২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর। দুদিন ধরেই বৃষ্টি হচ্ছিল। তখন আমি তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী। বৃষ্টিতে ভিজে বাড়ি ফেরায় মায়ের বকুনি খেতে হয়। সন্ধ্যার পর থেকেই হঠাৎ গতি বেড়ে যায় বাতাসের। বকুনি খেলেও মায়ের কোল ঘেঁষে বসে থাকি। কিছুক্ষণ পর ঘরের মধ্যে পানি উঠতে থাকে। দ্রুত পরিবারের ৭ সদস্য পাশের একটি বাড়িতে আশ্রয় নিই। ১৫ বছর আগের সেই ঘটনা বলতে গিয়ে বার বার বাকরুদ্ধ হয়ে যাচ্ছিলেন শরণখোলার সোহাগ। 

তিনি বলেন, রাত আনুমানিক ৯টা। অপেক্ষাকৃত উঁচু পাশের বাড়ির ঘরের মধ্যে পানি উঠতে থাকে। লোকজনের চিৎকারে সবাই বাইরে আসি। চারদিকে তখন পানি আর কচুরিপানা। অন্ধকারের মধ্যেই পরিবারের সদস্যরা হাত ধরাধরি করে আশ্রয়কেন্দ্রের দিকে যাচ্ছি। হঠাৎ স্রোতের তোড়ে আমার হাত ছুটে যায়। কি করব বুঝতে পারছি না, ভালো সাঁতারও জানি না। এর মধ্যে বড় একটি ঢেউ আমাকে ছুঁড়ে ফেলে মোটা একটি গাছের উপরে। সেই গাছ ধরেই বেঁচে যাই। পরের দিন সকালে নেমে এসে পরিবারের সদস্যদের খুঁজতে থাকি। কিন্তু বাবা-মাসহ ৬ জনকে আর খুঁজে পাইনি। চার দিন পর মায়ের ও ১০ দিন পরে বাবার মরদেহ খুঁজে পাই। এছাড়া জলোচ্ছ্বাসে ভেসে গেছে আমার বংশের দুই বছরের শিশু থেকে শুরু করে বিভিন্ন বয়সের ২২ জন নারী-পুরুষ।

একই উপজেলার সাউথখালী এলাকার আল-আমিন। সেদিন সন্ধ্যার কিছু আগে তাফালবাড়ি বাজারে যান কিছু জিনিস কিনতে। কিন্তু তাফালবাড়ি বাজারে যাওয়ার পর বৃষ্টি বাড়লে তিনি আর বাড়ি ফিরে আসতে পারেননি। আল আমিন বলেন, যখন বাতাসের গতি বেড়ে যায়, তখন আমি তাফালবাড়ি বাজারের একটি ভবনে আশ্রয় নিয়েছিলাম। সারা রাত সেকি তাণ্ডব। দুঃশ্চিন্তায় রাত কেটে গেছে। ভোরের দিকে বাতাস কমে গেলে রাস্তায় বের হয়ে দেখি গাছ আর গাছ। হাঁটার কোনো উপায় নেই। অনেক কষ্ট করে বাড়িতে গিয়ে দেখি, সেখানে ঘর-বাড়ির কোনো চিহ্ন নেই। বাড়িতে থাকা বাবা-মা, ফুফু, ফুফাতো বোন, ভাগ্নে এবং নানিকে আর খুঁজে পাইনি। পরের কয়েক দিন ধানক্ষেত, মানুষের বাগানসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে তাদের মরদেহ এনে কবর দিয়েছিলাম।

সিডরের সেই ভয়াবহতা আজও তাড়া করে বেড়ায় উপকূলবাসীদের। ঘুমের মধ্যে দুঃস্বপ্ন দেখে আঁতকে উঠেন অনেকে।

সরকারি হিসেবে সিডরে বাগেরহাট জেলায় নিহত হয়েছিলেন ৯০৮ জন এবং আহত হয়েছিলেন ১১ হাজার ৪২৮ জন। সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত হয় ৬৩ হাজার ৬০০ বাড়িঘর। আংশিকভাবে বিধ্বস্ত বাড়িঘরের সংখ্যা ১ লাখ ৬ হাজার। সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয় পাকা ৫ কিলোমিটার সড়ক, কাঁচা সড়ক ধ্বংস হয় প্রায় ৫০ কিলোমিটার এলাকার। আর পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয় সাড়ে ১৬ কিলোমিটার বাঁধ। মারা যায় ১৭ হাজার ৪২৩টি গবাদি পশু। বিনষ্ট হয়েছে ১২ হাজার হেক্টর ক্ষেতের ফসল ও ৮ হাজার ৮৮৯ হেক্টর চিংড়ি ঘের।

স্বজন হারানোর বেদনা ও আর্থিক ক্ষতি ভুলে উপকূলবাসীর একমাত্র দাবি ছিল টেকসই বেড়িবাঁধ। গণমানুষের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে সরকার ২০১৫ সালে সাড়ে তিনশ কোটি টাকা ব্যয়ে উপকূলীয় বাঁধ উন্নয়ন প্রকল্প (সিইআইপি) নামে একটি প্রকল্পের অধীনে মোরেলগঞ্জ থেকে শরণখোলা উপজেলার বগী-গাবতলা পর্যন্ত ৬২ কিলোমিটার টেকসই বাঁধ নির্মাণ শুরু করে। বেড়িবাঁধের প্রায় ৬০ কিলোমিটার কাজ সম্পন্ন হলেও অরক্ষিত রয়ে গেছে সাউথখালী ইউনিয়নের গাবতলা আশার আলো মসজিদ থেকে বগী পর্যন্ত দুই কিলোমিটার বাঁধ।

