রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা ও হোসনে আরা লুৎফা ডালিয়া/ ঢাকা পোস্ট

রংপুর সিটি করপোরেশন (রসিক) নির্বাচনের ভোটগ্রহণ আগামীকাল মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত হবে। সকাল সাড়ে ৮টা থেকে শুরু হয়ে বিরতিহীনভাবে চলবে বিকেল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত। এবারই প্রথম রংপুর সিটির সবগুলো কেন্দ্রে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন ভোটাররা। সঙ্গে প্রতিটি ভোটকেন্দ্র ও কক্ষ মনিটরিংয়ে বসানো হয়েছে সিসিটিভি ক্যামেরা।

এবার রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সাতটি রাজনৈতিক দলের সাতজনসহ মোট নয়জন প্রার্থী মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। বিএনপি এ নির্বাচনে অংশ নেয়নি। জামায়াতে ইসলামীর একজন মনোনয়নপত্র কিনলেও শেষ পর্যন্ত দলীয় সিদ্ধান্তে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান।

লড়াইয়ে আছেন সদ্য সাবেক মেয়র জাতীয় পার্টির মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা, আওয়ামী লীগের অ্যাডভোকেট হোসনে আরা লুৎফা ডালিয়া, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ-ইনু) শফিয়ার রহমান, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমিরুজ্জামান পিয়াল, খেলাফত মজলিশের তৌহিদুর রহমান মণ্ডল রাজু, জাকের পার্টির খোরশেদ আলম খোকন, বাংলাদেশ কংগ্রেস পার্টির আবু রায়হান এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী মেহেদী হাসান বনি ও লতিফুর রহমান মিলন। 

ভোটাররা বলছেন, ভোটযুদ্ধের প্রচারণা, গণসংযোগ ও পথসভা করা ছাড়াও জনপ্রিয়তা অর্জনে এগিয়ে আছেন জাতীয় পার্টির মেয়র প্রার্থী ও সাবেক মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা। আর সমানতালে প্রচারণা চালিয়েছেন সরকারদলীয় প্রার্থী অ্যাডভোকেট হোসনে আরা লুৎফা ডালিয়া এবং আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী ইঞ্জিনিয়ার লতিফুর রহমান মিলন। নির্বাচনে ত্রিমুখী লড়াইয়ের সম্ভাবনা দেখছেন ভোটাররা। তবে নয় মেয়র প্রার্থীর মধ্যে আলোচনায় থাকা মোস্তফা-ডালিয়া-মিলনের ভোটের ব্যবধান কত হবে, তা নিয়েও হিসাব চলছে অন্দরমহলে।

জাতীয় পার্টির মেয়র প্রার্থী, তার কর্মী-সমর্থক ও দলীয় নেতারা বলছেন, ২০১৭ সালের নির্বাচনের মতোই এবারও বিপুল ভোটের ব্যবধানে দ্বিতীয়বারের মতো লাঙ্গল প্রতীকে ভোট বিপ্লব হবে। আর আওয়ামী লীগের প্রার্থী ও তার দলের নেতাদের দাবি, উন্নয়নের স্বার্থেই এবার নগরবাসী নৌকায় ভোট দিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে বিজয় উপহার দিবেন।

নগরীর মেডিকেল মোড় এলাকার হামিদা আফরোজ, সেনপাড়ার মেজবাহুল হিমেল, কামারপাড়ার মমিনুল ইসলাম, আমাশু এলাকার আল-আমিনসহ আরও বেশ কয়েকজন ভোটার জানিয়েছেন, জাতীয় পার্টির মেয়র প্রার্থী মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা এখন পর্যন্ত সবদিক থেকে এগিয়ে আছেন। আওয়ামী লীগের প্রার্থী হোসনে আরা লুৎফা ডালিয়ার ভোট ভাগ হয়ে কিছু আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী লতিফুর রহমান মিলনের বাক্সে যাবে বলে মনে করছেন তারা। তাই আবারো মোস্তফা মেয়র হয়ে যেতে পারেন। তবে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে নৌকা ও লাঙ্গল প্রতীকের প্রার্থীর মধ্যে- এ ব্যাপারে সবাই একমত। মাঠের অবস্থান, জনসম্পৃক্ততা ও ব্যক্তি ইমেজসহ দলীয় কারণে জাতীয় পার্টির প্রার্থী মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফার জয়ের সম্ভাবনা বেশি দেখছেন তারা।

এদিকে কেউ কেউ মনে করছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী হোসনে আরা লুৎফা ডালিয়া মনোনয়নপ্রাপ্তির মতো এবার ভোটেও চমক দেখাতে পারেন। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, রংপুরের পুত্রবধূ শেখ হাসিনার প্রতি মানুষের আস্থা, আওয়ামী লীগের উন্নয়ন এবং সাবেক সংসদ সদস্য হিসেবে হোসনে আরা লুৎফা ডালিয়ার পরিচিতিও লাঙ্গলের ঘাঁটিতে নৌকার বিজয় ছিনিয়ে আনতে পারে।

