ফসলের মাঠ থেকে দয়ালের ইংরেজি বক্তা হয়ে উঠার গল্প
প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি না থাকলেও ফসলের খেত থেকে হয়ে উঠেছেন ইংরেজি বক্তা। বাবার সঙ্গে মাঠে কাজ করার গল্পই বেছে নিয়েছিলেন ইংরেজিতে কথা বলা। ইংরেজি বলতে বলতে নেট দুনিয়ায় এখন ইংরেজি বালক। ইংরেজিতে অনর্গলভাবে কথা বলতে সোস্যাল মিডিয়ায় ভ্লগ তৈরি করে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন নেটিজেনদের। বিস্ময় জাগিয়েছেন নিজের গ্রামের মানুষদেরও। বলছিলাম ইংরেজিতে আলোড়ন সৃষ্টি করা পঞ্চগড়ের অজপাড়া গায়ের ফেসবুক-ইউটিউবার দয়াল চন্দ্র বর্মনের কথা।
দয়াল চন্দ্র বর্মন পঞ্চগড়ের আটোয়ারীর বলরামপুর ইউনিয়নের লক্ষীদার গ্রামের কৃষক পুলিন চন্দ্র বর্মনের ছেলে। অর্থের অভাবে থেমে থেমে চলছে পড়ালেখা। পঞ্চগড় বিষ্ণু প্রসাদ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ২০১৭ সালে এসএসসি পাস করতে পারলেও তার পাঁচ বছর পর উন্মক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দিয়েছেন এইচএসসি পরীক্ষা। এখনও রেজাল্ট প্রকাশ হয়নি। অর্থাভাবে নামিদামি স্কুল-কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ না ঘটলেও ইচ্ছের শক্তির কাছে হার মেনেছে অনেক কিছুই। বাবার সঙ্গে খেতে কাজ করতে করতে ইংরেজিতে কথা বলার পারদর্শীতা ও সোস্যাল নেটওয়ার্কে ইংরেজিতে কনটেন্ট বানিয়ে এলাকায় হৈ চৈ ফেলে দিয়েছেন তিনি।
বিজ্ঞাপন
ওই সময় গ্রামাণিক পাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আজগর আলীর ইংরেজি পড়ানোর ধরন দেখে ইংরেজি শেখার অনুপ্রেরণা তৈরি হয় তার। সেই শিক্ষকের কাছ থেকে ইংরেজি শেখা। বাবার সঙ্গে কাজ করতে জীবনের গল্পই বানিয়ে ফেলেন কন্টেন্ট। প্রথমে ফেসবুকে ‘সার্চ ইংলিশ’ গ্রুপে যুক্ত হয়েছিলেন। সেখানে দেখেছিলেন গ্রুপের সদস্যরা কীভাবে ইংরেজিতে কথা বলে ভ্লগ বা কন্টেন্ট তৈরি করে। সেখান থেকেই পান আইডিয়া। অন্যদের মতো নিজেকে গড়তে শুরু করে প্রতিদিন ভিডিও তৈরি ও ফেসবুক লাইভ। সেসব ভিডিও গ্রুপে আপলোড করলে দৃষ্টি কাড়েন অনেকের।
পরে যুক্ত হন ‘টেন মিনিট স্কুলের ইংলিশ ল্যাংগুয়েজ ক্লাবে’। সেখানেও হাজারও প্রতিযোগীর মধ্যে সেরা হন দয়াল। তার ভিডিও কন্টেন্ট দেখে অনুপ্রাণিত হয়েছেন তার অনেক ফলোয়ার। অনেক ফলোয়ার তার ইংরেজি কন্টেন্ট দেখে উন্নত স্থানে জায়গা করে নিতে পেরেছেন বলে দয়ালের ফেসবুক পেজে মন্তব্য করেছেন। এখন তার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছাড়িয়ে গেছে দেড় লাখেরও বেশি ফলোয়ার। কন্টেন্ট তৈরি থেকে যা আয় হচ্ছে, তা দিয়ে এলাকার কিছু মানুষের পাশে দাঁড়ায় দয়াল।
