এমভি অভিযান-১০ লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় পার হয়ে গেছে এক বছর। সময়ের পালাবদলে অনেক ঘটনাই ঘটছে চারপাশে। তবে অগ্নিকাণ্ডে দগ্ধ মানুষ এবং তাদের রক্ষার্থে এগিয়ে আসা চৌকিদার বাড়ির আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সেই বিভিষিকাময় দুঃসময়কে ভুলতে পারছে না। প্রায় প্রতিদিনই সুগন্ধা নদীর তীরে আলোচনায় উঠে আসে সেই রাতের গগনবিদারী আর্তনাদ, চোখের সামনে মানুষকে পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়ার দৃশ্য।

পোড়া মানুষদের পোশাক ঘটনাস্থলের সামনেই টানিয়ে রাখা হয়েছে। দূর থেকে দেখলে মনে হবে কাকতাড়ুয়া। কিন্তু এই কাকতাড়ুয়ার সঙ্গে জড়িয়ে আছে মর্মান্তিক এক ইতিহাস।

ঝালকাঠি সদর উপজেলার পোনাবালিয়া ইউনিয়নের সুগন্ধা নদীর তীরবর্তী দিয়াকুল গ্রামের চৌকিদার বাড়ির আল আমিন চৌকিদারের স্ত্রী রীণা বেগম সেই রাতে সবার প্রথম বাইরে বেড়িয়ে এসেছিলেন। অবশ্য ওই বাড়ির লোকজন পাশের গ্রামের হৈ চৈ থেকে প্রথমে টের পান আগুনের কথা।

আবুল হাসেম চৌকিদার বলেন, পাশের গ্রাম থেকে মেম্বার মাইকিং করেছে চৌকিদার বাড়িতে আগুন লেগেছে। তিনি সকলকে এগিয়ে আসতে বলেন। ওই গ্রামের মানুষের চিৎকার শুনে আমরা বাইরে বেড়িয়ে দেখি আসলে চৌকিদার বাড়িতে আগুন লাগেনি। রাস্তায় এসে দেখি নদীর মাঝে দাউ দাউ করে আগুনে পুড়ে যাচ্ছে লঞ্চটি। লঞ্চটি নদীর তিরমুখে ছিল। এরমধ্যে সুগন্ধা, গাবখান চ্যানেলে ভাসতে ভাসতে সেটি অপর পারে ঠেকে। ওপারে যদি কিছুক্ষণ থাকতো তাহলেও মানুষ কিছু প্রাণ বাচাঁতে পারতো। কিন্তু নদীর তীরে ধাক্কা লেগে আবার ভাসতে ভাসতে এদিকে এসে আমাদের ঘরের সামনে তীরে আটকে যায়।

লঞ্চের আগুনে নদী তীরের গাছপালা পুড়ে যায়। তার আঁচ লাগে আল আমিন চৌকিদারের ঘরেও। তবে আগুন লাগেনি সেই ঘরে। 

আল আমিনের স্ত্রী রীনা বেগম বলেন, এমন আগুনের ভয়াবহতা আমি কখনো দেখিনি। পুড়ে যাওয়া ৭/৮ বছরের এক শিশুকে আমি উদ্ধার করে নিয়ে আসার পরে কিছুক্ষণ জীবীত ছিল। এরপর মাটিতে শুয়ে মারা যায় শিশুটি। শিশুটির জন্য খুব মন কাঁন্দে।

রীনা বলেন, পরের দিন স্তুপ হয়েছিল এখানে পোশাকের। পোড়া মানুষ, দগ্ধ মানুষের পোশাক, ব্যাগ, জুতা এখানে ওখানে ছিল। সেই জামা-কাপড় অনেকেই নিয়ে গেছেন। তবে এখনও অনেকের পোশাক যত্ন করে রেখে দিয়েছি। তিনি বলেন, ঘটনাস্থল আর আমার ঘরের মধ্যে কোনো ব্যবধান নেই। এই এক বছর আমি ঠিকমতো ঘুমাতে পারিনি। সেই রাতে নারী, শিশুর আর্তনাদ, মৃত্যুর দৃশ্য দেখে এখনও আমরা স্বাভাবিক হতে পারিনি।

