মানসিক প্রতিবন্ধী ছেলে নিয়ে পলিথিন, পাটখড়ি আর বাঁশ দিয়ে বানানো খুপড়ি এক ঘরে রিজিয়া খাতুনের সংসার। ঘরটি মাঠের মাঝখানে হওয়ায় নিরাপত্তা নেই বললেই চলে। সেখানে নেই যাতায়াতের রাস্তা। নেই টিউবওয়েল ও বাথরুম। অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটে তাদের। কখনও কখনও না খেয়েও দিন পার করতে হয় তাদের। চরম দুঃখ দুর্দশা আর দুর্ভোগের মধ্যে মানবেতর জীবনযাপন করছেন এই মা-ছেলে। রোদ, শীত, বৃষ্টিতে ১২ মাসই তাদের কষ্ট। 

রিজিয়া খাতুন (৬৫) কুমারখালী উপজেলার সাদকী ইউনিয়নের তিন নম্বর ওয়ার্ডের তারাপুর গ্রামের বাসিন্দা। প্রায় ৩০ বছর আগে তার স্বামী রাজ্জাক মন্ডল স্ট্রোক করে মারা যান। স্বামীর মৃত্যুর পর তার জীবনে নেমে আসে নানা দুঃখ-কষ্ট। রিজিয়া খাতুনের ছেলে সিরাজুল ইসলাম (৩৭) মানসিক প্রতিবন্ধী। তার স্বামীর বাড়ি রাজবাড়ী হলেও বিয়ের পর থেকে তার তারা কুমারখালীতে বসবাস করতেন। স্বামীর মৃত্যুর পর পরের বাড়িতে থাকতেন ও কাজ করতেন। প্রায় ১০ বছর আগে পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া ২ কাঠা জমিতে পলথিনের ঘর করে বসবাস করা শুরু করেন রিজিয়া খাতুন ও তার ছেলে। 

কান্নাজড়িত কণ্ঠে রিজিয়া খাতুন ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রায় ৩০ বছর আগে আমার স্বামী স্ট্রোক করে মারা গেছেন। আমার একমাত্র ছেলের মাথায় সমস্যা। সে কোনো কাজ করতে পারে না। সারাদিন পথে-ঘাটে ঘুরে বেড়ায়। ছেলের চিকিৎসা করাতে পারি না। গত তিন বছর ধরে ওষুধ কিনে দিতে পারিনি ছেলের জন্য। আমি ও আমার ছেলে সরকারি কোনো ভাতা পাই না। এ পর্যন্ত সরকারি কোনো সুবিধাও পাইনি। আমার ঘর নেই, টিউবওয়েল নেই, পায়খানা নেই। পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া দুই কাঠা জমি ছাড়া আমার কিছুই নেই। অর্থের অভাবে অনাহারে অর্ধাহারে দিন কাটে আমাদের। পাটখড়ির বেড়া ও পলিথিনে মোড়ানো খুপড়ি ঘরে আমরা অনেক কষ্ট করে থাকি। শীতকালে শীতের কষ্ট, গরমকালে গরমের। মাঠের মধ্যে খোলামেলা জায়গায় পোকামাকড়ের ভয়ে থাকতে হয়। বর্ষাকালেও কষ্টের শেষ থাকে না। 

কাঁদতে কাঁদতে তিনি আরও বলেন, সরকার দেশের গরিব মানুষকে ভাতা দেয়, ঘর দেয়, খাদ্য দেয়, কম্বল দেয়। কিন্তু আজ পর্যন্ত আমার কপালে কিছুই জোটেনি। মেম্বার-চেয়ারম্যানরাও সাহায্য করে না। কেউ সহযোগিতা করেনি। আমি মাদরাসায় কাজের বিনিময়ে প্রতি সপ্তাহে ২০০ টাকা ও দুই কেজি চাল পাই। সেটা দিয়ে কষ্টে সংসার চলে। পাগল ছেলেটাকে নিয়ে আমি খুবই কষ্টের জীবন কাটাই। আমার দুঃখ বোঝার মতো কেউ নেই। সরকার যদি আমাদের সাহায্য সহযোগিতা করে তাহলে আমি খুব খুশি হবো।

প্রতিবেশী শহিদুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, বৃদ্ধা নারীর খুব কষ্ট। তার স্বামী বহুবছর আগে মারা গেছে। মানসিক প্রতিবন্ধী একমাত্র ছেলেকে নিয়ে অনাহারে-অর্ধাহারে তার দিন কাটে। উপার্জনের কেউ না থাকায় পরের বাড়ি কাজ করে এবং মানুষের কাছে চেয়ে সংসার চলে। তাদের জীবন খুব কষ্টের। বর্তমান যুগে এমন অসহায় মানুষ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। মেম্বার-চেয়ারম্যান কোনো সহযোগিতা করে না তাকে। তার কষ্ট দেখে আমাদের চোখে পানি চলে আসে। পলিথিনের নিচে তাদের বসবাস। ঘর নেই, টিউবওয়েল নেই, পায়খানা নেই, একেবারে নিঃস্ব মানুষ। তাদের কষ্ট দেখার কেউ নেই। তাকে সাহায্য সহযোগিতা করার জন্য সরকারের কাছে বিনীতভাবে অনুরোধ জানাচ্ছি।

স্থানীয় বেবি খাতুন ঢাকা পোস্টকে বলেন, তাদের খুবই কষ্ট। মাঠের মধ্যে কাঠখড়ির বেড়া ও পলিথিন দিয়ে মোড়ানো একটি খুপড়ি ঘরে থাকে তারা। এছাড়া তাদের কিছুই নেই। একটা পাগল ছেলে আছে। উপার্জনক্ষম কেউ নেই। বৃদ্ধ ওই নারীটি পরের বাড়িতে কাজ করে অল্প কিছু টাকা-পয়সা পায়। সেই টাকা দিয়ে তাদের সংসার চলে না। ঠিকমতো বাজার করতে পারে না। মাঠঘাট থেকে শাকসবজি তুলে এনে খায়। অনাহারে-অর্ধাহারে দিন পার করে। সরকার হাজার-হাজার লাখ-লাখ মানুষকে ঘর দেয়, ভাতা দেয়, খাদ্য দেয়। কিন্তু অভাগা বৃদ্ধা এই নারী সরকারের কিছুই পায় না।

স্থানীয় সাবেক ইউপি সদস্য আব্দুল করিম বলেন, ওই নারী খুবই অসহায় মানুষ। থাকার মতো ঘর নেই, আয় উপার্জনের উৎস নেই। স্থানীয় একটি মাদরাসায় কাজের বিনিময়ে ২০০ টাকা ও দুই কেজি চাল পায়। এ দিয়েই তার সংসার চলে। অনেক সময় ক্ষুধার জ্বালায় কোনো উপায় না পেয়ে বাধ্য হয়ে মানুষের কাছে সাহায্য চেয়ে তার সংসার চলে। 

সদকী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মিনহাজুল আবেদীন দ্বীপ ঢাকা পোস্টকে বলেন, রিজিয়া খাতুনকে সার্বিকভাবে সহযোগিতা করার চেষ্টা করবো। সরকারি বরাদ্দ অনুযায়ী তাকে সুবিধার আওতায় আনা হবে।

কুমারখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) বিতান কুমার মন্ডল বলেন, আমরা রিজিয়া খাতুনের খোঁজ নিয়ে দেখবো। সরকারের পক্ষ থেকে তাকে সহযোগিতা করা হবে। 

রাজু আহমেদ/আরকে