২০২২ সালের হিসেব অনুসারে কিশোর মজলিস সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মোট শিক্ষার্থী ৮৩৭ জন। বরিশাল নগরীর গুরুত্বপূর্ণ এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ২০২৩ সালের বই উৎসবে চাহিদার অনুকূলে মোট ৯০টি বই এসেছে। রোববার (১ জানুয়ারি) সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা উৎসাহ নিয়ে এসেছিলেন প্রিয় প্রতিষ্ঠানে নতুন বই নিতে।

কিন্তু আফসোস নিয়ে ফিরে গেছেন অনেকেই। চাহিদার অনুকূলে ন্যূনতম বইও না পেয়ে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের হাতে পুরোনো একটি বা দুটি বই দিয়ে পরবর্তীতে দেওয়া হবে বলে আশ্বস্ত করা হয়েছে। বিদ্যালয়ের গেটের সামনে নতুন বইয়ের জন্য অপেক্ষা করতে করতে মা মরিয়মের কোলে ঘুমিয়ে গেছেন বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী সামিয়া।

বাংলাবাজার এলাকার নূরিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে বইয়ের চাহিদা ছিল ৫৩০ সেট। এর মধ্যে ৩৯৫ সেট বই এসেছে। আর সপ্তম শ্রেণির ১৩৫ সেট বইয়ের একটিও আসেনি। একইভাবে ব্রজমোহন স্কুল, উদয়ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়, হাজেরা খাতুন প্রাথমিক বিদ্যালয়, টাউন মাধ্যমিক বিদ্যালয়, রূপাতলী জাগুয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে খোঁজ নিয়েও দেখা গেছে চাহিদার অনুকূলে সন্তোষজনক বই অসেনি। শহরের বাইরে বিভিন্ন উপজেলায়ও শ্রেণিভিত্তিক একটি করে বই দেওয়া হয়েছে হাতে গোনা শিক্ষার্থীদের। সেসব প্রতিষ্ঠানেও পুরোনো বই দিয়েছে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

নূরিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, আমাদের বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণির বইয়ের মধ্যে সপ্তম শ্রেণির এক সেট বইও পাইনি। অন্য শ্রেণির বই পেয়েছি তবে তাতেও দু-একটি বিষয় বাদ রয়েছে। জেলা শিক্ষা অফিস থেকে আমাদের জানিয়েছে সোমবারের মধ্যে বাকি বই পাব। শিক্ষার্থীদের আমরা আশ্বস্ত করেছি।

কিশোর মজলিস সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক খাদিজা বেগম বলেন, আমাদের বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী সংখ্যা অনেক। নতুন-পুরোনো মিলিয়ে আজকে (রোববার) যতটুকু পেরেছি শিক্ষার্থীদের দিয়েছি। শিক্ষা অফিস থেকে বাকি বই পেলেই বিতরণ করবো।

এই বিদ্যালয়ের ৫ম শ্রেণির শিক্ষার্থী সারা ইসলাম ও মেহেরুজ্জাহান মেঘলা বলে, আমাদের দুটি করে পুরোনো বই দিয়েছে। বইগুলো ছেঁড়া। ম্যাডামরা বলেছেন আবার বই দেবে। তবে আজকে নতুন বই পেলে ভালো লাগতো।

ক্ষুদে দুই শিক্ষার্থীর অভিযোগ, শ্রেণিকক্ষে ১ থেকে ৩ রোল যাদের তাদের নতুন বই দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে মেঘলার রোল ৪ এবং সারার রোল ১৪ হওয়ায় তারা নতুন বই পায়নি।

বাংলাবাজার এলাকার বাসিন্দা তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র শাহরিয়ার বলে, আমাকে একটি ছেঁড়া বাংলা বই দিয়েছে। বইয়ের মধ্যে দাগানো, কালি ফেলা। এই বই আমি পড়ব না।

কথা হয় রূপাতলী জাগুয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক হারুনুর রশিদের সঙ্গে। তিনি বলেন, এভাবে ছেঁড়া আর পুরোনো বই দিয়ে বই উৎসব হয় না। বিগত বছরে সরকার খুব ভালোভাবে বই উৎসব করেছে। কিন্তু এবারে কোনো বই উৎসব হয়নি। এবারের বই উৎসব ছিল নামের। এতে শিক্ষার্থীরা হতাশ হয়েছে।

টাউন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক রিয়াজুল ইসলাম বলেন, একই স্কুলে একই দিনে একজন শিক্ষার্থীকে নতুন আরেকজনকে পুরোনো বই দেওয়া অন্যায়। এতে শিক্ষার্থীরা মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে। ওরা বুঝতে পারে ওদের প্রতি বৈষম্য করা হচ্ছে। যে কারণেই হোক সংকট দেখা দিয়েছে। কিন্তু শিশু-কিশোরদের এভাবে বিভাজন করা উচিত হয়নি। 

