অনুমোদনের অপেক্ষায় ইলিশের নতুন প্রজনন ক্ষেত্র
মাছের রাজা বলা হয় ইলিশকে। যত মাছই থাকুক না কেন, স্বাদে আর গুণে অন্য কোনো মাছের সঙ্গে এর তুলনা চলে না। ইলিশ পছন্দ করেন না এমন বাঙালি খুঁজে পাওয়া ভার। চিকিৎসকদের মতে, ইলিশ বলবর্ধক, বাতনাশকসহ আরও নানা গুণের অধিকারী। হৃদরোগীদের জন্যও ইলিশের তেল বেশ উপকারী। এতসব গুণের কারণেই মাছের রাজার মর্যাদা পেয়েছে এ মাছটি।
বাংলাদেশের জাতীয় মাছ ইলিশ নিয়ে ভোজনরসিক এবং রপ্তানির জন্য নতুন সুখবর নিয়ে এসেছে ময়মনসিংহে অবস্থিত বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএফআরআই)। দেশের দক্ষিণাঞ্চলে বলেশ্বর নদীর প্রায় ৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ এবং প্রায় সাড়ে ৩০০ বর্গকিলোমিটার বিস্তৃত অঞ্চল নিয়ে একটি নতুন প্রজনন ক্ষেত্র করার প্রস্তাব করেছে প্রতিষ্ঠানটি। পানির ভৌত রাসায়নিক গুণাগুণ, প্রাকৃতিক খাদ্যের প্রাচুর্যতা, ভৌগোলিক অবস্থানসহ ইলিশের প্রজনন ক্ষেত্রে যা প্রয়োজন, তার সবকিছুই রয়েছে এই বলেশ্বরে।
বিজ্ঞাপন
জানা গেছে, অনুমোদন পেলে এটি হবে ইলিশের পঞ্চম প্রজনন ক্ষেত্র। এতে করে সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে বছরে ৫০ হাজার মেট্রিক টন বাড়তি ইলিশ উৎপাদনের। ফলে বছরে প্রায় ছয় লাখ মেট্রিক টনের বেশি ইলিশ উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে। এর আগে ৭ হাজার বর্গকিলোমিটার বিশিষ্ট মায়ানী-মীরসরাই, পশ্চিম সৈয়দ আওলিয়া পয়েন্ট-তজুমুদ্দিন, গন্ডামারা-বাঁশখালী ও লতাচাপালি-কলাপাড়া এলাকার মোহনা অঞ্চলে আরও চারটি প্রজনন ক্ষেত্র শনাক্ত করা হয়।
প্রতিষ্ঠানটি বলছে, বাগেরহাট, পিরোজপুর এবং বরগুনা জেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত বলেশ্বর ও বলেশ্বর নদীর মোহনা অঞ্চল মিলিয়ে গড়ে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য বিশিষ্ট ৩৪৮ বর্গকিলোমিটার বিস্তৃত এলাকাকে ইলিশের পঞ্চম প্রজনন ক্ষেত্র করার প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছে। এতে করে বছরে গড়ে প্রায় ৮০০ কোটি নতুন লার্ভি ইলিশ এবং ৩৫০ কোটি অন্যান্য মাছের পোনা মৎস্য পরিবারের সঙ্গে নতুন করে যুক্ত হবে।
ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ জানান, বর্তমান সরকার ইলিশ উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে নানামুখী গবেষণা কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। এরই ধারাবাহিকতায় বিএফআরআই’র বিজ্ঞানীরা গত তিন বছরের গবেষণায় বলেশ্বর নদীতে ইলিশের ব্যাপক প্রজননের সম্ভাবনার প্রমাণ পেয়েছেন। বিএফআরআই এর আগে যে চারটি ইলিশের প্রজনন ক্ষেত্র চিহ্নিত করেছে, তার সঙ্গে এই এলাকার জলজ পরিবেশ এবং মাছের ডিম ছাড়ার বৈশিষ্ট্যের সাদৃশ্য রয়েছে।
তিনি আরও জানান, প্রজনন ক্ষেত্র যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা গেলে ইলিশের উৎপাদন বছরে আরও ৫০ হাজার মেট্রিক টন বাড়বে। এছাড়াও ইলিশের সহনশীল আহরণ মাত্রা ৭ লাখ ২ হাজার মেট্রিক টন নির্ধারণ করা হয়েছে। এতে বর্তমান উৎপাদন থেকে আরও প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টনের অধিক ইলিশ আহরণ করা যাবে।
বিএফআরআইয়ের গবেষণার ফলাফল বলছে, ২০১৯ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত বলেশ্বর নদের মোহনা অঞ্চলে ইনস্টিটিউট গবেষণা চালায়। গবেষণায় তিনটি বিষয় মিলেছে। এর মধ্যে প্রজননক্ষম ইলিশের আধিক্য, ইলিশের বসবাসের অনুকূল পরিবেশ এবং লার্ভি অর্থাৎ ডিম ফুটে বেরুনো বাচ্চা ইলিশ এবং প্রচুর জাটকার সন্ধান মিলেছে।
জানা যায়, তিন বছরের গবেষণার ফলাফল অনুযায়ী প্রস্তাবিত প্রজনন এলাকায় বছরওয়ারী ডিমওয়ালা মাছের সংখ্যা যথাক্রমে ৬৫, ৬৯ এবং ৫১ শতাংশ। ডিম ছাড়ারত মাছের সংখ্যা যথাক্রমে ৪৯, ৫৫ এবং ৪৩ শতাংশ এবং ডিম ছেড়ে দেওয়া মাছের সংখ্যা যথাক্রমে ৪৫, ৫০ এবং ৪০ শতাংশ। এছাড়াও প্রজননোত্তর ইলিশ মাছের হার যথাক্রমে ৪৫, ৫০ এবং ৪০ শতাংশ শনাক্ত করা হয়েছে।
বিএফআরআইয়ের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরে ইলিশের বার্ষিক উৎপাদন ছিল ৫ লাখ ৬৫ হাজার মেট্রিক টন। এই মুহূর্তে দেশে মোট মাছের উৎপাদনের ১২ দশমিক ২১ শতাংশ ইলিশ, জিডিপিতে যার অবদান বছরে এক শতাংশের বেশি।
উবায়দুল হক/এসপি