সিরাজগঞ্জের তাড়াশে ৫০ বছর বয়সে এবার এসএসসি পাস করলেন মো. আব্দুল মতিন মহসিন নামে এক ব্যক্তি। এদিকে এই বয়সে এসএসসি পাস করায় উচ্ছ্বসিত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স মাস্টার্স এ ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হওয়া ডিনস অ্যাওয়ার্ড প্রাপ্ত তার মেয়ে। 

শুধু মেয়েই নয়, উচ্ছ্বসিত সেই ব্যক্তি, তার শিক্ষক ও আত্মীয়-স্বজনরাও। জীবনের অনেক চড়াই-উৎরাই পাড়ি দিয়ে এই বয়সে মনবল অক্ষুণ্ণ রেখে এসএসসি পাস করায় তাকে অভিনন্দনও জানাচ্ছেন সবাই। তিনি কম্পিউটার ট্রেডে কারিগরি বিভাগ থেকে জিপিএ ৪.৬১ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছেন। 

মো. আবদুল মতিন মহসিন সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলার বারুহাস ইউনিয়নের খরখরিয়া গ্রামের মৃত জোমশের আলী ভূঁইয়ার ছেলে। পেশায় একজন কৃষক হলেও তিনি একজন সাংস্কৃতিক কর্মীও। গান-নাটকের পাশাপাশি করেন রাজনীতি। এর আগে হয়েছিলেন ইউপি সদস্য প্রার্থীও।

তিনি কুসুম্বি নাজাতুল্লাহ আয়েশা মেমোরিয়াল টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে কারিগরি বিভাগে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেন। ব্যক্তি জীবনে তিনি এক ছেলে ও এক মেয়ের জনক। মেয়ে অলিভা আক্তার মায়া ভাই বোনের মধ্যে বড় এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সংস্কৃত বিভাগে অনার্স ও মাস্টার্সে এ ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট ও ডিনস অ্যাওয়ার্ডপ্রাপ্ত। 

অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে আব্দুল মতিন মহসিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, পারিবারিক নানান জটিলতা ও অভাব অনটনের সংসারে পড়াশোনা করা হয়ে ওঠেনি। কিন্তু যখন মেয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিনস অ্যাওয়ার্ড পেল এবং সেখানে আমাদেরকে ডাকা হলো তখন আমি উপলব্ধি করলাম শিক্ষার কত সম্মান। তখন নিজেকে খুব ছোট মনে হচ্ছিল। মেয়ে আজ এতো ভালো রেজাল্ট করে অ্যাওয়ার্ড পাচ্ছে কিন্তু আমি তার বাবা হয়ে এসএসসি পাসটিও করতে পারিনি। তখনই মনে হলো আমার আবার পড়াশোনা করা উচিত। 

তিনি আরও বলেন, তখন আমি সেখান থেকে ফিরে এসেই আমার মেয়েকে বললাম আমি আবার ভর্তি হয়ে পড়াশোনা করতে চাই। কিন্তু প্রথমদিকে আমার মেয়ে রাজি হচ্ছিল না। অন্যদিকে পড়াশোনা করার জন্য মন অধীর হয়ে গিয়েছিল। তখনই আমি ভর্তি হয়ে যাই। অবশেষে কাজের ফাঁকে ফাঁকে পড়াশোনা করে এবং শিক্ষকদের সার্বিক সহযোগিতা পেয়ে আজ এসএসসি পাস করলাম। এ অনুভূতি প্রকাশ করার ভাষা নেই। আজ সবাই খুব খুশি হয়েছে। আমি আমার পড়াশোনা আরও চালিয়ে যাব।

তার মেয়ে অলিভা আক্তার মায়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সংস্কৃত বিভাগে অনার্স ও মাস্টার্সে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হওয়ায় আমাকে ডিনস অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হয়। তারপরেই বাবা স্কুলে নতুন করে নবম শ্রেণিতে ভর্তি হতে চান। কিন্তু আমি প্রথমে তাকে নিষেধ করি। বলি, মানুষ কি বলবে? মানুষ হাসাহাসি করবে, দরকার নেই। কিন্তু তার ইচ্ছাশক্তি এতো প্রখর ছিল যে তিনি ভর্তি হয়ে যান এবং পড়াশোনা শুরু করে দেন। এরপরে আজ তিনি মোটামুটি ভালো রেজাল্ট নিয়েই এসএসসি পাস করলেন। 

তিনি অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে বলেন, বাবা খুব কষ্ট করে আমাদেরকে বড় করেছেন। তিনি মূলত কৃষি কাজ করলেও একজন সাংস্কৃতিক কর্মীও। ভালো গান ও অভিনয় করতে পারেন। পাশাপাশি ভালো একজন রাজনীতিবীদ। তিনি এতো কিছুর পাশাপাশি পরীক্ষা দিয়ে এভাবে পাস করবেন ও ভালো রেজাল্ট করবেন আমি ভাবতেও পারিনি। আমি সত্যিই আজ খুব আনন্দিত, খুব উচ্ছ্বসিত। আমি কল্পনাও করতে পারিনি বাবা এভাবে এসএসসি পাস করবেন। 

নাজাতুল্লাহ আয়েশা মেমোরিয়াল টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ মো. গোলাম কিবরিয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, মহসিন যখন ভর্তি হওয়ার কথা বলল তখন আমি তাকে সবচেয়ে বেশি ইন্সপায়ার করেছিলাম। পরবর্তীতে সে ভর্তি হয় এবং পড়াশোনা শুরু করে। আজ সে সম্মানের সঙ্গে ভালো রেজাল্ট করে আমার প্রতিষ্ঠান থেকে পাস করলো। এতে শুধু শুধু আমি নই, প্রতিষ্ঠানের সকল শিক্ষক-কর্মচারী থেকে শুরু করে সকল শিক্ষার্থী ও এলাকাবাসীও আনন্দিত ও উচ্ছ্বসিত। আমি চাইবো মহসিন আগামীতেও তার পড়াশোনা চালিয়ে যাক। 

এ ব্যাপারে বিশিষ্ট সাংবাদিক, শিক্ষক ও গবেষক এবং ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোকলোর স্টাডিজ বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মিঠুন মোস্তাফিজ ঢাকা পোস্টকে বলেন, তিনি আমার ফুফাত ভাই এবং বোন জামাই। আমি দেখেছি তিনি কত কষ্ট করে, জীবনের সঙ্গে সংগ্রাম করে বড় হয়েছেন। আজ তিনি কেবল এসএসসি পাস করেননি; বরং তার ইচ্ছাশক্তির বিজয় হয়েছে। তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন, ইচ্ছাশক্তি থাকলে পড়াশোনার কোনো বয়স লাগে না। আমি তার এই অর্জনে সত্যিই খুব খুশি হয়েছি। তার বয়সী এই মানুষগুলোর জন্য একজন মডেল হতে পারেন তিনি। তার বিশ্ববিদ্যালয় পাস করা মেয়েও আজ দারুণ খুশি এবং ভীষণ উচ্ছ্বসিত। যখন কোনো সন্তান পিতার জন্য আনন্দিত হয়, উচ্ছ্বসিত হয়, তখন সেটা সেই পিতার দারুণ গর্বের একটি অর্জন নিঃসন্দেহে।


শুভ কুমার ঘোষ/এমএএস