বিভিন্ন নাটকীয়তা ও বাধা উপেক্ষা করে বঙ্গবন্ধু উদ্যানে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে বিএনপির বরিশাল বিভাগীয় গণসমাবেশ। শনিবার (৫ নভেম্বর)  দুপুর ২টায় সভা মঞ্চে শুরু হবে মূল আলোচনা। গণসমাবেশের সার্বিক প্রস্তুতি এরই মধ্যে সম্পন্ন হয়েছে বলে জানিয়েছেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন।

তিনি জানান, গণসমাবেশের অতিথিবৃন্দ ইতোমধ্যে বরিশালে এসে পৌঁছেছেন।

শনিবার রাত ১টার দিকে সমাবেশস্থলে গিয়ে দেখা যায়, মাঝরাতেও থেমে নেই বিএনপি নেতা-কর্মীদের স্লোগান। মূল মঞ্চের দুই পাশের সামিয়ানার নিচে এবং পশ্চিম পাশে গাছের নিচে তাঁবু টানিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন নেতা-কর্মীরা। অনেকেই কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমাচ্ছেন। আবার অনেকে কম্বল ভাগে না পেয়ে নিজের পোশাক দিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা করছেন।

প্রস্তুত সভা মঞ্চ 

বিভাগীয় গণসমাবেশের মূল মঞ্চ ৫০ ফুট দৈর্ঘ্যের এবং ৩৫ ফুট প্রস্থে প্রস্তুত করা হয়েছে। মঞ্চের সামনে গণমাধ্যমকর্মীদের জন্য আলাদা টং নির্মাণ করা হয়েছে। শুক্রবার সন্ধ্যায় মঞ্চ পরিদর্শন করেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী। এ সময়ে তার সঙ্গে স্থানীয় বিএনপির নেতবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। নিরবচ্ছিন্ন সভা চালানোর জন্য আলাদা জেনারেটরের ব্যবস্থা করা হয়েছে। যুক্ত করা হয়েছে ইন্টারনেট সংযোগও। এছাড়া নারী ও পুরুষ নেতাকর্মীদের জন্য পৃথক স্থান নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে।

বিনা পয়সায় খাবার

বৃহস্পতিবার বিকেল থেকে সমাবেশস্থলে অবস্থান করা নেতা-কর্মীদের স্ব স্ব উপজেলা ও জেলা বিএনপির নেতৃবৃন্দ খাবার ও শীতবস্ত্রের ব্যবস্থা করছেন। 

ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার বিএনপি কর্মী আব্দুর রহিম সরদার বলেন, আমরা ভোলা থেকে কমপক্ষে ১০ হাজার নেতা-কর্মী ট্রলারে করে এসেছি। যারা এসেছি তাদের তিন বেলার খাবার ও রাতে থাকার কম্বল আমাদের উপজেলা জেলার নেতারা দিয়েছেন। 

আরও পড়ুন : আগের রাতেই কানায় কানায় পূর্ণ বিএনপির সমাবেশস্থল

আরেক কর্মী মহসনি সিকদার বলেন, ট্রলার ভাড়া ও তিন দিনের থাকা-খাওয়া বাবদ ১ হাজার টাকা দিয়েছি মাত্র। 

পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া উপজেলার যুবদল নেতা সাইদুল ইসলাম বলেন, আমাদের উপজেলা থেকে ৪১০০ নেতাকর্মী এসেছেন। আমাদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করেছেন সভাপতি-সম্পাদক।

উপায় ছিল ট্রলার

গণসমাবেশের এক সপ্তাহ আগে বরিশালে বাস চলাচল বন্ধ করা হয়। এরপরে ইজিবাইক, স্পিড বোট, লঞ্চ, মাইক্রোবাস এমনকি খেয়া বন্ধ করে দেওয়ার আশঙ্কা থেকেই বিভাগের বিভিন্ন এলাকা থেকে ট্রলার ভাড়া করে যাত্রীরা সমাবেশস্থলে এসেছেন। তবে বরিশাল শহর লাগোয়া কোনো নদীতে সেই ট্রলার নোঙর করা হয়নি। সেগুলো বরিশালের নিকটস্থ উপজেলায় নোঙর করে তারপরে রিকশা বা হেঁটে সমাবেশে এসেছেন অনেকেই। 

আনোয়ার মৃধা নামে একজন বলেন, বস্তায় করে চাল,ডাল, আলু, তেল নিয়ে এসেছি। সরকার যা শুরু করেছে তাতে খাবার হোটেলও বন্ধ করে দিতে পারে। তাই খাবার নিয়ে এসেছি। 

আরও পড়ুন : হেঁটে সমাবেশস্থলে যাচ্ছেন বিএনপি নেতাকর্মীরা 

বিএনপি নেতা মাসুদ বলেন, ভোলা থেকে লঞ্চ, স্পিড বোট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। পরবর্তীতে আমরা একটি ট্রলার রিজার্ভ করে বরিশালে পৌঁছেছি। সব বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরে আমাদের উপায় ছিল ট্রলার।

হোটেলের সবাই অসুস্থ!

