দেখতে অনেকটা চমচমের মতো। তবে আকার লম্বা ও চ্যাপটা। খেতে সুস্বাদু। বলছিলাম মেহেরপুরের ঐতিহ্যবাহী সাবিত্রী মিষ্টির কথা। এই মিষ্টির সুনাম দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিদেশেও জায়গা করে নিয়েছে। বিয়েবাড়ি কিংবা অতিথি আপ্যায়ন যেন সাবিত্রী ছাড়া বেমানান।

জানা গেছে, ব্রিটিশ আমল থেকেই সাবিত্রীর কারিগররা বংশ পরম্পরায় ঐতিহ্য টিকিয়ে রেখেছেন। সাবিত্রী মিষ্টির প্রথম কারিগর ছিলেন বাসুদেব সাহা। পরে মিষ্টি তৈরির এ বিদ্যাটি রপ্ত করেন তার ছেলে রবীন্দ্রনাথ সাহা। বাইরের কারিগর দিয়ে মিষ্টি তৈরির কাজ না করায় সাবিত্রীর গুণগতমান ও স্বাদ আজও একই রকম। কদরও বাড়ছে দিন দিন। বাজারের অন্যান্য মিষ্টির তুলনায় এর দামও কম। সাধ্যের মধ্যে হওয়ায় সবাই এটি কিনে খেতে পারে।

সাবিত্রী দক্ষিণ অঞ্চলের মেহেরপুর জেলার ঐতিহ্যবাহী মিষ্টি। ১৮৬১ সালে মেহেরপুর শহরের বড়বাজার এলাকার বাসুদেব সাহা নিজ বাড়িতে এই মিষ্টি তৈরি শুরু করেন। মিষ্টি বিক্রির অর্থ দিয়ে চলত তার সংসার। খাঁটি ও নির্ভেজাল অর্থে সতী সাবিত্রী’র নামেই বাসুদেব মিষ্টির নামকরণ করেন ‘সাবিত্রী’। সেসময় ভোজনরসিক জমিদারদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এ মিষ্টি। 

কালক্রমে স্থানীয়দের কাছে জনপ্রিয়তা পেয়ে দেশজুড়ে পরিচিতি লাভ করে। ধীরে ধীরে মেহেরপুরের সাবিত্রী আন্তর্জাতিক পর্যায়েও পরিচিত পেয়েছে। অতিথির নাস্তায়, আত্মীয়বাড়ি, ঘনিষ্ঠজনদের উপহার, বিয়ের অনুষ্ঠান ও নানারকম আয়োজনে তিন পুরুষ ধরে চলে আসা এ মিষ্টি ছাড়া যেন চলেই না। সরকারি দপ্তরের অনুষ্ঠানগুলোতে সাবিত্রী যেন অপরিহার্য। বাজারে মিষ্টির কদর ও চাহিদা বাড়লেও পর্যাপ্ত দুধ ও জনবলের অভাবে এখন ২০-৩০ কেজির বেশি মিষ্টি তৈরি করতে পারেন না।

বাসুদেব গ্র্যান্ড সন্সের বর্তমান মালিক বিকাশ সাহা বলেন, সাবিত্রী তৈরিতে ব্যবহৃত দুধ কিংবা মিষ্টি ফ্রিজে রাখা হয় না। ফ্রিজে রাখলে স্বাদ আর মান ঠিক থাকে না। প্রতিদিন সংগ্রহ করা দুধ ভারী কাঠ দিয়ে চুলায় জ্বাল করানো হয়। দিনের পুরো সময় ধরে দুধ জ্বাল দিতে হয়। সন্ধ্যার দিকে জ্বাল দেওয়া শেষ হলে তা ঠান্ডা করার জন্য রেখে দেওয়া হয়। পরের দিন সকালে সাবিত্রী বানিয়ে বিক্রি করা হয়। প্রতিদিন মিষ্টির যে পরিমাণ অর্ডার পাই সে অনুযায়ী দুধের পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়। 

বিকাশ সাহা আরও বলেন, দুধ-চিনি আর কাঠের দাম বেড়ে যাওয়া এবং সময়মতো দুধের যোগান না পাওয়ায় মাঝে-মধ্যে সংকট তৈরি হয়। বাপ-দাদার হাতের মিষ্টি তৈরির স্বত্ব অন্য কাউকে দিতে চাই না। যদি কেউ ভেজাল করে তাহলে দেড়শ বছরের সুনাম ক্ষুণ্ন হবে। বিষয়টি মাথায় রেখে বহিরাগত কাউকে কাজে নেওয়া হয় না। আমরা সাবিত্রী ও রসকদম মিষ্টি তৈরি করে থাকি। দুটোই মেহেরপুরের ঐতিহ্য বহন করে। প্রতি কেজি সাবিত্রী ও রসকদম ৪৫০ টাকা দরে বিক্রি করা হয়। 

সাবিত্রী মিষ্টি কিনতে এসেছেন সাহাবাজ আলী। তিনি বলেন, ‘বাপ-দাদা ও বন্ধু-আত্মীয়-স্বজনদের মুখ থেকে এ মিষ্টির কথা প্রথম শুনি। তখন থেকেই সাবিত্রী মিষ্টি কিনে নিজেরা খাই। আবার বিদেশে আত্মীয়-স্বজনদের পাঠাতে হয়।

ক্রেতা মজনুর রহমান বলেন, আমার পরিবারে সব আয়োজনে সাবিত্রী মিষ্টি চাই ই চাই। আগে অর্ডার দিয়ে রেখে ছিলাম। আজ নিতে এসেছি। প্রতি কেজি সাবিত্রী এখন ৪৫০ টাকা কেজি দরে কিনতে হচ্ছে।

ক্রেতা দুলাল হোসেন বলেন, ‘সাবিত্রী’ মিষ্টিকে মেহেরপুর জেলার গর্ব মনে করা হয়। প্রবাসীরাও এ মিষ্টি দিয়ে বিদেশিদের আকৃষ্ট করেন।

মেহেরপুর জেলা প্রেস ক্লাবের সভাপতি সিনিয়র সাংবাদিক তোজাম্মেল আযম বলেন, মেহেরপুরের ইতিহাস-ঐতিহ্য তুলে ধরতে গেলে সাবিত্রী মিষ্টির নাম চলে আসে। আমরা ছোট থেকেই এই মিষ্টির সঙ্গে পরিচিত। হাত বদল হলেও জৌলুস আর সুনাম এখনো ধরে রেখেছেন কারিগররা।

মেহেরপুরের বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক রফিকুর রশীদ রিজভি বলেন, আমরা এখন প্রবীণ। ছোটবেলায় মেহেরপুরের সাবিত্রী যেমন সুনাম অর্জন করেছে, সেই সুনাম আজও তারা ধরে রেখেছে। জেলার সাবিত্রী এখন বিদেশেও সুনাম অর্জন করছে।

মেহেরপুরের জেলা প্রশাসক ড. মোহাম্মদ মুনসুর আলম খান বলেন, মেহেরপুর ইতিহাস ও ঐতিহ্যে ঘেরা একটি জেলা। বাসুদেব সাহার সৃষ্টি সাবিত্রী মিষ্টি জেলার ঐতিহ্যকে বিদেশেও পরিচিত করে দিয়েছে। 

এসপি