মেঘনা নদীর মাছ শিকার করছে একটি প্রভাবশালী সিন্ডিকেট

অবৈধভাবে বাঁশ পুঁতে জাল দিয়ে ঘের তৈরি করে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলায় মেঘনা নদীর মাছ শিকার করছে একটি প্রভাবশালী সিন্ডিকেট। এতে ধ্বংস হচ্ছে মৎস্যসম্পদ ও জীববৈচিত্র্য। 

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এক দশক ধরে শীতলক্ষ্যা, বুড়িগঙ্গা নদী ও ব্রহ্মপুত্র নদের পানি কলকারখানার দুষিত বর্জ্যে নষ্ট হয়ে গেছে। এসব নদ-নদীতে মাছ নেই বললেই চলে।

তবে গজারিয়া থেকে সোনারগাঁ হয়ে আড়াইহাজার উপজেলার বিশনন্দী ফেরিঘাট পর্যন্ত ২৫ কিলোমিটার এলাকায় মেঘনার পানি স্বচ্ছ। যদিও কয়েক বছর ধরে স্থানীয় কিছু কারখানার বর্জ্য এখানেও পড়ছে। এরপরও অনেক মাছ রয়েছে। 

দেশি কই, শিং, মাগুর, পুঁটি, রুই, কাতল, কাচকি, বোয়াল, টেংরা, পাবদা ও মলাইসহ নানা প্রজাতির মাছ প্রতিদিন ভোরে সোনারগাঁয়ের বৈদ্যেরবাজার ফিশারি ঘাটে বিক্রি হয়। এসব মাছ মেঘনা নদীর। স্থানীয়দের চাহিদা মিটিয়ে এসব মাছ বিভিন্ন বাজারে যায়। এসব সুস্বাদু মাছের স্বাদ নিতে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ থেকে অনেক মানুষ প্রতিদিন বৈদ্যেরবাজার ফিশারি ঘাটে ভিড় জমান। 

নদীর ২৫ কিলোমিটার এলাকা দখল করেছে প্রভাবশালী একটি সিন্ডিকেট

কিন্তু কয়েক বছর ধরে মেঘনার এই ২৫ কিলোমিটার এলাকা দখল করেছে প্রভাবশালী একটি সিন্ডিকেট। বাঁশ ও গাছের ডালপালা ব্যবহার করে নদীতে ছোট জাল ফেলে ঘের দিয়ে পোনা মাছসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ শিকার করছে তারা।

সরেজমিনে দেখা যায়, মেঘনা নদীর ওসব এলাকায় কয়েকশ ঘের দেওয়া হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ঘের দেওয়া হয়েছে মাছের অভয়াশ্রম হিসেবে পরিচিত নুনেরটেক এলাকায়। 

অনুসন্ধানে জানা যায়, স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাদের সহযোগিতায় তিন বছর ধরে একটি সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। সিন্ডিকেটের সদস্যরা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী। এসব ঘের তদারকি করছেন তারা।

নুনেরটেক গ্রামের জেলে আলী আহমদ বলেন, স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা সিন্ডিকেট করে নদীতে ঘের দেওয়ায় শত শত জেলে বেকার হয়েছেন। ঘেরের কারণে নদীতে জাল ফেলতে পারি না। ঘেরের সামনে জাল ফেললে মারধর করেন সিন্ডিকেটের সদস্যরা।

স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাদের সহযোগিতায় তিন বছর ধরে একটি সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে

নুনেরটেক উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মুহাম্মদ শাহজালাল বলেন, কয়েক বছর ধরে নদীর বেশির ভাগ অংশে ঘের দেওয়ায় মৎস্যসম্পদ ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। জেলেরা বেকার হয়ে পড়েছেন। নদীতে নৌ-যান চলাচলে ব্যাঘাত ঘটছে।

বৈদ্যেরবাজার ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আব্দুর রউফ বলেন, প্রশাসনের চোখের সামনে মৎসসম্পদ ধ্বংস করছে সিন্ডিকেট। মৎস্য আইন অমান্য করে বিপুল পরিমাণ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে তারা। প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। একাধিকবার বিষয়টি প্রশাসনকে জানিয়েছি।

সাত ভাইয়াপাড়া গ্রামের জেলে মুকবুল হোসেন বলেন, একটি ঘেরে ১০-১২ লাখ টাকার মাছ পাওয়া যায়। অর্ধেক টাকা নেতাদের দিতে হয়। বাকিটা সিন্ডিকেটের সদস্য ও জেলেদের মাঝে ভাগাভাগি হয়।

সিন্ডিকেট করে নদীতে ঘের দেওয়ায় শত শত জেলে বেকার হয়েছেন

বারদি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি জহিরুল হক বলেন, শুধু আওয়ামী লীগ নেতারা ঘের নিয়ন্ত্রণ করেন না; বিএনপির কিছু নেতাও জড়িত আছেন।

নুনেরটেক গ্রামের বাসিন্দা হোসেন মিয়া বলেন, আমি চারটি ঘের দিয়েছি। এখান থেকে যা আয় হয়; তার বড় অংশ নেতাদের দিতে হয়। প্রশাসনের কর্মকর্তাদেরও উপহার হিসেবে মাছ দিতে হয়। এভাবে প্রতি বছর ঘের দিই। এতে মৎস্য আইন লঙ্ঘন হয় কিনা আমার জানা নেই।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, সিন্ডিকেটের সদস্যদের মধ্যে রয়েছেন বারদি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ নেতা মজিবর রহমান, মোক্তার হোসেন, আবুল হোসেন, হোসেন মিয়া, গোলজার হোসেন, আব্দুল করিম ও সাব মিয়া।

পাশাপাশি আব্দুল আজিজের নেতৃত্বে ৫০ সদস্যের আরেকটি সিন্ডিকেট রয়েছে। এই সিন্ডিকেটের সদস্যরাও আওয়ামী লীগের ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতাকর্মী।

একটি ঘেরে ১০-১২ লাখ টাকার মাছ পাওয়া যায়। অর্ধেক টাকা নেতাদের দিতে হয়

জানতে চাইলে সিন্ডিকেটের নেতা মজিবর রহমান, হোসেন মিয়া ও গোলজার হোসেন জানান, নদীতে ঘের দিয়ে মাছ ধরি; দোষের কি আছে? ঘের দিয়ে না ধরলে মাছ পাওয়া যায় না। 

জানতে চাইলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আতিকুল ইসলাম বলেন, আমি উপজেলায় সম্প্রতি যোগ দিয়েছি। এরই মধ্যে কয়েকটি স্থানে অভিযান চালিয়েছি। মৎস্য কর্মকর্তাকে ধারাবাহিক অভিযান চালানোর নির্দেশ দিয়েছি। এভাবে মৎস্যসম্পদ ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করছে তারা; সরেজমিনে দেখে আমি মর্মাহত হয়েছি।

উপজেলার জ্যেষ্ঠ মৎস্য কর্মকর্তা জেসমীন আক্তার বলেন, মৎস্য আইন লঙ্ঘন করে যারা নদীতে ঘের দিয়ে মাছ শিকার করছেন; তাদের নোটিশ দেওয়া হয়েছে। প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ না থাকায় অভিযান চালানো সম্ভব হচ্ছে না। এর সঙ্গে প্রশাসনের কেউ জড়িত থাকলে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এএম