দিনাজপুরে সুগন্ধি ধানের বাম্পার ফলনেও কৃষকের মনে শঙ্কা
দেশে-বিদেশে বেশ কদর সুগন্ধি চালের। চাহিদা থাকায় দিন দিন বিভিন্ন জেলায় এ ধানের চাষ বাড়ছে। এ বছর ভালো ফলনও হয়েছে সুগন্ধি ধানের। আগামী দুই-এক সপ্তাহের মধ্যে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে বাম্পার ফলনের আশা করছেন কৃষকরা। তবে ফলন ভালো হলেও ধানের দাম নিয়ে দুশ্চিন্তায় কৃষকেরা।
সরেজমিনে জেলার কয়েকটি উপজেলায় ঘুরে দেখা গেছে, চারদিকে এখন ঢেউয়ের মতো দোল খাচ্ছে সুগন্ধি ধানের সোনালি শীষ। সবুজ ধান গাছ হলুদ বর্ণ ধারণ করছে। সুগন্ধি ধানের মিষ্টি গন্ধে সোনালি ধানের শীষে ঝলমল করছে ফসলের মাঠ। মাঠভরা ফসল দেখে কৃষকদের চোখে-মুখে হাসি ফুটে উঠলেও ধানের দাম নিয়ে তৈরি হয়েছে শঙ্কা।
বিজ্ঞাপন
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, জেলায় চলতি মৌসুমে সুগন্ধি ধানের আবাদ হয়েছে ৮৮ হাজার ৫৮৫ হেক্টর জমিতে। গত বছরের তুলনায় ২ হাজার ৯৬২ হেক্টর জমিতে বেড়েছে সুগন্ধি ধানের আবাদ। কৃষি বিভাগ বলছে, গত মৌসুমে পোকার আক্রমণে কম ফলন হলেও ধানের দাম ভালো থাকায় এ বছর এ ধানের আবাদ বেড়েছে। চলতি মৌসুমে কৃষি বিভাগ তৎপর থাকায় রোগবালাই নেই বললেই চলে তাই ফলনও ভালো হয়েছে।
কয়েক বছরে জেলায় সুগন্ধি ধানের আবাদে এসেছে বড় পরিবর্তন। গত এক দশকে দিনাজপুরে সুগন্ধি ধানের আবাদ বেড়েছে অনেক গুণ। তবে জেলার সদর, বিরল, পার্বতীপুর ও চিরিরবন্দর উপজেলায় সবচেয়ে বেশি সুগন্ধি ধান আবাদ হয়। ঐতিহ্য ধরে রাখতে দিনাজপুরে সামান্য পরিমাণে উৎপাদিত হয় সুগন্ধি বাদশাভোগ ধান। শুধু বাদশাভোগ নয়, আরও আছে চিনি কাটারি, জিরা ৩৪, জিরা কাটারি, জটা কাটারি, কাটারিভোগ, ফিলিপাইন কাটারি, কালো জিরা, চল্লিশ জিরাসহ বেশ কয়েকটি প্রজাতির সুগন্ধি ধান।এই চাল দেখতে সরু ও লম্বা। এর অগ্রভাগ ছুরির মত একটু চোখা ও বাঁকা। এটি বাংলাদেশের সকল এলাকায় হয় না। এমনকি দিনাজপুরেও কেবল দিনাজপুর সদর উপজেলার ফাসিলাট, ছোট বাউল, বড় বাউল, করিমুল্লাপুর, খানপুর, চিরিরবন্দর উপজেলায় কাউগাঁ, বিষ্টপুর, তালপুকুর মুকুন্দপুর, দুর্গা ডাঙ্গা, ভিয়াইল, পশ্চিম বাউল ও কাহারোল উপজেলার দু-একটি উঁচু জায়গায় এ বিশেষ জাতের ধান চাষ হয়। উঁচু বেলে-দোআঁশ মাটি কাটারিভোগ চাষের উপযোগী। কাটারিভোগ চালের চিড়া প্রসিদ্ধ। এই চাল দিয়ে পোলাও, বিরিয়ানি, জর্দা, পায়েস, ফিরনি প্রভৃতি প্রস্তুত করা যায়। এই চাল সুগন্ধযুক্ত ও সুস্বাদু। বিত্তবান কিংবা মধ্যবিত্তদের বিভিন্ন উৎসব-অনুষ্ঠানে, হোটেল-রেস্তোরাঁয়ও সুগন্ধি চালের ব্যবহার বেড়েছে।