২০১৬ সালে ২৬ জানুয়ারি শুরু হয় বাঁধ নির্মাণকাজ। ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও ঠিকাদার পরবর্তী সময়ে আরও তিন দফা সময় বাড়িয়েছেন। সর্বশেষ বর্ধিত মেয়াদ অনুয়ায়ী, ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে বাঁধ হস্তান্তরের কথা রয়েছে।

বলেশ্বর নদীপাড়ে বগী এলাকায় দেখা যায়, এখনো সেখানে কয়েকটি ঝুপরি ঘর রয়েছে। এর মধ্যে একটি ঘরে থাকেন অশীতিপর জয়নব বিবি। সিডরে হারিয়েছেন থাকার ঘরটুকু। সন্তানরা বাইরে থাকে। কোনো রকম মানুষের কাছে চেয়ে দিন কাটে তার। বাঁধের পাশে ঘরটুকু পেয়েছিলেন, তাও যেকোনো সময় পড়ে যেতে পাড়ে। হালকা বাতাস হলেও দুঃশ্চিন্তায় রাত জেগে বসে থাকতে হয় তাকে। এই নড়বড়ে ঘরই তার একমাত্র সম্বল।

চলতি বছরের ১১ মে দুপুরে শরণখোলা উপজেলার গাবতলা বাজার সংলগ্ন বেড়িবাঁধের মাঝে ১৫-২০ ফুট লম্বা ফাটল দেখা যায়। এর আগে ফেটে যাওয়া এলাকায় বেড়িবাঁধের বাইরে থাকা গাবতলা গ্রামের ছফেদ খানের ১০ কাঠা জমি গাছপালাসহ নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়।

ছফেদ খান বলেন, বেড়িবাঁধের বাইরে আমার এক বিঘা (৬৫ শতক) জমি ছিল। হঠাৎ করে ১০ কাঠা জমি দেবে যায়। পরবর্তীতে আস্তে আস্তে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায় আমার জমি। বাকি জমিতেও ফাটল রয়েছে। যেকোনো সময় নদীতে বিলীন হয়ে যেতে পারে। এভাবে বাপ-দাদার অনেক জমি হারিয়েছি আমরা।

সম্প্রতি উপকূলে দুর্যোগ না থাকলেও বাঁধ ভেঙে নদীগর্ভে চলে হচ্ছে। নদী শাসন ছাড়া শুধু বাঁধ নির্মাণ ও মেরামত করে ভাঙনের প্রতিকার মিলবে না বলে দাবি স্থানীয়দের। এসব বাঁধ নির্মাণে অনিয়মের অভিযোগও রয়েছে। এছাড়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্মাণাধীন ৩৫/১ পোল্ডারের বেড়িবাঁধে পর্যাপ্ত স্লুইস গেট নির্মাণ না করে অপরিকল্পিতভাবে ছোট এবং অল্প গেট নির্মাণের কারণে বৃষ্টি বা জোয়ারের পানি নিষ্কাশন হয় না ঠিকমতো। ফলে দিনের পর দিন পানিবন্দি থাকতে হয় বাসিন্দাদের। 

স্থানীয়রা জানান, একটু ভারী বৃষ্টি হলেই কয়েক দিন ধরে পানিবন্দি হয়ে পড়তে হয় তাদের। পানি নামার ব্যবস্থা না থাকায় গত ২৭ জুলাই বৃষ্টির পানিতে ৭ দিন পানিবন্দি ছিল উপজেলার কয়েক হাজার মানুষ। পানিতে নিমজ্জিত ছিল আমনের বীজতলা। এক সপ্তাহ পরেও পানি না নামায়, বাঁধ কেটে দেয় ক্ষুব্ধ জনতা।

শরণখোলা উপজেলার সাউথখালী ইউনিয়নের ৭ নং ওয়ার্ডের সদস্য রিয়াদুল পঞ্চায়েত বলেন, আমাদের দীর্ঘ দিনের দাবি ছিল নদী শাসন করে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের। কিন্তু নদী শাসন না করেই বাঁধ নির্মাণ হওয়াতে বড় কোনো দুর্যোগে আবারও স্থানীয়দের জীবন-জীবিকা সংকটে ফেলবে বলে মনে করেন তিনি।

নদী শাসন করে বাঁধ নির্মাণের দাবিতে ১৫ নভেম্বর সিডর দিবসে বলেশ্বর নদীর তীরে স্থানীয়রা মানবন্ধন করবে বলে জানিয়েছেন ৬ নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য জাকির।

শরণখোলা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান রায়হান উদ্দিন শান্ত বলেন, সিডর বিধ্বস্ত মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে বর্তমান সরকার ব্যাপক কাজ করেছে। কিন্তু টেকসই বেড়িবাঁধের নামে যে বাঁধ হয়েছে তা পরিকল্পিতভাবে হয়নি। পর্যাপ্ত স্লুইস গেট না থাকায় এই এলাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। সম্পন্ন হওয়া বাঁধে আরও স্লুইস গেট নির্মাণ এবং অসস্পূর্ণ বাঁধ দ্রুত নির্মাণের দাবি জানান তিনি।

উপকূলীয় বাঁধ উন্নয়ন প্রকল্পের (সিআইপি) নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আশরাফুল আলম বলেন, সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের সময় নদীর গতি-প্রকৃতি যেভাবে ছিল, সেভাবে জরিপ করে বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু নদীর গতিপথ পরিবর্তনের কারণে ভাঙন দেখা দিতে পারে। আশা করি দ্রুতই সব কাজ শেষ হবে।

তানজীম আহমেদ/এসপি