বরিশাল নগরীর দুই শতাধিক আবাসিক হোটেলে একটি কক্ষও খালি নেই এ সমাবেশকে ঘিরে। একাধিক হোটেলের ম্যানেজারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২ নভেম্বরের মধ্যেই সকল রুম ভাড়া হয়ে যায়। 

হাফিজুর রহমান নামে এক হোটেল মালিক বলেন, অনেকেই বাড়ি থেকে প্রেসক্রিপশন, ডাক্তার দেখানোর কাগজ সঙ্গে করে নিয়ে এসেছেন। কৌশল অবলম্বন করে তারা কক্ষ ভাড়া নিয়েছেন। ফলে হোটেল মালিকদের রুম ভাড়া দিতে হয়েছে। সব হোটেলেই যারা রয়েছেন তারা কারণ হিসেবে দেখিয়েছেন ডাক্তার দেখাতে এসেছেন, যেন সবাই অসুস্থ।

যেন বিএনপির পিকনিক

এক যুগেরও বেশি সময় ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপির নেতাকর্মীরা বরিশাল বিভাগীয় গণসমাবেশ উপলক্ষে যেন পিকনিকের আমেজ পাচ্ছেন তারা। সমাবেশ উদ্যানে খাওয়া-দাওয়া, গান, মিছিল করে সময় কাটাচ্ছেন। 

আরিফুর রহমান নামে বাউফলের এক ছাত্রনেতা বলেন, অনেকদিন পরে আমরা মিলিত হয়েছি। একটি শক্তি এসে গেছে। মনে হচ্ছে আমরা পিকনিকে এসেছি।

আসতে পারে সরকার পতনের আন্দোলনের ঘোষণা 

বিভাগীয় গণসমাবেশর মধ্যে বরিশাল বিভাগীয় সমাবেশ বেশ গুরুত্ব রাখে বিএনপির কাছে। একসময়ে বিএনপির ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত এই বিভাগের সমাবেশ থেকে সরকার পতনের ডাক দিতে পারেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলে ধারণা করছেন নেতাকর্মীরা। এছাড়াও খালেদা জিয়ার মুক্তি, তারেক রহমানকে দেশে ফিরিয়ে আনা, সরকারে অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলবেন নেতবৃন্দ। 

সিনিয়র দুই নেতার সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, খুব গুরুত্বপূর্ণ সমাবেশ হিসেবে দেখছেন এ বিভাগের সমাবেশকে। তবে কী ঘোষণা আসবে তা আগেভাগেই বলা যাচ্ছে না।

খালি রাখা হবে খালেদার জন্য চেয়ার

অন্যান্য বিভাগীয় গণসমাবেশর মতো বরিশালের সমাবেশেও বিএনপির চেয়ারপার্সন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার জন্য চেয়ার খালি রাখা হবে বলে জানিয়েছেন বরিশাল মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব মীর জাহিদুল কবির জাহিদ। 

তিনি জানান, সভার সভাপতিত্ব করবেন মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক মনিরুজ্জামান ফারুক।

বিচ্ছিন্ন বরিশাল

গণসাবেশকে ঘিরে বরিশাল শহরের সঙ্গে অন্যান্য জেলা উপজেলার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। সর্বশেষ শুক্রবার বরিশাল থেকে কোনো লঞ্চ ছেড়ে যায়নি। এর আগে বন্ধ করা হয়েছে বাস, ইজিবাইক, স্পিড বোট, মাইক্রোবাস। ফলে রাজনৈতিক নেতাকর্মীর বাইরে সাধারণ মানুষ দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন।

কেন্দ্রীয় বিএনপির সদস্য ও সাবেক সংসদ সদস্য মেজবাহ উদ্দিন ফরহাদ বলেন, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পূর্বে আকাশ পথে বিমানে বরিশাল বিমানবন্দরে এসে পৌঁছান বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, মঈন খান, আমির খসরু মাহামুদ। বরিশাল বিমানবন্দরে কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দকে অভ্যর্থনা জানান বরিশাল জেলা, মহানগর এবং বিভাগীয় নেতৃবৃন্দ। পরে তাদের মোটরসাইকেলের বহরে বরিশাল নগরীতে নিয়ে আসা হয়। 

তিনি বলেন, সমাবেশ সফল করার লক্ষ্যে আগে থেকেই বরিশালে অবস্থান করছেন বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য বেগম সেলিমা রহমান ও ভাইস চেয়ারম্যান জয়নুল আবেদিন, ডা. এজেডএম জাহিদ হাসান, কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম মহাসচিব মজিবর রহমান সরোয়ার, হাবিব উন নবী খান সোহেলসহ দলের সিনিয়র নেতৃবৃন্দ।

আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি শান্তিপূর্ণ

শুক্রবার বিকেলে ছাত্রদল ও ছাত্রলীগের পাল্টাপাল্টি মোটরসাইকেল মহড়ায় চাপা আতঙ্ক ছড়ালেও নগরীর কোথাও কোনো অপ্রীতিকর পরিস্থিতির খবর পাওয়া যায়নি। নগরীর প্রবেশদ্বার ও মোড়ে মোড়ে কড়া নজরদারিতে রয়েছে মেট্রোপলিটন পুলিশ। 

বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার সাইফুল ইসলাম বলেছেন, সমাবেশ শান্তিপূর্ণভাবে পালন করলে কোনো বাধা প্রয়োগ করা হবে না। কিন্তু বিশৃঙ্খলা করা হলে আইন প্রয়োগ করা হবে।  

এদিকে বঙ্গবন্ধু উদ্যানে স্থাপিত জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ম্যুরালের নিরাপত্তায় ৬০ জন আনসার সদস্য নিযুক্ত করা হয়েছে। 

সৈয়দ মেহেদী হাসান/এসকেডি