দিনাজপুরে সদর উপজেলার মোহনপুর গ্রামের কৃষক মনির হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, সুগন্ধি ধানের ফলন ভালো হয়েছে। তবে শেষ সময়ে এসে ধানে কিছু পোকার আক্রমণ দেখা দিছে এজন্য খরচ বাড়ছে। তবে জিরা ধানে গত বছরের তুলনায় এবার খরচ বাড়ছে দ্বিগুণ। কিন্তু ধানের বাজার নিয়ে আমাদের দুশ্চিন্তা, কারণ ধানা কাটা মাড়াই করার সময় এ ধানের দাম কমে যায় তখন ন্যায্য দামে ধান বিক্রি করতে পারি না।
সদর উপজেলার শেখপুরা ইউনিয়নের দক্ষিণ শিবপুর গ্রামের কৃষক বিকাশ রায় ঢাকা পোস্টেকে বলেন, আমি এবার ৩ একর জমিতে সুগন্ধি ধান আবাদ করেছি। ধানের ফলন খুব ভালো হয়েছে। তবে গত বছরের তুলনায় খরচ বাড়ছে। সুগন্ধি ধান লাগানোর সময় বৃষ্টি না থাকায় সেচ দিয়ে পানি দিতে হয়েছে এবার সার, কীটনাশক ও ধান কাটা শ্রমিকের দাম বেশি। এখন দামটা ভালো পেলেই হয়। না হলে ক্ষতিগ্রস্ত হতে হবে।
মথুরাপুর গ্রামের কৃষক জহির উদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আামি এবার সুগন্ধি ধান ২০ বিঘা জমিতে চাষ করেছি। ধানের ফলন ভালো হয়েছে। তবে শেষ সময় এসে ধানে পোকার আক্রমণ দেখা গেছে। তাই খরচটা বেড়ে যাচ্ছে। ধান কাটার পর ধানের দামটা ভালো থাকলে লাভবান হব।
চিরিরবন্দর উপজেলার পুনট্রি গ্রামের কৃষক উদয় রায় ঢাকা পোস্টকে বলেন, জিরা ৩৪ সুগন্ধি ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। কৃষি বিভাগের পারার্মশে এবার আমি প্রায় ৩ বিঘা জমিতে সুগন্ধি ধান লাগিয়েছি। তবে গতকয়েক বছরের তুলনায় খরচ প্রায় দিগুণ হারে বেড়ে গেছে। গত বছর ৮০০ টাকার সার এবার ১৪০০ টাকা দিয়ে কিনতে হয়েছে। কিন্তু ধান কাটা মাড়াই শুরু হলে এ ধানের বাজার দর কমে যায়। ধানের বাজার যদি বস্তা প্রতি ৪ হাজার ৫০০ টাকার ওপর না থাকে গত বছরের মতো শুরুতে তিন বা সাড়ে তিন হাজার টাকা বস্তা থাকে তাহলে এবার কৃষক লাভবান হতে পারবে না।
চিরিরবন্দর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা জোহরা সুলতানা ঢাকা পোস্টকে বলেন, জেলার সবচেয়ে বেশি সুগন্ধি ধানের আবাদ চিরিরবন্দর উপজেলায়। সুগন্ধি ধান দিনাজপুরের একটি ঐতিহ্য। ইতোমধ্যে ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। ফলে কাটারিভোগ এখন বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের প্রকৃতি, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতিনিধিত্ব করে। সুগন্ধি ধানের আবাদ বাড়াতে কৃষি বিভাগ সবসময়ই কৃষকদের পাশে থেকে বিভিন্ন পরামর্শ ও সহযোগিতা দিয়ে আসছে। গত বছরের তুলনায় এ বছর সুগন্ধি ধানের ভালো ফলন হয়েছে। কৃষকরাও অনেক খুশি। সুগন্ধি ধানের এর মধ্যে জিরা-৩৪ আবাদ হয়েছে সবচেয়ে বেশি। তবে কিছু জমিতে শেষ সময়ে এসে পোকার আক্রমণ দেখা দেয়। আমার কৃষকদরে বিভিন্নভাবে সচেতন করার চেষ্টা করি।
ইমরান আলী সোহাগ/আরকে