তার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বাবাকে গৃহস্থালীর কাজে সহযোগিতা করছেন দয়াল। কাজের ফাঁকে ফাঁকে ছুটে যাচ্ছেন ফসলের মাঠে, কখনও দর্শনীয় জায়গায়। হাতে স্মার্টফোন দিয়েই ইংরেজিতে কনটেন্ট তৈরি করছেন। দয়ালের ইংরেজির পারদর্শীতা নিয়ে গর্ববোধ করছেন তার বাবা পুলিন চন্দ্র বর্মন।
তিনি বলেন, আমি সামান্য গরিব কৃষক। টাকার অভাবে তাকে ভালো কোনো স্কুল-কলেজে ভর্তি করতে পারিনি। কিন্তু তারপরেও আমার ছেলে এমন ইংরেজিতে পারদর্শী হয়ে উঠবে তা গর্ববোধ করছি। বছর তিনেক আগে মাটি বিক্রি করে ওকে ল্যাপটপ ও স্মার্টফোন কিনে দেই। এটা দিয়ে সে আজকের অবস্থানে এসে ইন্টারনেটে সারাবিশ্ব চিনছে তাকে।
দয়াল বলেন, আমি একটা মেসেজ দিতে চাই যে, আমাদের বাংলাদেশের অধিকাংশ জায়গাই হচ্ছে গ্রাম্য এলাকা। অধিকাংশই আমরা গ্রাম থেকেই আসছি। গ্রাম থেকে আসছি বলে, অনেকে বিশ্বাস করে আমার দ্বারা কিছু হবে না। আর শহরে যারা থাকে, তারাই ভালো কিছু করে। এই বিশ্বাসটা আমাদের মাথায় ব্লক হয়ে আছে। এই ব্লকটা ভাঙার জন্যই আমি নিজের অবস্থান থেকে এই ইম্প্রুভ করার চেষ্টায় ছিলাম। আমি বিশ্বাস করি বাংলাদেশের যতো তরুণ রয়েছে, তাদের প্রত্যেকের মধ্যে সম্ভাবনা আছে। সবাই যদি সবার জায়গা থেকে নিজের সম্ভবটুকু কাজে লাগাতে চেষ্টা করে তাহলে আমরা কিন্তু বাংলাদেশকে পরিবর্তন করতে পারবো।
সদানন্দসহ কয়েকজন শিক্ষার্থী জানায়, দয়ালের ইংরেজি বক্তা হয়ে উঠা দেখে তারাও অনুপ্রাণিত হচ্ছেন। তারাও দয়াল চন্দ্র বর্মনের মতো হতে চাইছেন। এজন্য তারা ইংরেজি চর্চা করতে চলে আসছেন তার বাড়িতে।
এলাকাবাসীর মধ্যে গনেশ চন্দ্র, অমলেশ চন্দ্র ও গীতা রানী জানান, দয়ালের প্রতিভায় আমরা গর্বিত। সারাবিশ্ব তাকে চিনছে। সে এতো তারাতারি ভালো ইংরেজি বলতে পারে তা কল্পনাও করতে পারিনি। তার পাশাপাশি আরও ভালো গুণ রয়েছে। সে কিছুদিন আগে গ্রামবাসির মাঝে ২০০ কম্বল দিয়েছে আমাদের শীতার্ত মাঝে। তাই দয়ালের মেধার মূল্যায়নে সরকারকে এগিয়ে আসতে অনুরোধ করছি।
আটোয়ারীর বলরামপুর ইউপি চেয়ারম্যান হাজি দেলোয়ার হোসাইন বলেন, আমাদের স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা লেখাপড়া করলেও অনেকে ভালোভাবে ইংরেজি বলতে পারে না। সেখানে দয়াল নামের ছেলেটি ইংরেজি বলতে পারছে। এটা অত্যন্ত ভালো দিক। এমন প্রতিভাবান ছেলেদের মেধার মূল্যায়নে এগিয়ে আসলে তারা ভবিষ্যতে অনেক ভালো করবে।
এমএএস