাজার টাকা দিয়েছি। নয় মাস ধরে ঘুরছি, আজও মালিকানা পরিবর্তন হয়নি। এক মাসের মধ্যে এসএমএস আসার কথা। কিন্তু সেই তারিখ চার মাস পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখনও এসএমএস আসেনি।

আবারও চার মাসের মেয়াদ দেওয়া হয়েছে। নয় মাসে মোট চারবার এসেছি, কিন্তু কাজ হয়নি। যার কাছেই যাব টাকা ছাড়া কাজ হয় না। ব্যবহারের কথা তো বাদই দিলাম। আমি যে এত দূর থেকে কষ্ট করে আসি, সেটা যেন তারা বোঝেই না— এভাবে ক্ষোভের কথা জানাচ্ছিলেন দিনাজপুর সদর উপজেলার খানসামা ইউনিয়ন থেকে পিরোজপুর বিআরটিএতে আসা বেলাল হোসেন।

পিরোজপুর বিআরটিএ’র সার্বিক হালচাল জানতে গতকাল রোববার (২৬ ফেব্রুয়ারি) দিনব্যাপী জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের দ্বিতীয় তলায় অবস্থিত বিআরটিএ অফিসে চোখ রাখে ঢাকা পোস্ট। এ সময় গ্রাহকদের প্রতি কর্তৃপক্ষের অবহেলা, ভোগান্তি, আর্থিক লেনদেন ও দালালদের দৌরাত্ম্যসহ নানা অনিয়ম দেখা যায়।

সকাল সাড়ে ৯টার আগে অফিসে আসেননি সেবাদানকারী কেউ। এরপর আস্তে আস্তে অফিসে আসেন সবাই। সেখানে কথা হয় দালাল চক্রের সদস্য ইদ্রিস আলীর সঙ্গে। তিনি অতিরিক্ত টাকার বিনিময়ে লাইসেন্স করিয়ে দিতে রাজি হন। পেশায় তিনি একজন মোটরসাইকেল চালক

দালালের শরণাপন্ন হলে সহজেই হয়ে যায় সব কাজ। কর্তৃপক্ষ বলছে, এমন কিছু নেই ওই অফিসে। থাকলে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

জানা যায়, বিআরটিএ পিরোজপুর সার্কেল কার্যালয় থেকে ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অপেশাদার লাইসেন্স পেয়েছেন এক হাজার ৭০৫ জন। পেশাদার লাইসেন্স পেয়েছেন ৫০৩ জন। রেজিস্ট্রেশন দেওয়া হয়েছে দুই হাজার ১৯টি যানবাহনকে।

এই অফিসে লোকবলের সংকট রয়েছে। এখানে আটটি পদের বিপরীতে কাজ করছেন চারজন।

সরেজমিনে দেখা যায়, সকাল সাড়ে ৯টার আগে অফিসে আসেননি কেউ। এরপর আস্তে আস্তে অফিসে আসেন সবাই। সেখানে কথা হয় দালাল চক্রের সদস্য ইদ্রিস আলীর সঙ্গে। তিনি অতিরিক্ত টাকার বিনিময়ে লাইসেন্স করিয়ে দিতে রাজি হন। পেশায় তিনি একজন মোটরসাইকেল চালক। অফিস শুরুর পর থেকে দুপুর পর্যন্ত তিনি চারপাশে ঘুরে ঘুরে সেবাগ্রহীতাদের ম্যানেজ করার চেষ্টা করেন। ‘সাংবাদিক’ পরিচয় জানতে পেরে সেবা নিতে আসা সবাইকে সতর্ক করে দেন তিনি। এরপরও কথা হয় বিভিন্ন স্থান থেকে আসা সেবাগ্রহীতাদের সঙ্গে।

নাজিরপুর থেকে আসা মহিদুল ইসলাম বলেন, গাড়ি বিক্রি করব। এ কারণে মালিকানা পরিবর্তন করতে এসেছি। কিন্তু অফিসে কোনো লোক নেই। যারা ছিল তারা বলেছে পরে আসেন।

মঠবাড়িয়ার বাসিন্দা এবং স্থানীয় এনজিওকর্মী (ব্র্যাক) আব্দুর রহিম বলেন, মাদারীপুর থেকে এসেছি ড্রাইভিং লাইসেন্স করার জন্য। শরীয়তপুর থেকে গাড়ি কিনেছি। এখানে এসে বিভিন্ন ধরনের হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। অফিস থেকে বলে, এটা নাই, ওটা নাই। সার্ভারের সমস্যাসহ নানা অজুহাত তাদের।

