সমতল ভূমি থেকে ৭২ ফুট গভীর নদী। আর নদীর কোল ঘেঁষেই ৫২ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত হয় বিদ্যালয়টি। বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যাও ভালো। কিন্তু যোগাযোগ ব্যবস্থা বেহাল। নদীর একপাশ থেকে আরেক পাশে যেতে ঘুরতে হয় দূরের পথ। আবার ডিঙি নৌকায় যাওয়া যায় সহজেই। এতে থাকে চরম ঝুঁকি। তবুও গভীর নদী পাড় হয়ে বিদ্যালয়ে যায় শিক্ষার্থীরা।

জয়পুরহাট জেলা সদরের আমদই ইউনিয়নের মুরারীপুর এলাকায় বিদ্যালয়টি অবস্থিত। ১৯৭০ সালে তুলসীগঙ্গা নদীর কোল ঘেঁষে মুরারীপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়। ঝুঁকি নিয়ে ডিঙি নৌকায় চড়ে ওই নদী পার হয়ে প্রতিদিন বিদ্যালয়ে যাতায়াত করে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা।

সরেজমিনে জানা গেছে, দীর্ঘ ৫২ বছর পেরিয়ে গেলেও দেশের চলমান উন্নয়নের সঙ্গে বিদ্যালয়টিতে যাওয়ার পথের তেমন উন্নয়ন হয়নি। নৌকায় যাতায়াত না করলে তাদের প্রায় ৪ কিলোমিটার পথ ঘুরতে হয়। আবার সেই পথের অবস্থাও বেহাল। বৃষ্টি হলে দূরের সেই পথে থাকে কাঁদা। এক সময় এই বিদ্যালয়ে তিন শতাধিক শিক্ষার্থী লেখাপাড়া করলেও যাতায়াতের অসুবিধার কারণে তা দাঁড়িয়েছে ১৬০ জনে। শুধু শিক্ষার্থীরাই নয়, আশপাশের দুই ইউনিয়ন আমদই ও পুরানাপৈলের আটটি গ্রামের মানুষের এমন ভোগান্তি নিত্যদিনের সঙ্গী।

ওই বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী আবু হোসেন বলে, আমার বাড়ি নদীর ওই পাড়ের গোবিন্দপুর গ্রামে। আর নদীর এই পাড় মুরারীপুর গ্রামে বিদ্যালয়। অনেক সময় বৃষ্টি হলে নৌকায় চড়ার জন্য নদীতে নামতে গিয়ে পড়ে যাই। আবার নৌকা থেকেও পড়ে যাই। এ সময় আমাদের বই-খাতা পানিতে ভিজে যায়। এতে আমাদের অনেক কষ্ট হয়।

আরেক শিক্ষার্থী মঞ্জিলা খাতুন বলে, আমরা যখন নদী পার হয়ে নৌকায় চড়ে বিদ্যালয়ে আসি, তখন অনেক ভয় লাগে। কারণ অনেক সময় নদী ভরা থাকে, আবার স্রোতও বেশি থাকে। তখন নৌকা থেকে পড়ে গেলে আমাদের বই-খাতা ভিজে যায়। আমরা বড়, সাঁতরাতে পারি আবার সেসময় চিৎকার করলে অভিভাবকরা এগিয়ে এসে আমাদের উদ্ধার করে। কিন্তু ছোট ভাইয়েরা সাঁতরাতেও পারে না, জোড়ে চিৎকার করতেও পারে না। এজন্য এখানে আমরা একটা সেতু চাই।

এক শিক্ষার্থীর মা মুনিরা খাতুন বলেন, স্কুলে আসার পথে যানবাহনের তেমন কোনো ব্যবস্থা নেই। এজন্য আমরা নদী পার করে বাচ্চাদের স্কুলে নিয়ে আসি। আবার নিয়ে যাই। যদি এখানে একটি সেতু থাকতো। তাহলে বাচ্চাদের নিয়ে তেমন কোনো কষ্ট হতো না। তারা নিজেরাই স্কুলে আসতে পারতো, আবার বাড়ি ফিরতে পারতো। এতে আমাদের চিন্তা হতো না। এই নৌকা দিয়ে না এসে রাস্তা দিয়ে আসলে অনেক দূর ঘুরতে হয়। সেই রাস্তাটাও একেবারে খারাপ।

