শীতে কাবু হচ্ছে শিশুরা, হাসপাতালে দ্বিগুণ চাপ
পৌষ শুরু হতে এখনো বাকি ৯ দিন। এরই মধ্যে উত্তরের জেলাগুলোতে শীত জেঁকে বসতে শুরু করেছে। তাপমাত্রা নেমেছে ১১ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। এতে বিপাকে পড়েছেন এ অঞ্চলের শিশু ও বয়স্করা। তারা শীতজনিত নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। বিশেষ করে শিশুরা নিউমোনিয়া, ডায়রিয়া, শ্বাসকষ্ট, জ্বর-সর্দিসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে। রংপুর বিভাগের হাসপাতালগুলোতেও বাড়ছে শিশু ও বয়স্ক রোগীর সংখ্যা। হঠাৎ করে রোগীর চাপ বৃদ্ধি পাওয়ায় হিমশিম খেতে হচ্ছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে।
রংপুর বিভাগের আট জেলায় গত একদিনে শীতজনিত রোগে আক্রান্ত ৪৯২ শিশুকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। আর গত এক সপ্তাহে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে তিন হাজারের বেশি শিশু। এর মধ্যে শুধু রংপুর মেডিকেল কলেজ (রমেক) হাসপাতালে ১ থেকে ৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত নিউমোনিয়া ও ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয় ২৭১ জন। যাদের সবার বয়স ১ মাস থেকে দেড় বছরের মধ্যে। এদের মধ্যে দুটি শিশু ইতোমধ্যে মারা গেছে।
বিজ্ঞাপন
মঙ্গলবার (৬ ডিসেম্বর) দুপুরে হাসপাতালের তৃতীয় তলায় শিশু ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা গেছে, প্রতিটি শয্যায় একাধিক শিশু চিকিৎসা নিচ্ছে। শয্যা না পেয়ে মেঝেতে বিছানা পেতে রাখা হয়েছে অনেক শিশুকে। রোগীর চাপে নার্স ও চিকিৎসকরা সেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন।
হাসপাতালের শিশু বিভাগের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের ইনচার্জ ও সিনিয়র স্টাফ নার্স মোছা. শিখিলী খাতুন জানান, এবার কোল্ড ডায়রিয়ায় শিশুরা বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। চলতি মাসে প্রতিদিন কম বেশি ৫০-৬০টি শিশু নিউমোনিয়া ও ডায়রিয়াসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হচ্ছে।
তিন মাস বয়সী শিশু নিবিড়কে নিয়ে হাসপাতালে এসেছেন মোসলেমা খাতুন নামে এক নারী। নীলফামারীর জলঢাকা থেকে আসা এই নারী জানান, তার নাতির কয়েক দিন ধরে সর্দি-কাশির সঙ্গে শ্বাসকষ্ট দেখা দিয়েছে। হঠাৎ অবস্থার অবনতি হওয়ায় গতকাল হাসপাতালে নিয়ে এসেছেন। শীতের কারণে নিউমোনিয়া হয়েছে বলে চিকিৎসকরা তাকে জানিয়েছেন।
এদিকে কুড়িগ্রাম, নীলফামারী, দিনাজপুর ও পঞ্চগড়সহ রংপুর বিভাগের অন্যান্য জেলার হাসপাতালগুলোতেও শীতজনিত রোগে আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা বাড়ছে বলে জানা গেছে। জনবল সংকটের কারণে রোগীদের সেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন সেখানকার চিকিৎসকরা। সামনে শীত বেশি পড়লে রোগীর চাপ আরও কয়েকগুণ বাড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
জানা গেছে, দিনাজপুর সদর হাসপাতালের বহির্বিভাগে প্রতিদিন শতাধিক শিশুকে চিকিৎসাসেবা দেওয়া হচ্ছে। শিশু ওয়ার্ডে ২০ শয্যার বিপরীতে প্রতিদিন ভর্তি হচ্ছে ৫০ থেকে ৬০ জন। মঙ্গলবার সেখানে শিশু রোগীর সংখ্যা ছিল ৫৭।
কর্তব্যরত চিকিৎসক ও নার্সরা জানিয়েছেন, শীতজনিত রোগের কারণে ১ মাস থেকে ৫ বছর বয়সী বেশির ভাগ শিশুই এখন জ্বর, সর্দি, কাশি, নিউমোনিয়া, ডায়ারিয়াসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে। গত এক মাস ধরে এই পরিস্থিতি চলছে। শীতজনিত রোগে মারা গেছে একটি শিশু।
দিনাজপুর অরবিন্দ শিশু হাসপাতাল, এম আবদুর রহিম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, জেনারেল হাসপাতালসহ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে শীতজনিত রোগে তিন শতাধিক শিশু চিকিৎসা নিচ্ছে বলে জানিয়েছেন সিভিল সার্জন ডা. বোরহানুল ইসলাম সিদ্দিকী।