প্রতিবেশী আরেক গৃহবধূ বলেন, ওই রাতে আমাদের চৌকিদার বাড়ির ১৬টি ঘরে কমপক্ষে ৩০০ মানুষকে আমরা আশ্রয় দিয়েছিলাম। যার যে ধরনের সাহায্য দরকার ছিল করেছি। অনেককে শাড়ি, লুঙ্গি, জামা দিয়েছি। অনেকে শেষবারের মতো পানি খেতে চেয়েছে, ভাত খেতে চেয়েছে-আমরা যে যা চেয়েছে তা সব দিয়েছি। এসব মানুষের মধ্যে অনেকেই বাঁচেনি। ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরের দিন আমাদের অনেকের ঘরেই নিজেদের ব্যবহারের কিছু ছিল না। তারপরও আমরা অসন্তুষ্ট না। অন্তত মানুষের পাশে দাঁড়াতে পেরেছি বলে। তিনি বলেন, আমি শুনেছি মানুষ পিপিলিকার মতো পুড়ে মরে। কিন্তু ওই রাতে নিজের চোখে দেখেছি সেই ভয়াবহ মৃত্যু।

স্থানীয় উদ্ধারকারী মজিবুর রহমান মৃধা বলেন, শত শত মানুষ ওইরাতে লঞ্চের মানুষদের বাঁচাতে চেষ্টা করেছে, কাজ করেছে। এখন হয়তো অনেকই গ্রামবাসীর কথা ভুলে গেছে। কিন্তু আমরা সেই রাতের বিভিষিকার কথা ভুলতে পারবো না। এমন ভয়াবহ রাত কোনো মানুষ দেখেনি। দুর্ঘটনার পরে অত্র অঞ্চলের মানুষ ট্রমায় আক্রান্ত হয়েছিল।

আরেক উদ্ধারকারী মিলন মাঝি বলেন, রাতে এখনও নদীর দিকে তাকালে বুকটা খালি হয়ে যায়। ওই রাতে কত মানুষকে আমি নিজের ট্রলারে পার করেছি। কত মানুষকে মারা যেতে দেখেছি তা এখনও চোখের সামনে ভেসে উঠলে ঠিক থাকতে পারি না।

আরেক তরুণ বাসিন্দা রিয়াজুল ইসলাম বলেন, যেদিন নদীর তীরে লঞ্চ পোড়ে সেদিন আমি ঢাকায় ছিলাম। খবর পেয়ে এসে দেখি লঞ্চ যেখানে থেমে ছিল সেখানে ভয়াবহ অবস্থা। অনেক মানুষের পোশাক গাছে, ক্ষেতের বেড়ায় টাঙিয়ে রাখা হয়েছে। মানুষ এগুলোকে কাকতাড়ুয়া ভাবলেও বস্তুত এর সঙ্গে করুণ ট্রাজেডি জড়িয়ে আছে। আমরা যতবার এইস্থান আর এই পোশাকের সামনে দিয়ে যাই ততবারই আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়ি।

এদিকে নিহত ৪৯ জনের সবার পরিচয় এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। ডিএনএ টেস্টের রিপোর্ট না আসায় এখনও ১৬ জন নিহত বেওয়ারিশ হিসেবে শনাক্ত রয়েছেন। নিহতদের মধ্যে ২৩ জনের দাফন বরগুনা গণকবরে হয়েছে। পরিচয় শনাক্ত না হওয়ায় মামলারও অগ্রগতি হয়নি। যদিও মামলায় একবার গ্রেপ্তার হয়েছেন অভিযান ১০ লঞ্চের মালিক হামজালাল শেখ। দুর্ঘটনায় এখন পর্যন্ত তিনটি মামলা দায়ের হয়। এরমধ্যে দুটি মামলা চলমান রয়েছে।

এমএএস