আরেক শিক্ষার্থীর মা খাদিজা খাতুন বলেন, আমাদের ছোট ছোট বাচ্চা। সরকার নিয়ম করছে এখন পাঁচ বছর থেকে স্কুলে ভর্তি হতে। এই বয়সে যদি বাচ্চাকে নদীর ওই পাড়ের স্কুলে ভর্তি করে দেব। নদী যখন ভরে যাবে, তখন বাচ্চারা নৌকায় কীভাবে পার হয়ে যাবে। সরকার তো কত জায়গায় ব্রিজ করে দেয়। আমাদের এখানে কি নজর পড়ে না?

স্থানীয় তৌহিদুল ইসলাম, মোহসিনা বেগমসহ কয়েকজন বলেন, এই বিদ্যালয়ে আটটি গ্রামের শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা করে। এর মধ্যে নদীর ওই পাশের শিক্ষার্থীই বেশি। তারা রাস্তা দিয়ে বিদ্যালয়ে আসতে অনেক পথ ঘুরতে হয়। সেই রাস্তার অবস্থাও খুবই খারাপ। বর্ষা হলে চলাফেরা করাই মুশকিল। তাই বাচ্চারা দূরের পথ কষ্ট করে না ঘুরে নৌকা দিয়ে নদী পার হয়ে বিদ্যালয়ে আসে। এতেও তাদের চরম ঝুঁকি থাকে। যেকোনো সময় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। তাই আমরা এই স্থানে একটি সেতু নির্মাণের দাবি জানাই।

মুরারীপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক প্রণব চন্দ্র মন্ডল ঢাকা পোস্টকে বলেন, এই স্কুলের বড় সমস্যা নদী পথ। আমি যখন ২০১৫ সালে এই বিদ্যালয়ে যোগদান করি, তখন স্কুলের শিক্ষার্থী সংখ্যা ছিল ২১২ জন। কিন্তু যোগাযোগ ব্যবস্থা খারাপের কারণে শিক্ষার্থীর সংখ্যা এখন ১৬০ জন। নদীটি খনন করার ফলে গভীরতা বেড়ে যাওয়ায় ছোট ডিঙি নৌকায় চড়ে নদী পারাপার হতে ছেলেমেয়েরা ভয় পায়। এখন নতুন নতুন শিক্ষার্থী যারা ভর্তি হতে চাচ্ছে, তাদের অভিভাবকরা যোগাযোগ ব্যবস্থা খারাপের কারণে ভর্তি করাতে চাচ্ছে না। এখানে একটা সেতুর খুবই প্রয়োজন। একটি সেতু করে দেওয়ার জন্য আমি সরকারের কাছে আকুল আবেদন জানাচ্ছি।

এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আলাউদ্দিন হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, মুরারীপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সংলগ্ন নদীতে একটি সেতু নির্মাণের জন্য জেলা প্রশাসন থেকে আমাদেরকে তাগিদপত্র দেওয়া হয়েছে। সেখানে সেতু করার জন্য সরেজমিনে পরিদর্শন করে স্থানীয় সংসদ সদস্যের সঙ্গে আলোচনা করা হয়েছে। তিনি শিগগিরই সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেবেন বলে আমাদেরকে আশ্বস্ত করেছেন।

এ ব্যাপারে জয়পুরহাট-১ আসনের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট সামছুল আলম দুদু ঢাকা পোস্টকে বলেন, ছেলেমেয়েরা স্কুলে আসে, তাদের জন্য একটি সেতু দরকার। আগামী অর্থবছরের মধ্যে সেতুটি করার চেষ্টা করবো। 

আরএআর