‘বরিশাল যাওয়ার পথে পুলিশের মামলার শিকার হয়েছি। বৃহস্পতিবার এসেছিলাম। কিন্তু সার্ভারের সমস্যার কথা বলে ফিরিয়ে দিয়েছে। অথচ ঠিকই এক হাজার টাকা নিয়েছে। আজ (রোববার) আসতে বলেছিল। তদবির ছাড়া এখানে কোনো কাজ হয় না। কথা বলার কোনো জায়গা নেই, কথা শোনার লোক নেই। সরকারের কাছে আবেদন, বিআরটিএকে স্বচ্ছ করুন। মানুষের ন্যূনতম সেবা নিশ্চিত করুন।

রবিউল ইসলাম শামীম নামে এক ভুক্তভোগীর অভিযোগ, পিরোজপুর কারিগরি প্রশিক্ষণকেন্দ্র (টিটিসি) থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েছি। পরীক্ষায় পাসের পর বিআরটিএতে ফাইল জমা দিয়েছি। ফিঙ্গার প্রিন্টে দেরি হয় বলে তাদের টাকা দিয়েছি। বৃহস্পতিবার সার্ভারে সমস্যা বলে সারাদিন বসিয়ে রেখেছে। আজ (রোববার) আবার আসার পর অন্য সমস্যা দেখাচ্ছে। বলছে, স্যার ফাইল আটকে দিয়েছে। টিটিসি থেকে ট্রেনিং করে পাস করেছি, এরপরও লাইসেন্স পাই না। এর চেয়ে কষ্টের কী আছে?

এ বিষয়ে দালাল চক্রের সদস্য ইদ্রিস আলী বলেন, যারা এখানে আসতে পারেন না, আমি তাদের সহযোগিতা করি। বিআরটিএ অফিসে আমি যাত্রী নিয়ে আসি। আবার ওখান থেকে চলে যাই। বিআরটিএ অফিসের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নাই।

এসব বিষয়ে কথা বলতে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) পিরোজপুর সার্কেল কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক প্রকৌশলী মো. মাহবুবুর রহমানের কক্ষে গেলে সেখানে দালাল চক্রের সদস্য ইদ্রিস আলীকেও পাওয়া যায়। ইদ্রিস আলীসহ অন্য দালালদের দৌরাত্ম্য ও অনিয়মের বিষয়ে কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি সহকারী পরিচালক। তিনি বলেন, ‘আমার কক্ষ খোলাই থাকে, সেখানে যে কেউ, যেকোনো সময়ে আসতে পারেন’।

‘আমাদের সঙ্গে দালালদের কোনো সম্পর্ক নাই। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা রয়েছে। আগে যে সমস্যাগুলো ছিল, আমি আসার পর তার বেশির ভাগের সমাধান হয়েছে। এখনও আমাদের লোকবলের সংকট রয়েছে। তারপরও আমরা যথাযথ সেবা দেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’

সময় মতো লাইসেন্স সরবরাহ করতে না পারার বিষয়ে তিনি বলেন, লাইসেন্সের কাঁচামাল বিদেশ থেকে আসে। তাই দেরি হয়। এছাড়া মালিকানা পরিবর্তনের বিষয়টি আমরা তিন/চার দিনের মধ্যে সম্পন্ন করার চেষ্টা করি। টিটিসি, আনসার-ভিডিপি, টিএসসি’র সহযোগিতায় দক্ষ চালক তৈরি করা হচ্ছে। সেখানে প্রশিক্ষণ শেষে যারাই আসছেন তাদের সবার কাগজ নিয়ে ডেলিভারি স্লিপ দেওয়া হচ্ছে। অযথা কাউকে হয়রানি করা হচ্ছে না।

যথাসময়ে অফিসে না আসার বিষয়ে তিনি বলেন, লোকজন না আসলেও তো কাজ শুরু হয় না। তাই একটু দেরি হয়। আমার এক স্টাফের বাড়ি গোপালগঞ্জ। পরিবারকে সময় দিয়ে তার আসতে একটু সময় লাগে। আজ আমি একটু ডিসি অফিসে গিয়েছিলাম। এ কারণে আসতে একটু দেরি হয়েছে।

এমএআর/