নির্বাচন একতরফা হবে এবং লাঙ্গল প্রতীকে আবারও ভোটবিপ্লব হতে যাচ্ছে দাবি করে জাতীয় পার্টির প্রার্থী ও সাবেক মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা বলেন, আমার আগের সরকারি দলের মেয়র পাঁচ বছরে ২৭০ কোটি টাকার উন্নয়ন কাজ করেছেন। আমার আমলে সাড়ে ১২০০ কোটি টাকার কাজ হয়েছে। এছাড়া নির্বাচনী ইশতেহারের প্রধান এজেন্ডা রংপুরের প্রাণ শ্যামাসুন্দরী খাল দখলমুক্ত করতে আমার আমলে একটি সমন্বিত কমিটি গঠন করা হয়েছে। বিগত বছরগুলোতে মেয়র হিসেবে আমার করা উন্নয়ন, জনসম্পৃক্ততা বিবেচনা করে লাঙ্গলের পক্ষে ভোট দেবেন নাগরিকরা।

আওয়ামী লীগের প্রার্থী হোসনে আরা লুৎফা ডালিয়া বর্ধিত ওয়ার্ডের উন্নয়নসহ নগরীর যানজট ও জলাবদ্ধতা দূরীকরণ ও পরিকল্পিত উন্নয়নে মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করে আধুনিক রংপুর গড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। সাবেক এই সংসদ সদস্য সোমবার সাংবাদিকদের বলেন, নৌকার পক্ষে ব্যাপক গণজোয়ার সৃষ্টি হয়েছে। ২৭ ডিসেম্বর বিপুল ভোটে নৌকার বিজয় সুনিশ্চিত। রংপুর যে নৌকার ঘাঁটি তা প্রমাণ হবে এ নির্বাচনে। অতীতে রংপুরের কোনো নগরপিতা পরিকল্পিত উন্নয়ন করেনি।

ডালিয়া আরও বলেন, রংপুরের পুত্রবধূ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রংপুরবাসীকে বিভাগ, সিটি করপোরেশন, মেট্রোপলিটন পুলিশ, রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, চার লেন সড়ক, গ্যাস সংযোগ, হাইটেক পার্ক উপহার দিয়েছেন। তাই রংপুরবাসী আর ভুল করবেন না। এবার উন্নয়নের ধারাবাহিকতা ধরে রেখে নৌকায় ভোট দিয়ে একটি আধুনিক ও স্মার্ট সিটি করপোরেশন গড়তে প্রধানমন্ত্রীর মনোনীত প্রার্থীকেই ভোট দিয়ে জয়ী করবেন তারা।

এদিকে কৃষিভিত্তিক শিল্পনগরী ও পরিবর্তনের অঙ্গীকার নিয়ে নানা প্রতিশ্রুতি দিয়ে পরিকল্পিত নগরী গড়তে চান আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী লতিফুর রহমান মিলন। অন্যসব প্রার্থীর মতো তিনিও সড়কের অবকাঠামো উন্নয়ন, সড়ক বাতি, শিক্ষা ও সংস্কৃতি, বিনোদন, স্বাস্থ্য, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও বস্তিবাসীর উন্নয়নসহ যানজট ও জলাবদ্ধতা দূরীকরণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

মাঠের চিত্র বিশ্লেষণ করে নির্বাচন বিশ্লেষক এবং রংপুরের সুশীল সমাজ বলছেন মেয়রের ক্ষেত্রে একতরফা ভোট পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) রংপুর মহানগর সভাপতি ফখরুল আনাম বেঞ্জু বলেন, এবার আওয়ামী লীগের সেই ধরনের ডাকসাইটেড কোনো নেতা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেই। হোসনে আরা লুৎফা ডালিয়া সাবেক সংসদ সদস্য, সিনিয়র আইনজীবী এবং আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা হলেও তিনি অন্যদের মতো মনোনয়নপ্রত্যাশী হিসেবে প্রচারণায় ছিলেন না। এখানে নৌকার মনোনয়নের জন্য মাঠে প্রচারণায় সরব ছিলেন অর্ধ ডজন নেতা। তাদের কাউকেই মনোনয়ন দেয়নি আওয়ামী লীগ। অনেকটা চমক হিসেবে হোসনে আরা লুৎফার নাম চলে আসে। এতে অনেকে মনে কষ্ট পেয়েছেন। মান-অভিমান ভাঙিয়ে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করে নির্বাচনের মাঠ গোছানো আওয়ামী লীগের জন্য কষ্টকর হয়েছে। তাই নৌকার প্রচারণায় অনেক নেতাকর্মীকে মাঠে দেখা যায়নি। সে কারণে ২০১৭ সালের চেয়ে নৌকার ভোট কম হলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।

এদিকে প্রার্থীদের মাঝে বাকযুদ্ধ থাকলেও প্রচারণা ঘিরে ছিল না কোনো উত্তেজনা। অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে এমনটাই প্রত্যাশা সব প্রার্থীসহ নগরবাসীর।

