বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর জেলে যেতে হয়েছিল সাহাবুদ্দিনকে
বাংলাদেশের ২২তম রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে মনোনয়ন পেয়েছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. সাহাবুদ্দিন চুপ্পু। ইতিপূর্বে ডেপুটি স্পিকার ও মন্ত্রীসহ বাংলাদেশ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করলেও রাষ্ট্রপতি পদে এই প্রথম পাবনা জেলার কেউ দায়িত্ব পেতে যাচ্ছেন। ফলে আনন্দের যেন শেষ নেই পাবনাবাসীর। পাবনার এই কৃতী সন্তানের এমন অর্জনে জেলায় আনন্দের বন্যা বইছে। আনন্দমিছিল থেকে শুরু করে মিষ্টি বিতরণ। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পাশাপাশি সাধারণ মানুষও আনন্দ-উল্লাস প্রকাশ করছেন।
রোববার (১২ ফেব্রুয়ারি) সকালে রাষ্ট্রপতি পদে মনোনয়ন পাওয়ার খবর প্রকাশ হওয়ার পরপরই তাৎক্ষণিকভাবে পাবনা শহরে আনন্দমিছিল বের করে আওয়ামী লীগ। জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি রেজাউল রহিম লালের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগসহ অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের শতাধিক নেতাকর্মী অংশগ্রহণ করেন। জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ের সামনে থেকে মিছিলটি বের হয়ে শহরের প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে আবার কার্যালয়ের সামনে গিয়ে শেষ হয়।
বিজ্ঞাপন
এ সময় রিকশাচালক, ভ্যানচালক, ফুটপাতের দোকানদারসহ পথচারীদের মাঝে মিষ্টি বিরতণ করা হয়। এরপর দিনব্যাপী আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন ও সামাজিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ বিশাল বিশাল আনন্দমিছিল বের করে। মিছিল শেষে মিষ্টিও বিতরণ করা হয়। পাবনা থেকে প্রথমবারের মতো রাষ্ট্রপতি মনোনয়ন দেওয়ায় প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন পাবনার সাধারণ মানুষ।
সুশীল সমাজের প্রতিনিধি মির্জা আজাদ বলেন, আমাদের সম্মানিত অভিভাবক, পাবনার কৃতী সন্তান মো. সাহাবুদ্দিন চুপ্পু বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ায় আন্তরিক অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। তিনি একজন সজ্জন ব্যক্তি। পাবনার সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিত্ব। বিশেষত পাবনা প্রেসক্লাবের আজীবন সদস্য। একজন যোগ্য মানুষকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে মনোনয়ন দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।
পাবনা প্রেসক্লাবের সভাপতি এবিএম ফজলুর রহমান বলেন, পাবনা প্রেসক্লাবের আজীবন সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. সাহাবুদ্দিন চুপ্পু মনোনয়ন পাওয়ায় পাবনার সাংবাদিবৃন্দ গর্বিত। তিনি এক সময় সাংবাদিকতা করতেন। সাংবাদিক থেকে রাষ্ট্রপতি হওয়ায় আমরা খুবই আনন্দিত।
পাবনা ডায়াবেটিক সমিতির সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা বেবী ইসলাম বলেন, তিনি ছোটবড় সবার সঙ্গে বন্ধুসুলভ আচরণ করেন। তিনি নিজের চিন্তা না করে এলাকার সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের কথা চিন্তা করেন। সবসময় পাবনাসহ দেশের উন্নয়ন নিয়ে ভাবেন। সর্বোপরি দেশের ২২তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে যোগ্য ব্যক্তিকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে।
পাবনা জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা আসম আব্দুর রহিম পাকন বলেন, একজন সাদাসিধে মানুষ মো. সাহাবউদ্দিন চুপ্পু। তিনি সর্বস্তরের মানুষের কাছে একজন প্রিয় ব্যক্তিত্ব। মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষ থেকে অভিনন্দন।
পাবনা জেলা যুবলীগের আহ্বায়ক আলী মুর্তজা বিশ্বাস সনি বলেন, ১৯৭৪ সালে শেখ মনির অনুরোধে বঙ্গবন্ধু মো. সাহাবুদ্দিন চুপ্পুকে পাবনা জেলা যুবলীগের সভাপতি করেন। তিনি বরাবরই পাবনার মানুষের জন্য উন্নয়নমূলক চিন্তা ও কাজ করেছেন। তার মতো ব্যক্তির মনোনয়ন পাওয়া পাবনার সর্বস্তরের মানুষের জন্য গর্ব ও আনন্দের।
মো. সাহাবুদ্দিন চুপ্পু মনোনয়ন পাওয়ায় বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন তার সহপাঠী ও বন্ধুরা। তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু পাবনার বিশিষ্ট সমাজসেবক মোক্তার হোসেন বলেন, প্রথম শ্রেণি থেকে এসএসসি, এইচএসসি একসঙ্গে পড়াশোনা করেছি। মুক্তিযুদ্ধেও অংশ নিয়েছি আমরা। আমি জানি চুপ্পু কতটা উদার ও ভালো মনের মানুষ। সে সবসময়ই দেশ ও মানুষকে নিয়ে ভাবে। তার রাষ্ট্রপতি মনোনয়ন পাওয়া একজন যোগ্য মানুষের পাওয়া। