পরিবারের উদাসীনতা ও দারিদ্র্যতা শারীরিক প্রতিবন্ধী করেছে সোহেলকে। জন্মের ১২ বছর পর টাইফয়েড রোগে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসার অভাবে অকেজো হয়ে পড়ে তার দুই পা। এখন পা দুটোতে নেই কাজ করার সামর্থ্য। কিন্তু শারীরিক প্রতিবন্ধকতার কাছে হার মানেননি তিনি। মানুষের কাছে হাত না পেতে গড়ে তুলেছেন ভ্রাম্যমাণ আচারের দোকান। এই দোকানে বসে মুখোরচক খাবার ও আচার বিক্রি করে চলছে তার সংসার।  

সোহেল রানা (২৫) চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার দাইপুকুরিয়া ইউনিয়নের ধূমপাড়া গ্রামের মনিরুল ইসলামের ছেলে। চার ভাই-বোনের মধ্যে তৃতীয় সোহেল। তিনি প্রতিবন্ধতার কারণে পড়াশোনা করতে পারেনি। বয়সের ভারে কর্মহীন হয়ে পড়েছেন তার বাবাও। তার ভ্রাম্যমাণ আচারের দোকানের উপার্জনে চলছে বাবা-মা ও স্ত্রীকে নিয়ে ৪ জনের সংসার।  

পায়ের অক্ষম হওয়ার পর থেকে পরিবারের লোকজন ও প্রতিবেশীদের সহযোগিতায় চলাফেরা করতেন সোহেল। পরে স্থানীয় এক ব্যবসায়ী একটি হুইল চেয়ারযুক্ত ছোট্ট ভ্যান উপহার দেন তাকে। ১০ বছর আগে স্থানীয়দের সহযোগিতায় পাওয়া ৫০০ টাকা দিয়ে ওই ভ্যানে ভ্রাম্যমাণ দোকানে দেন। সেখানে পণ্য বিক্রি শুরু করেন। এতে আমড়া, জলপাই, বরইয়ের আচার, ভাজা, বিস্কুট, পাউরুটি, কেক বিক্রি করেন তিনি।  

জানা যায়, সপ্তাহের রোববার থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সকাল ৮টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত উপজেলার দাইপুকুরিয়া ইউনিয়নের শিকারপুর দক্ষিণপাড়া বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে মুখোরচক খাবার ও আচার বিক্রি করেন সোহেল। এছাড়াও শুক্র-শনিবার ও প্রতিদিন বিকেলে গ্রামে গ্রামে ঘুরে খাবার বিক্রি করেন তিনি। ভিক্ষা না করে নিজের যতটুকু সামর্থ্য রয়েছে তা কাজে লাগিয়ে জীবিকা নির্বাহ করায় তার প্রতি সহমর্মিতা দেখায় স্থানীয়রা। 

শিকারপুর দক্ষিণপাড়া বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রী আঁখি খাতুন ঢাকা পোস্টকে জানায়, বিভিন্ন পদের আচার, ভাজা, চানাচুর বিস্কুট কেক বিক্রি করেন সোহেল। আমাদের টিফিন হওয়া পর্যন্ত এখানে থাকেন। টিফিনে খাওয়া শেষ হলে সে চলে যায়। তার এই ভ্রাম্যমাণ দোকান থাকার কারণে আমাদেরকে টিফিনের বিরতিতে বাইরে খেতে যেতে হয় না। খাবারগুলোও খুব ভালো লাগে। 

সুমাইয়া খাতুন জানায়, সোহেলের খাবারের মতো তার ব্যবহারও খুব ভালো। আমরা সাধারণত এমন মানুষকে ভিক্ষা করতে দেখি। কিন্তু সোহেল ভাই মানুষের কাছে হাত না পেতে নিজেই কর্ম করে সংসার পরিচালনা করেন। 

শিকারপুর দক্ষিণপাড়া বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. মোখলেসুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, সোহেল সমাজের অন্য অক্ষম-প্রতিবন্ধীদের জন্য উদাহরণ। নিজেই উদ্যোক্তা হয়েছেন। ঘুরে ঘুরে আচার বিক্রি পরে সংসার পরিচালনা করছে। তার এই বিষয়টি আমাদের ভালো লেগেছে। তাই এই স্কুলের আশেপাশে  অন্য কোনো ভাজা বা আচার ব্যবসায়ীকে আমরা আসতে দেই না। 

