এনামুল হক আত্মস্বীকৃত ইয়াবা কারবারি

কক্সবাজারের সীমান্ত উপজেলা টেকনাফের ৫ ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন ঘিরে চিহ্নিত ইয়াবা কারবারিরা মাঠ উত্তাল রেখেছে। আলোচিত এবং আত্মঘোষিত কারাগার ফেরত এসব ইয়াবা কারবারির গণসংযোগ নিয়ে চলছে নানান আলোচনা- সমালোচনা।

নির্বাচন অফিস সূত্রে জানা যায়, টেকনাফ উপজেলার হ্নীলা, সাবরাং, সেন্টমার্টিন, টেকনাফ সদর ও হোয়াইক্যং ইউনিয়নের নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা হয়েছে গেল ৩ মার্চ। এই ৫ ইউনিয়নে ভোটগ্রহণ ১১ এপ্রিল। মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ১৮ মার্চ। মনোনয়নপত্র বাছাই ১৯ মার্চ এবং প্রত্যাহারের শেষ সময় ২৪ মার্চ। এর বাইরে টেকনাফ পৌরসভা ও বাহারছড়া ইউনিয়নের তফসিল এখনও ঘোষণা হয়নি।

এই ৫ ইউনিয়নে কমপক্ষে ৭৭ জন চিহ্নিত ইয়াবা কারবারি নির্বাচন করার ঘোষণা দিয়ে মাঠে তৎপরতা শুরু করছেন। তবে, সাধারণ ভোটাররা বলছেন, তারা কোনোভাবেই চান না ইয়াবা কারবারিরা প্রার্থী হোক। হলেও তারা যেন নির্বাচিত হতে না পারেন। তারা মনে করছেন, ইয়াবা কারবারিরা নির্বাচিত হলেও অনেক সময় পলাতক থাকে। আবার কারাগারে থাকে। এতে জনগণ সঠিক সেবা পান না।

সুশাসনের জন্য নাগরিক সুজনের কক্সবাজারের সাধারণ সম্পাদক মাহাবুবুর রহমান মনে করেন, ইয়াবা কারবারি প্রার্থী বা নির্বাচিত হলে মাদক রোধ অসম্ভব হবে। মাদক কারবারিদের প্রার্থিতা বাতিলের আইন প্রণয়নের দাবি তার।

কক্সবাজার বাঁচাও আন্দোনের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আয়াছুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আত্মসমর্পণকারী ইয়াবা কারবারিরা স্বঘোষিত মাদক কারবারি। যারা আদালতের মাধ্যমে জামিন পেয়ে এলাকায় ফিরেছে। সম্প্রতি নির্বাচনে তারা প্রার্থী হিসেবে মাঠে গণসংযোগ শুরু করেছে। এরা যদি জনপ্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত হয়ে আসে তাহলে এলাকার পরিস্থিতি কোন পর্যায়ে যাবে এটা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এসব বিষয় সরকারের দৃষ্টিতে আনা জরুরি বলে মনে করেন তিনি।

টেকনাফ উপজেলা শ্রমিকলীগের সাধারণ সম্পাদক ও সদর ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান শাহজাহান মিয়া

তবে তফসিল ঘোষণা না হলেও টেকনাফ পৌরসভায় এখন সবচেয়ে বেশি সংখ্যক চিহ্নিত ইয়াবা কারবারি প্রার্থী হিসেবে প্রচারণা চালাচ্ছে। যার মধ্যে রয়েছে সাবেক এমপি আবদুর রহমান বদির ভাই আবদুস শুক্কুর।

তিনি মেয়র প্রার্থী হিসেবে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশী। এই আবদুস শুক্কুর ২০১৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি টেকনাফ পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালের হাত থেকে ফুল নিয়ে আত্মসমর্পণ করেছিলেন। 

ওই সময় মোট ১০২ জন ইয়াবা কারবারি আত্মসমর্পণ করেন। ২০২০ সালের নভেম্বরের শুরুতে আবদুস শুক্কুর জামিনে মুক্তি পান। এরপর থেকে টেকনাফ পৌরসভায় আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থীর মনোনয় প্রত্যাশী ঘোষণা দিয়ে গণসংযোগ করতে দেখা গেছে। টেকনাফ পৌরসভার মেয়র প্রার্থীসহ ৯টি ওয়ার্ডে কাউন্সিলর প্রার্থী হিসেবে অন্তত ২০ জন চিহ্নিত ইয়াবা কারবারি প্রচারণা চালাচ্ছেন। যারা চিহ্নিত এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত ইয়াবা কারবারি। যাদের বেশির ভাগের বিরুদ্ধে রয়েছে ইয়াবা ও অস্ত্র মামলা।

তফসিল ঘোষিত টেকনাফ সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান প্রার্থী হিসেবে প্রচারণাকারী ৪ জনই চিহ্নিত ইয়াবা কারবারি। যার মধ্যে বর্তমান চেয়ারম্যান শাহাজান মিয়াও রয়েছে। তার বিরুদ্ধে ইয়াবা ও অস্ত্র আইনে কয়েকটি মামলা রয়েছে। ২০১৯ সালের ২৫ জুলাই যশোরের বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে ভারতে পালানোর চেষ্টার সময় শাহাজান মিয়াকে আটক করা হয়।

