বিশ্ব ভালবাসা দিবস আজ। সারাবিশ্বের ন্যায় বাংলাদেশও আনন্দ উল্লাসের সঙ্গে পালন হয় দিনটি। আনন্দ দিগুণ করতে এই দিনটিতে আগমন ঘটেছে বাংলার ঋতুরাজ বসন্তের। এই দিবস ঘিরে টানা পরিশ্রম করেছেন সাভারের গোলাপ চাষিরা। বাগান জুড়ে সাজিয়েছেন গোলাপের সমারোহ। দৃষ্টিজুড়ে ভালোবাসার প্রতীক লাল গোলাপের রাজ্য। এ রাজ্যের রাজা যেন দেড় হাজার গোলাপ চাষি। ফুলের ফলন অনুযায়ী প্রায় ২০ কোটি টাকার ফুল বিক্রি হবে বলে ধারণা সাভার উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার। 

অপার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে বিস্তীর্ণ সাভারের বিরুলিয়া। লাল গোলাপে ছেয়ে আছে পুরো এলাকা। ইউনিয়নটি সারাদেশে শুধুমাত্র গোলাপ চাষের জন্য বর্তমানে পরিচিতি পেয়েছে গোলাপ গ্রাম নামে। শ্যামপুর, সাদুল্লাহপুর, মৈস্তাপাড়া, বাগ্নিবাড়ি, বাটুলিয়া ও কমলাপুর গ্রাম মিলে এই নামকরণ হয়েছে। প্রতিদিন দূর-দূরান্ত থেকে সৌন্দর্য পিপাসুরা আসেন গোলাপের সৌন্দর্য আর ঘ্রাণ নিতে। 

কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, বিরুলিয়ার প্রায় ৬ থেকে ৭টি গ্রামের ৩৫০ হেক্টর জমিতে ফুলের চাষ হয়। শুধু গোলাপ নয়, এখানে মিরিন্ডা গোলাপ, চায়না গোলাপ, ইরানি গোলাপ, জারবেরা, রজনীগন্ধা, গ্লাডিওলাস, চন্দ্র মল্লিকা ফুলের চাষ করছেন চাষিরা। এসব ফুল চাষ করছেন বিরুলিয়ার প্রায় ১৫০০/১৬০০ চাষি। আর এসব বাগানে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন প্রায় সাড়ে তিন হাজার শ্রমিক। গোলাপ বিক্রির জন্য শ্যামপুর ও মৈস্তাপাড়ায় গড়ে উঠেছে ফুলের বাজার। ফুল সংগ্রহ করে বিকেল এই বাজারে নিয়ে যান চাষিরা। প্রতিদিন প্রায় লাখ টাকার ফুল বিক্রি হয় এই দুই বাজারে। দেশের বিভিন্ন এলাকার ও স্থানীয় পাইকাররা এসব ফুল কিনে বিভিন্নস্থানে বিক্রি করেন।

গোলাপ চাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মহামারি করোনা ভাইরাসের সংক্রমণে দেশ যখন স্থবির, তখন যেন অসহায় হয়ে পড়েছিলেন তারা। ওই সময় সমস্ত অনুষ্ঠানে নিষেধাজ্ঞা থাকায় গাছের ফুলের সঙ্গে শুকিয়ে যায় গোলাপ চাষির স্বপ্ন। টানা দুই থেকে আড়াই বছর জুড়ে ছত্রাক ও করোনার প্রভাবে লাভের মুখ দেখেননি তারা। তাই এবার চাষিরা প্রতিটি বাগানে সর্বোচ্চ পরিচর্যা করেছেন ভালো ফলাফলের আশায়। এবার ফলনও হয়েছে আশানুরূপ। প্রায় ২০ কোটি টাকার ফুল বিক্রি হতে পারে বলে জানান চাষিরা।

মূলত ডিসেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত গোলাপের মৌসুম। যদিও নানা ধরনের অনুষ্ঠান, বিয়ে, বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস, ভাষা দিবস ঘিরে বেচাকেনা হয় গোলাপ। এছাড়া সারাবছরই বিক্রি হয় ফুল। তবে বিভিন্ন দিবস ছাড়া ফুল বিক্রি তেমন জমে উঠে না।

ফুল চাষি সোলাইমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি ঋণ নিয়ে বাগান করেছিলাম। গত দুই বছরে ছত্রাক আর করোনা অর্থনৈতিকভাবে আমাকে পঙ্গু করে দিয়েছিল। অনেক কষ্ট করে এবার সেই লোকসান পূরণের জন্য দিন রাত শ্রম দিয়েছি। বাগানে অনেক ভালো ফলন হয়েছে। বাগানের দিকে তাকালেই দুই বছরের কষ্টের কথা মনে থাকে না। এবার সব ঋণ পরিশোধ করে ভালো চলতে পারব। আল্লাহ দুই বছরের ফলন দিয়েছে এবার।