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি রেজাউল রহিম লাল বলেন, যখন রাষ্ট্রপতির খবর শুনলাম তখন কী যে ভালো লাগলো বলে বুঝানো যাবে না। একজন তৃণমূল পর্যায়ের কর্মী, এরপর জেলা ছাত্রলীগ নেতা। উনার জীবনে অনেক ইতিহাস আছে। উনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি আমাদের একজন নেতা ছিলেন। আমি রফিকুল ইসলাম বকুল, মো. সাহাবুদ্দিন চুপ্পু, আব্দুর রহিম পাকনসহ অনেককেই একসঙ্গে রাজনীতি করেছি। তার নেতৃত্ব আমরা মানতাম। চুপ্পু একজন সৎ ছেলে এবং একজন দক্ষ সংগঠক। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি আনুগত ছিলেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার পরে নানাভাবে প্রতিশোধ নেওয়ার চেষ্টা করেছিল। স্বাধীনতার পরে চুপ্পুসহ আমরা ভারতে অনেক দিন পালিয়েছিলাম। সেই তৃণমূল থেকে উঠে আসা একজন দক্ষ নেতাকে ২২তম রাষ্ট্রপতি মনোনয়ন দেওয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কথা পাবনাবাসী আজীবন মনে রাখবে।
পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, মো. সাহাবুদ্দিন চুপ্পু ১৯৪৯ সালে পাবনা শহরের জুবিলি ট্যাঙ্কপাড়ায় (শিবরামপুর) জন্মগ্রহণ করেন। পিতা শরফুদ্দিন আনছারী ও মাতা খায়রুন্নেসা। তিনি পাবনা শহরের পূর্বতন গান্ধি বালক বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত অধ্যয়ন করে রাধানগর মজুমদার একাডেমিতে চতুর্থ শ্রেণিতে ভর্তি হন। ১৯৬৬ সালে এসএসসি পাস করার পর পাবনার ঐতিহ্যবাহী সরকারি এডওয়ার্ড কলেজ থেকে ১৯৬৮ সালে এইচএসসি ও ১৯৭১ সালে (অনুষ্ঠিত ১৯৭২সালে) বিএসসি পাস করেন। পরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৭৪ সালে মনোবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর এবং পাবনা শহিদ অ্যাডভোকেট আমিনুদ্দিন আইন কলেজ থেকে ১৯৭৫ সালে এলএলবি ডিগ্রি অর্জন করেন।
তিনি ছাত্রজীবনে পাবনা জেলা ছাত্রলীগের সক্রিয় কর্মী ও ১৯৭০ সালে পাবনা জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭২ সালে পাবনা জেলা যুবলীগের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পান।
মো. সাহাবুদ্দিন চুপ্পু মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। পাবনা জেলা আইনজীবী সমিতির সদস্য হিসেবে সাহাবুদ্দিন চুপ্পু আইন পেশায় যোগ দেন এবং ১৯৮২ সাল পর্যন্ত এই পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। পরে ১৯৮২ সালে বিসিএস (বিচার) ক্যাডার হিসেবে যোগ দেন মো. সাহাবুদ্দিন চুপ্পু। বিচারকের বিভিন্ন পদে চাকরি শেষে ২০০৬ সালে জেলা ও দায়রা জজ হিসেবে অবসর নেন।
২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় আসার পর পরই আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা হয়। যাতে হত্যা, ধর্ষণ ও লুণ্ঠনের ঘটনা ঘটে। পরে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে সেসব ঘটনার তদন্তে কমিশন গঠন করে, যার প্রধান ছিলেন মো. সাহাবুদ্দিন চুপ্পু।
২০১১ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত সাহাবুদ্দিন চুপ্পু দুর্নীতি দমন কমিশনের কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। আওয়ামী লীগের দুঃসময়ের অন্যতম কাণ্ডারি হিসেবে পরিচিত মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন চুপ্পু পাবনা ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনেরও সভাপতি।
মো. সাহাবুদ্দিন চুপ্পু ১৯৯৫ ও ১৯৯৬ সালে পরপর দুই বার বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের কেন্দ্রীয় কমিটির মহাসচিব নির্বাচিত হন। পেশাগত জীবনে প্রথম দিকে সাংবাদিকতাও করেছেন। তিনি পাবনা প্রেসক্লাব ও অন্নদা গোবিন্দ পাবলিক লাইব্রেরির আজীবন সদস্য।
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হলে মো. সাহাবুদ্দিন চু্প্পুকে সামরিক আইন বলে গ্রেপ্তার করে অমানুষিক নির্যাতন করা হয়। কারাভোগের পর মুক্ত হলে তিনি পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। দুদকের কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে বিশ্বব্যাংকের কথিত পদ্মা সেতু সংক্রান্ত দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তে অন্যতম মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। তার প্রেরিত তদন্ত প্রতিবেদন কানাডা কোর্ট কর্তৃক সমর্থিত হয়।
সর্বশেষ তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা উপ-কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
১৯৭২ সালের ১৬ নভেম্বর পাবনা শহরের দিলালপুরের আলী আকতারের জ্যেষ্ঠ কন্যা ড. রেবেকা সুলতানার সঙ্গে মো. সাহাবুদ্দিন চুপ্পু বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। রেবেকা সুলতানা বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারে যোগ দিয়ে যুগ্ম সচিব হিসেবে ২০০৯ সালে অবসরে যান। চুপ্পু-রেবেকা দম্পতির একমাত্র সন্তান মো. আরশাদ আদনান (রনি) দেশে ও বিদেশে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে বর্তমানে প্রাইম ব্যাংকের উচ্চপদে কর্মরত।
এমজেইউ