নির্বাচনের পরিবেশ এখন পর্যন্ত শান্তিপূর্ণ রয়েছে জানিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে রিটার্নিং কর্মকর্তা আবদুল বাতেন বলেন, নির্বাচন শান্তিপূর্ণ হবে। আমরা আপনাদের ওপর আস্থা রাখছি। এটি হবে মডেল নির্বাচন। আমার দৃঢ় বিশ্বাস আপনারা এই নির্বাচনে সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করবেন। দায়িত্বে অবহেলা হলে ডিপার্টমেন্ট কোনো দায় নেবে না।

রিটার্নিং কর্মকর্তা জানান, ২২৯টি কেন্দ্রের মধ্যে ৮৬টি কেন্দ্র অধিক গুরুত্বপূর্ণ। এসব কেন্দ্রে প্রয়োজনের তুলনায় অধিক সংখ্যক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন থাকবে। সবাই যাতে নির্বিঘ্নে কেন্দ্রে গিয়ে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন সেজন্য সব ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। ভোটার ছাড়া অন্য কেউ ভোটকক্ষের গোপন বুথে প্রবেশ করতে পারবেন না। প্রবেশ করলেই সিসিটিভি ক্যামেরায় ধরা পড়বে এবং তার বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

পুলিশ বাহিনীর প্রতিটি সদস্যকে নিয়ম মেনে দায়িত্ব পালনের আহ্বান জানিয়ে রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের (আরপিএমপি) কমিশনার নুরে আলম মিনা বলেন, যদি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে নিয়ম ভঙ্গের অভিযোগ ওঠে তাহলে ছাড় দেওয়া হবে না। বিগত নির্বাচনগুলোতেও দায়িত্ব অবহেলায় কাউকে ছাড় দেওয়া হয়নি, এবারও দেওয়া হবে না।

তিনি বলেন, নির্বাচন সুষ্ঠু করতে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে পুলিশ। নির্বাচনের দিন ছয় স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকবে। মাঠে সাদা পোশাকে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা নিয়োজিত থাকবেন। নিরপেক্ষভাবে সার্ভিস রুল মেনে দায়িত্ব পালন করতে হবে। যদি কেউ এর ব্যতিক্রম ঘটানোর চেষ্টা করেন তার দায়ভার প্রতিষ্ঠান নেবে না।

তিনি বলেন, নির্বাচনে মোবাইল ও স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে পুলিশ, এপিবিএন ও ব্যাটালিয়ন আনসার সমন্বয়ে প্রতিটি সাধারণ ওয়ার্ডে একটি মোবাইল ফোর্স থাকবে। এছাড়া প্রতি ৩টি সাধারণ ওয়ার্ডে একটি স্ট্রাইকিং ফোর্স এবং প্রতি থানায় একটি করে রিজার্ভ স্ট্রাইকিং ফোর্স থাকবে। আর প্রতি ২টি সাধারণ ওয়ার্ডে একটি করে র‌্যাবের টিম থাকবে।

পুলিশ কমিশনার জানান, স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে ভোটকেন্দ্রের বাইরে র‌্যাব দায়িত্ব পালন করবে। আর গুরুত্বপূর্ণ বা ঝুঁকিপূর্ণ ভোটকেন্দ্রে ৪ জন অস্ত্রসহ পুলিশ, দুইজন অস্ত্রসহ অঙ্গীভূত আনসার ও ১০ জন লাঠিসহ অঙ্গীভূত আনসার-ভিডিপি সদস্য মোতায়েন থাকবে। এছাড়া নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ৩৩ জন এবং ১৬ জন বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট দায়িত্ব পালন করবেন। মাঠের পরিস্থিতি ঠিক রাখতে ইতোমধ্যে ১১ প্লাটুন বিজিবি সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে।

উল্লেখ্য, এবার মেয়র পদে ৯ জন, সাধারণ কাউন্সিলর পদে ১৮৩ জন, সংরক্ষিত কাউন্সিলর পদে ৬৮ জনসহ মোট ২৬০ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এর মধ্যে ৩০ নম্বর ওয়ার্ডে একজন সাধারণ কাউন্সিলর প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। নির্বাচনে ভোটকেন্দ্রে ২২৯ জন প্রিসাইডিং কর্মকর্তা এবং ১ হাজার ৩৪৯ জন সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা দায়িত্ব পালন করবেন। এছাড়া দুই হাজার ৬৯৮ জন পোলিং অফিসার থাকবেন। নির্বাচনে মোট ভোটার সংখ্যা চার লাখ ২৬ হাজার ৪৭০ জন। এর মধ্যে নারী ভোটার দুই লাখ ১৪ হাজার ১৬৬ জন, পুরুষ ভোটার দুই লাখ ১২ হাজার ৩০৩ জন। এছাড়া তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার আছেন একজন।

এমজেইউ/জেএস