দিনাজপুরে সাড়া ফেলেছে তিন শিক্ষার্থীর ‘গ্র্যাজুয়েট চা-ওয়ালা’
বিকেল ৪টা বাজতে না বাজতেই দিনাজপুরের ঐতিহাসিক গোরে শহীদ ময়দানে নানা বয়সী মানুষের ভিড় জমে। কেউ বসে আড্ডা দেন, আবার কেউ বাচ্চাদের নিয়ে নিয়ে খেলাধুলা করেন। ঘড়ির কাটায় ৪টা বাজতেই একটি ইজিবাইক নিয়ে চলে আসেন গ্র্যাজুয়েট চা-ওয়ালা খ্যাত পলিটেকনিকের তিন শিক্ষার্থী। তারা ইজিবাইক থেকে দোকানের মালামাল নামানোর পর প্লাস্টিক দিয়ে মোড়ানো দোকানটি খোলেন। মুহূর্তেই মাঠের চার পাশে বসে থাকা মানুষজন ছুঠে আসেন।
জিজ্ঞাসা করেন- কতক্ষণ পর চা পাওয়া যাবে। তারা জানালেন- কিছুক্ষণের মধ্যে পেয়ে যাবেন। তিন যুবকের মধ্যে কেউ চুলা জ্বালাতে ব্যস্ত, কেউ সসপেনে দুধ ঢালতে, আবার কেউ ক্রেতাদের বসার জন্য ছোট ছোট টুলগুলো সারি সারি করে সাজাতে ব্যস্ত।
বিজ্ঞাপন
বলছিলাম দিনাজপুরের একটি বেসরকারি পলিটেকনিক কলেজের সিভিল বিভাগের তিন শিক্ষার্থীর ভাসমান চায়ের দোকানের কথা। কোনো কাজই ছোট নয়- এমন চিন্তা থেকে তিন শিক্ষার্থী খুলে বসেছেন চায়ের দোকান। দোকানের নাম দিয়েছেন গ্র্যাজুয়েট চা-ওয়ালা। তিন শিক্ষার্থীর মধ্যে প্রধান উদ্যোক্তা সুজন শেষ সেমিস্টার, সাইফুল ও রানা পড়ছেন ৭ম সেমিস্টারে। তাদের বাড়ি পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ উপজেলায়।
একই কলেজে পড়াশোনা ও বাড়ি একই এলাকায় হওয়ায় তারা নিজেরা কিছু একটা করার চিন্তা করেন। সেই চিন্তা থেকেই ২০২০ সালে ইউটিউবে ভারতে ও চীনে রাস্তার পাশের চায়ের দোকানের ভিডিও দেখে চা বিক্রির সিদ্ধান্ত নেন তারা। তবে আর্থিক ও পরিবারের সাপোর্ট না থাকায় শুরু করতে পারেননি। পরে আউটসোর্সিংয়ের কাজ করে টাকা জমিয়ে তারা শুরু করেন ভাসমান চায়ের দোকান। নাম দেন ‘গ্র্যাজুয়েট চা-ওয়ালা’।
গ্র্যাজুয়েট চা-ওয়ালা স্টল থেকে প্রতিদিন প্রায় ৪০০ কাপ চা বিক্রি হয়। এখানে ভিন্ন দামের ৫ রকমের চা পাওয়া যায় পোড়ামাটি ও প্লাস্টিকের কাপে। পোড়ামাটির প্রতি কাপ চা ২০ টাকা আর প্লাস্টিকের প্রতি কাপ চা ১৫ টাকা। যেখানে পরিবার-পরিজন ও বন্ধুবান্ধব নিয়ে চায়ের চুমুকে সময় পার করতে আসেন অনেকে।
গ্র্যাজুয়েট চা-ওয়ালার চায়ের স্বাদ যেমন অনন্য, তেমনি বাহারি চায়ের ভাঁড়। এই দুইয়ের আকর্ষণে দোকানে ভিড় জমাচ্ছেন চা-প্রেমীরা। প্রতিদিন বিকেল ৪টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত চলে চায়ের দোকান। ভিন্ন উদ্যোগ ও স্বাদের টানে শহরজুড়ে জনপ্রিয়তা পেয়েছে তিন শিক্ষার্থীর গ্র্যাজুয়েট চা-ওয়ালা।
দিনাজপুর সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী শ্রাবন্তী রানী রায় বলেন, আমরা বন্ধুরা মিলে আজ এসেছি গ্র্যাজুয়েট চা-ওয়ালা ভাইদের চা খেতে। এখানে চা খাওয়ার অনুভূতিটা অন্যরকম। চায়ের স্বাদ অসাধারণ। পরবর্তীতে আমরা এখানে আবার আসব চা খেতে।
স্থানীয় রবিউল ইসলাম রবি বলেন, আমি দিনাজপুরের মানুষ হয়ে তাদের প্রশংসা করি। তারা তিনজন তরুণ সমাজকে একটা মেসেজ দিতে পেরেছে যে কোনো কাজই ছোট নয়। তাদের চায়ের স্বাদ খুব ভালো। তাদের তিনজনের জন্য শুভ কামনা।
বর্ষা জাহান মিম নামে এক চা-প্রেমী বলেন, আমি মনে করি শিক্ষিতরা চা বিক্রি করতে পারবে না- সেই ধারণাটাই ভুল। তারা তো কাজ করছে, চাঁদাবাজি বা চুরি করছে না।
গ্র্যাজুয়েট চা-ওয়ালার প্রধান উদ্যোক্তা সুরুত জামান ইসলাম সুজন ঢাকা পোস্টকে বলেন, দোকান চালুর শুরুতে কেউ ভালোভাবে নেয়নি। পরিবারের সঙ্গে এক প্রকার যুদ্ধ করতে হয়েছিল। পরে অবশ্য পরিবারকে ম্যানেজ করা গেছে। এছাড়াও পরিকল্পনা অনেক আগে করলেও আর্থিক সমস্যার কারণে শুরু করা যায়নি। পরবর্তীতে ফাইবারসহ বিভিন্ন মার্কেটপ্লেসে কাজ করে ৮০ হাজার টাকার মূলধন দিয়ে দুই মাসে গ্র্যাজুয়েট চা-ওয়ালার পথচলা শুরু হয়।
তিনি বলেন, প্রথমে সাড়া না পেলেও বর্তমানে প্রচুর চাহিদা আমাদের চায়ের। শুরুর দিকে দোকানে ২০ লিটারের মতো দুধ লাগলেও এখন প্রতিদিন ৬০ লিটারের মতো দুধ লাগছে। মানুষ গ্র্যাজুয়েট চা-ওয়ালার চা খেতে আসছে। সবাই চায়ের প্রশংসা করছে। ভবিষ্যতে এটা নিয়ে দেশে ও দেশের বাহিরে দোকান দেওয়ার চিন্তাভাবনা রয়েছে।
আরএআর