তিনি বলেন, আমার ছেলেকে পুরোনো বই দিতে চেয়েছিল। কিন্তু সে নেয়নি। বাসায় এসে জানিয়েছে সোমবারের মধ্যে তাকে নতুন বই কিনে দিতে হবে।

সচেতন নাগরিক কমিটির বরিশাল জেলার সভাপতি অধ্যাপক শাহ সাজেদা বলেন, সরকারকে আমি ধন্যবাদ দিব, কারণ সংকটের মধ্যেও বছরের প্রথম দিনে বই উৎসব করেছে। তবে একটি কথা বলতেই হয়, বই বিতরণে আরও স্বচ্ছতা দরকার ছিল। কাউকে দিয়েছে, কাউকে দেয়নি। দফায় দফায় বই দিলে ভালো হতো। এটি না করায় শিক্ষার্থীদের মন ভেঙে গেছে। এর প্রভাব তাদের লেখাপড়ায় পড়বে বলে মনে করি।

বরিশাল সদর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকার্তা ফয়সল জামিল বলেন, জেলার ১০টি উপজেলার মধ্যে প্রথম দিকে সদর ও গৌরনদী উপজেলার বই পরিবহনের ঠিকাদারের ওয়ার্ক পারমিট বাতিল হয়ে গিয়েছি। এজন্য আমরা অনিশ্চয়তায় ছিলাম। তখন অন্য উপজেলা থেকে ধার করে বই এনেছি। যদিও ২৮ ডিসেম্বর দুই ট্রাক বই এসেছে। তারপরও আমরা শতভাগ শিক্ষার্থীর হাতে বই তুলে দিতে পারিনি।

জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মোহন লাল দাস বলেন, এ বছর ৩ লাখ ২৪ হাজার ৮৬৫ শিক্ষার্থীর জন্য বইয়ের চাহিদা ১৩ লাখ ৩ হাজার ৯৪৫টি। এখন পর্যন্ত আমরা ৫০ শতাংশ বই পেয়েছি। এটি সত্য সকল শিক্ষার্থীকে সম্পূর্ণ সেট বই দিতে পারিনি। আশা করছি আগামী ১০ জানুয়ারির মধ্যে সম্পূর্ণ বই তাদের কাছে পৌঁছে দিতে পারব।

বাবুগঞ্জ উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা নাসরিন জোবায়দা আক্তার বলেন, উপজেলার সব প্রতিষ্ঠানের সকল শিক্ষার্থীকে আমরা বই দিতে পারিনি। এই চিত্র সারাদেশেই। মূলত বৈশ্বিক সংকটের কারণে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। যে কারণে অন্য বছরের মতো এবারের বই উৎসব হয়নি।

জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, জেলায় ৪৬৯টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অনুকূলে চাহিদা ছিল ২৮ লাখ বইয়ের। আর ২৪৬টি মাদরাসার অনুকূলে ৯ লাখ বইয়ের চাহিদা ছিল। আমরা শতভাগ বই পাইনি। এজন্য প্রথম দিনে শতভাগ শিক্ষার্থীর হাতে বই তুলে দিতে পারিনি। তবে দুশ্চিন্তার কিছু নেই। দু-চার দিনের মধ্যে বাকি বই এলে সব প্রতিষ্ঠানে পৌঁছে দেওয়া হবে। 

প্রথম দিনে কত শতাংশ শিক্ষার্থী বই পেয়েছে- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি সঠিক পরিসংখ্যান দিতে পারেননি।

এদিকে কয়েকটি বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর হাতে নতুন বই তুলে দিয়ে জেলার বই উৎসবের উদ্বোধন করেছেন জেলা প্রশাসক জাহাঙ্গীর হোসেন। সকাল ৯টায় কালেক্টরেট স্কুল অ্যান্ড কলেজে এই কর্মসূচির উদ্বোধন করেন তিনি। জেলা প্রশাসক জানান, প্রথম দিনে সব শিক্ষার্থী বই না পেলেও ৮৫ ভাগ শিক্ষার্থীর হাতে ৩৭ লাখ বই বিতরণ করা হয়েছে। যে ১৫ শতাংশ শিক্ষার্থী নতুন বইয়ের ঘ্রাণ থেকে বঞ্চিত হয়েছে তাদেরকে অল্প কয়েকদিনের মধ্যে বই দেওয়া হবে।

সৈয়দ মেহেদী হাসান/আরএআর