পঞ্চগড়ে গেল কয়েকদিন ধরে ১১ থেকে ১৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে তাপমাত্রা ওঠানামা করছে। মঙ্গলবার (৬ ডিসেম্বর) সকাল ৯টায় তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ১১ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। দিন ও রাতে তাপমাত্রা দুই রকম থাকায় এই জেলায় পাল্লা দিয়ে বাড়ছে শীতজনিত রোগ। জ্বর, সর্দি, কাশি, শ্বাসকষ্ট, নিউমোনিয়াসহ ঠান্ডাজনিত রোগে হাসপাতালগুলোতে ভিড় করছেন রোগীরা।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে প্রতিদিন সকাল থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত তিন শতাধিক রোগী চিকিৎসা নিতে আসছেন। এদের মধ্যে বেশির ভাগই শিশু। গত ৫ দিনে জেলা সদর হাসপাতালে ৪৬২ জন রোগী ভর্তি হয়েছে। আর গত নভেম্বর মাসে এ হাসপাতালে ৩ হাজার ৬৪৮ জন শিশু ভর্তি হয়েছিল।
নীলফামারীর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে গত এক সপ্তাহে শীতজনিত রোগে আক্রান্ত ৪৫৩ শিশু ভর্তি হয়েছে। তবে কোনো মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি। হাসপাতালে শয্যা সংকুলান না হওয়ায় একই বেডে চিকিৎসা নিচ্ছে দুইজন করে শিশু। আবার অনেকেই চিকিৎসা নিচ্ছে হাসপাতালের বারান্দায়।
কথা হয় সদরের দারোয়ানি এলাকার আলেফা আক্তারের সঙ্গে। শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যায় তিনি তার দুই মাসের শিশু রানী আক্তারকে হাসপাতালে নিয়ে এসেছেন। ছয় দিন আগে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া আলেফা আক্তার বলেন, এখানে সব ওষুধ বাইরে থেকে কিনতে হচ্ছে। শুধু ডাক্তার এসে দেখে যাচ্ছেন, আর কিছু নাই।
এদিকে কুড়িগ্রামেও ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে ডায়রিয়া ও শিশু ওয়ার্ডে বেড়েছে রোগীর চাপ। হাসপাতালের ডায়রিয়া ওয়ার্ডে ৩৮ ও শিশু ওয়ার্ডে ৪৮ শয্যার বিপরীতে ৯০টি শিশু ভর্তি রয়েছে।
হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা কুড়িগ্রাম সদরের পাঁচগাছী ইউনিয়নের রহিম বলেন, গত ৪-৫ দিন ধরে আমার ১১ মাসের শিশুকে নিয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছি। ডায়রিয়া ওয়ার্ডে আছি। এখানে একটি বেডে দুজন করে শিশুকে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। এই হাসপাতালে শিশু ওয়ার্ডে বেডের সংখ্যা বাড়ানো উচিত।
চিকিৎসকরা বলছেন, উত্তরাঞ্চল শীতপ্রবণ হওয়ায় এই সময়ে শীতজনিত রোগের প্রকোপ অনেকটা বেড়ে যায়। এই মৌসুমে আবহাওয়া শুষ্ক থাকায় বাতাসে জীবাণুর পরিমাণ বেড়ে যায়। যার প্রভাব পড়ে শিশু ও বয়স্কদের ওপর। রোগ হিসেবে সর্দি, কাশি, শ্বাসকষ্ট বেশি হয়ে থাকে। আর শিশু ও বয়োজ্যেষ্ঠরা শীতজনিত রোগে বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকেন। তাই রোগ প্রতিরোধে শিশুদের চিকিৎসার পাশাপাশি গরম কাপড় ও উষ্ণতার পরামর্শ দিচ্ছেন তারা।
কুড়িগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ডা. মো. শাহীনুর রহমান জানান, শীতের প্রকোপ বৃদ্ধি পাওয়ায় হাসাপাতালে রোগীর সংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষ করে ডায়রিয়া ও শিশু ওয়ার্ডে বেডের বিপরীতে দ্বিগুণেরও বেশি রোগী ভর্তি আছে। শীতের শুরুতেই কুড়িগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে প্রতিদিন চিকিৎসা নিচ্ছেন ১২০০-১৩০০ রোগী।
রমেক হাসপাতালের পরিচালক ডা. শরিফুল ইসলাম জানান, শীতের কারণে নিউমোনিয়া, ডায়রিয়াসহ বিভিন্ন রোগের প্রকোপ দেখা দেয়। বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসা শিশুদের মধ্যে যাদের অবস্থা সংকটাপন্ন মনে হচ্ছে, তাদের ভর্তি করা হচ্ছে।
এদিকে হিমালয়ের কাছাকাছি হওয়ায় উত্তরাঞ্চলে বরাবরই শী বেশি পড়ে। তেঁতুলিয়া আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রাসেল শাহ বলেন, দিন দিন এদিকে তাপমাত্রা কমছে। মঙ্গলবার ভোর ৬টায় রেকর্ড করাহয় ১২ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। পরে সকাল ৯টায় রেকর্ড করা হয় ১১ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। অর্থাৎ বেলা বাড়ার পরও তাপমাত্রা কমেছে। গতকাল সোমবার রেকর্ড হয়েছিল ১২ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
তাপমাত্রা আরও কমতে পারে বলে জানান এই কর্মকর্তা।
রংপুর আবহাওয়া অফিসের আবহাওয়াবিদ মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, চলতি মাসের শেষ সপ্তাহে এই অঞ্চলে তাপমাত্রা আরও কমবে এবং শৈত্যপ্রবাহ বাড়বে। এখন তাপমাত্রা ১৩ থেকে ১৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসে ওঠানামা করছে।
চলতি মাসে দুটি শৈত্য প্রবাহ হতে পারে বলে জানান তিনি।
আরএআর