পুলিশ তাকে টেকনাফ ফিরে এনে ২৮ জুলাই লেঙ্গুর বিল বাড়িতে অভিযান চালায়। সেখানে ৫০ হাজার পিস ইয়াবা, ৪টি দেশীয় অস্ত্র (এলজি) ও ২৫টি তাজা গুলি উদ্ধার করা হয়।

এ মামলায় কারাগারে পাঠানো হলেও জামিনে মুক্তি পেয়ে এলাকায় ফিরেন গত জানুয়ারি মাসের শুরুতে। তখন থেকে নিজে প্রার্থী হিসেবে প্রচারণা চালাচ্ছেন। এই শাহাজান মিয়াসহ তার বাবা ও ভাই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত ইয়াবা কারবারি। ২০১৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ১০২ ইয়াবা কারবারির আত্মসমর্পণের সময় তার এক ভাইও ছিলেন।

যদিও শাহাজান মিয়া তার বিরুদ্ধে দায়ের করা সকল মামলা মিথ্যা ও ভিত্তিহীন বলে দাবি করেছেন। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, তার প্রতিপক্ষ ষড়যন্ত্র করে এসব মামলা করেছে। তিনি বলেন, তিনি ইয়াবার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয়। তার জনপ্রিয়তাকে ঘায়েল করতে এমন প্রচারণা চালানো হয়।

২০১৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ১০২ আত্মসমর্পণকারী ইয়াবা কারবারির মধ্যে ছিলেন টেকনাফের গোদার বিল এলাকার আলী আহমদের ছেলে যুবদল নেতা জিয়াউর রহমান। তিনিও সম্প্রতি জামিনে মুক্ত হয়ে চেয়ারম্যান প্রার্থী হিসেবে প্রচারণা চালাচ্ছেন। তিনি বিএনপি থেকে মনোনয়ন প্রত্যাশী। টেকনাফের ছোট্ট হাবির পাড়ার খলিলুর রহমানের ছেলে হাম জালালও এক ইয়াবা মামলায় কারামুক্ত। তিনি আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান প্রার্থী হিসেবে প্রচারণা চালাচ্ছেন। হাম জালালও তার বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মামলা মিথ্যা বলে ঢাকা পোস্টের কাছে দাবি করেছেন।

একই দিন আত্মসমর্পণকারীদের মধ্যে ছিলেন টেকনাফের এনামুল হক। তিনি আবারও ইউপি সদস্য প্রার্থী হিসেবে প্রচারণা চালাচ্ছেন। টেকনাফ সদর ইউনিয়নে এ রকম আরও ১৩ জন চেয়ারম্যান ও মেম্বার প্রার্থী পাওয়া রয়েছে যারা চিহ্নিত এবং তালিকাভুক্ত ইয়াবা কারবারি।

টেকনাফ সদর ইউনিয়ন ছাড়াও অন্যান্য ইউনিয়নে ইয়াবা কারবারিরা প্রার্থী হিসেবে প্রচারণার তথ্য পাওয়া গেছে। এর মধ্যে সাবরাং ইউনিয়নে চেয়ারম্যান প্রার্থীসহ ১৪ জন, বাহারছড়া ইউনিয়নে চেয়ারম্যান প্রার্থীসহ ৫ জন, হ্নীলা ইউনিয়নে চেয়ারম্যান প্রার্থীসহ ১১ জন, হোয়াইক্যং ইউনিয়নে ৭ জন ও সেন্টমার্টিন ইউনিয়নে ৩ জন প্রার্থী রয়েছে যারা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত ইয়াবা কারবারি।

টেকনাফের সাবরাংয়ের বাসিন্দা নাজিম উদ্দিন বলেন, ইয়াবা কারবারিরা নির্বাচিত হলে কোনো সেবা পাওয়া যায় না। বছরের বেশিভাগ সময় আত্মগোপনে পালিয়ে বেড়ান। আবার অনেকেই কারাগারে থাকেন। এদের ভোট দেয়া, না দেয়া একই।

আবুল বশর নামে এক তরুণ বলেন, টেকনাফের ইয়াবার বদনাম দূর করতে হবে। এবার নির্বাচনে ইয়াবা কারবারিদের বয়কট করা হবে।

পুলিশ বলছে, কারাগার ফেরত মাদক কারবারিদের নজরধারীতে রাখা হয়েছে। এদের সামাজিকভাবে বয়কট করার আহ্বান রইল।

কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মো. হাসানুজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, কারাগার ফেরত বা তালিকাভুক্ত ইয়াবা কারবারিদের ওপর কঠোর নজরদারি রাখা হয়েছে। পলাতক মাদক মামলার আসামি গ্রেপ্তারে ধারাবাহিক অভিযানও অব্যাহত রয়েছে। এখন সাধারণ জনগণকে এগিয়ে আসতে হবে। এদের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন তৈরি করতে হবে।

প্রসঙ্গত, কক্সবাজারের টেকনাফ, মহেশখালী ও কুতুবদিয়ার ১৫ ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে আগামী ১১ এপ্রিল। গেল ৩ মার্চ এসব ইউপি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন।

এমএএস