স্থানীয় বাসিন্দা আব্দুল কাদের জানান, গত ৮-১০ বছর ধরে দেখছি বিকেলে রাস্তায় ঘুরে সোহেল আচার-ভাজা বিক্রি করছে। বিষয়টি আমাদের খুব ভালো লাগে। তাকে দেখে তার মতো অনেকেই উৎসাহ পাবে। তার বাবা কৃষি কাজ করত। কিন্তু তিনিও এখন আর কাজ করতে পারেন না। ফলে ৪ জনের সংসারের দায়িত্ব এখন তার কাঁধে। আল্লাহর রহমতে ও সকলের সহযোগিতায় এভাবেই তার জীবন চলে যাচ্ছে। 

শারীরিক প্রতিবন্ধী সোহেল রানা ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রতিবন্ধী দেখে কারো কাছে হাত পেতে সহযোগিতা চাইতে আমার লজ্জা লাগে। তাই সবটুকু সামর্থ্য কাজে লাগিয়ে কিছু করার আগ্রহ থেকে এই ব্যবসায় নেমেছি। ৫০০ টাকার পণ্য কিনে ব্যবসার প্রথম শুরু। সে টাকাও দিয়েছিল প্রতিবেশীরা। এখন দৈনিক ৩৫০-৪৫০ টাকা আয় হয়। আলহামদুলিল্লাহ বর্তমানে আয় কিছুটা হম হলেও ভালোই যাচ্ছে। 

তিনি আরও বলেন, বাবা-মা বয়সের ভারে ভালো চলাফেরা করতে পারে না। তাই স্থানীয়দের পরামর্শে গত ৯ মাস আগে বিয়ে করেছি। আচারগুলো মা করে দেয়, সে কাজে আমার স্ত্রী মাকে সহযোগিতা করে। আমার কাজে খুশি হয়ে স্থানীয় লোকজন, প্রতিবেশী ও ক্রেতারা ভালোই সহযোগিতা করে। 

দাইপুকুরিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আলমগীর মুঠোফোনে জানান, প্রতিবন্ধীরা আমাদের সমাজের বোঝা নয়, তারাও আমাদের সম্পদ। মেধা, সামর্থ্য কাজে লাগিয়ে তারাও সাফল হতে পারে। সেটার উৎকৃষ্ট উদাহরণ সোহেল রানা। সে বর্তমানে প্রতিবন্ধী ভাতার সুবিধা পায়। তবে এতে যেহেতু সংসার পরিচালনা করা সম্ভব নয়, তাই সে ভ্রাম্যমান দোকান চালায়। সরকারি বিভিন্ন সহযোগিতা প্রদানে সোহেল রানার মতো মানুষদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়।

জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের সমাজসেবা কর্মকর্তা ফিরোজ কবীর ঢাকা পোস্টকে বলেন, ইসলাম ভিক্ষাবৃত্তিকে সবসময়ই নিরুৎসাহিত করে। এমনকি সরকারও ভিক্ষুকদেরকে পুনর্বাসনে ব্যাপক কার্যক্রম পরিচালনা করছে। বর্তমানে আমরা দেখি কারো শারীরিক অক্ষমতা থাকলেই সেটাকে পুঁজি করে ভিক্ষাবৃত্তিতে নেমে যায়। কিন্তু এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন সোহেল রানা। 

তিনি আরও বলেন, সমাজসেবা অধিদপ্তর প্রতিবন্ধীদের ভাতা দেওয়ার পাশাপাশি তাদেরকে আরও অনেক ক্ষেত্রে সহয়তা করে থাকে। যেকোন প্রতিবন্ধী চাইলেই সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে ঋণ নিয়ে ব্যবসায় করতে পারেন। সোহেল রানার ব্যবসায়িক কার্যক্রমের আরও বড় করতে চাইলে আমাদের কাছে ঋণের আবেদন করতে পারে। এছাড়াও আমরা তার সঙ্গে এ বিষয়ে যোগাযোগ করব। 

জেলা সমাজসেবা কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় মোট ২৮ হাজার ৮৫৫ জনকে প্রতিবন্ধী ভাতা ও ৩৮৭ জনকে প্রতিবন্ধী শিক্ষা উপবৃত্তি দেওয়া হচ্ছে। জেলায় মোট প্রতিবন্ধীর সংখ্যা ৪২ হাজার ৪০১ জন। এদের মধ্যে ৭১৩ জন অটিস্টিক, ২১ হাজার ৫১০ জন শারীরিক, ১ হাজার ৮১ জন দীর্ঘস্থায়ী মানসিক, ৬ হাজার ৫৩০ জন দৃষ্টি, ২ হাজার ৪৯১ জন বাক, ৩ হাজার ৮২৩ জন বুদ্ধি, ১ হাজার ৭৮১ জন শ্রবণ প্রতিবন্ধী রয়েছেন। 

জাহাঙ্গীর আলম/আরকে