অপর চাষি আজিজুল বলেন, এবার ভালো ফলন হয়েছে সত্যি, কিন্তু আর্টিফিশিয়াল ফুলের জন্য আমরা ভয়ে আছি। যেকোনো সময় আমাদের ফুলের বাজার ধংস করতে পারে এই প্লাস্টিকের ফুল। আমরা সারা বছর কয়েকটা দিবসের আশায় থাকি। এসব দিবসে মূলত আমরা লাভের মুখ দেখি। তবে প্লাস্টিকের ফুল ধীরে ধীরে বাজার দখল করছে। এসব ফুল আমদানি বন্ধ না হলে গোলাপ চাষিদের হুমকির মুখে পড়তে হবে।

ফুলচাষি শহিদুল ইসলাম বলেন, আমাদের পুরো গ্রাম গোলাপ গ্রাম নামে পরিচিত করে দিয়েছেন সাংবাদিক ও ইউটিউবার। তাদের প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ। তবে বহুল প্রচারে আমাদের নানা প্রতিকুলতার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা দর্শনার্থীরা বাগানে ঢুকে পড়ছেন, ছবি তুলছেন এতে করে গোলাপের ডাল ভেঙে যাচ্ছে। গোলাপ গাছের গোড়ার মাটি শক্ত হয়ে যাচ্ছে। ফলে সামান্য লোকসান গুনতে হচ্ছে। তাদের সারা দিন পাহারা দিতে হচ্ছে। দর্শনার্থীরা যদি এদিকটা একটু খেয়াল রাখে তাহলে আমাদের একটু ভাল হতে।

এদিকে দেশের নানা স্থান থেকে ফুলের সৌন্দর্য আর প্রকৃতি দেখতে গোলাপ বাগানে ভিড় জমায় হাজার হাজার সৌন্দর্য পিপাসু। গোলাপ গ্রামে ঘরতে আসা আফজাল হোসেন বলেন, আমি গাজীপুর থেকে পুরো পরিবার নিয়ে গোলাপ বাগানে এসেছি। এতোদিন শুধু ইউটিউবে দেখেছি। আজ বাস্তবে দেখলাম সত্যিই গোলাপ গ্রাম অসম্ভব সুন্দর।

ইট পাথরের শহর ছেড়ে নারায়ণগঞ্জ থেকে বিশুদ্ধ শ্বাস নিতে গোলাপ গ্রামে এসেছেন শহিদুল্লাহ্। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, গোলাপ গ্রাম মানুষের তৈরি হলেও প্রাকৃতিক এখানে শতভাগ। এসে অনেক উপভোগ করলাম। একই সাথে বেশ কিছু গোলাপও কিনেছি আগামীকালের জন্য। এখানে গোলাপের দামও অনেক কম। সব মিলিয়ে যে কারও এখানে আসলে প্রান ভরে যাবে। তবে এখানে খাবার কোন ব্যবস্থা নেই। ভাল খাবার ও পয়োনিষ্কাশনের ব্যবস্থা থাকলে দর্শনার্থীদের জন্য আরও ভালো হতো।

সাভার উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা নাজিয়াত আহমেদ বলেন, আমরা সাভার কৃষি অফিস থেকে সর্বদা ফুলচাষীদের পাশে থেকে পরামর্শ দিয়ে এসেছি। যাতে করে গত তিন বছরের যে লোকসান ও ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিল ফুল চাষিরা সেটি যেন কাটিয়ে উঠতে পারে। এবার ফুলের ফলন অন্যান্য বারের তুলনায় অনেক ভালো হয়েছে। একই সঙ্গে ফুলের ন্যায্যমূল্যের জন্য কৃষি বিভাগ থেকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করা হচ্ছে। ফুলের ফলন অনুযায়ী প্রায় ২০ কোটি টাকার ফুল বিক্রি হবে বলে আমরা ধারণা করছি।

প্রসঙ্গত, ১৯৯০ সালের দিকে সাবেদ আলী নামের এক ব্যক্তি বিরুলিয়ার সাদুল্লাপুরে গোলাপের চাষ শুরু করেন। গোলাপ চাষ উপযোগী মাটি, ভাল ফলন ও লাভজনক হওয়ায় পরবর্তীতে এ অঞ্চলে গোলাপ চাষে অনেকে ঝুঁকতে থাকে। এই সাবেদ আলীর দেখানো পথে অনেক কৃষক এবং বেকার যুবকরা গোলাপ চাষের সঙ্গে যুক্ত হয়। পর্যায়ক্রমে অন্যান্য গ্রামেও গোলাপের চাষ শুরু হলে এলাকার মানুষের পেশা ও ভাগ্য দ্রুত বদলে যেতে থাকে। ধীরে ধীরে ওই এলাকার নাম হয় গোলাপ গ্রাম। বর্তমানে প্রায় ৬ গ্রামের ৯০ শতাংশ বাসিন্দা গোলাপ চাষ করে ভাগ্য পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখছেন।

মাহিদুল মাহিদ/আরকে