মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্রে বোমা বিস্ফোরণে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে নিয়োজিত নিহত শান্তিরক্ষী জাহাঙ্গীর আলমের মরদেহ শনিবার (১৫ অক্টোবর) দুপুর ১২টায় নীলফামারীর ডিমলার দক্ষিণ তিতপাড়া গ্রামে পৌঁছেছে। পরে দক্ষিণ তিতপাড়া জামে মসজিদ প্রাঙ্গণে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে গার্ড অব অনার ও নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। দুপুর ১টার দিকে সম্পূর্ণ সামরিক মর্যাদায় পারিবারিক কবরস্থানে এই শহীদের দাফন সম্পন্ন হয়। 

এর আগে বেলা ১১টা ১০ মিনিটে ডিমলা রাণী বৃন্দারাণী সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে জাহাঙ্গীরের মরদেহ নিয়ে সেনাবাহিনীর একটি হেলিকপ্টার অবতরণ করে।

জাহাঙ্গীরের মরদেহ বহনকারী অ্যাম্বুলেন্স বাড়িতে পৌঁছামাত্র এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। মরদেহ দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন স্বজন ও প্রতিবেশীরা। বিশেষ করে মা গোলেনুর বেগম এবং বাবা লতিফর রহমান ও স্ত্রী শিমু আকতার মরদেহ দেখে বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন। 

স্বজন ও প্রতিবেশীদের কান্নায় ভারী হয়ে ওঠে এলাকার পরিবেশ। জাহাঙ্গীরকে একনজর দেখার জন্য ডিমলা রাণী বৃন্দারাণী সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় মাঠ ও তার বাড়িতে আগে থেকেই জড়ো হন কয়েক হাজার মানুষ। 

এ সময় স্থানীয় সংসদ সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা আফতাব উদ্দিন সরকার বাবা ও মাকে সান্ত্বনা দেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানান। সমবেদনা জানাতে এসেছিলেন প্রশাসনের কর্মকর্তারাও।

জাহাঙ্গীর আলম ডিমলা উপজেলার দক্ষিণ তিতপাড়া গ্রামের লতিফর রহমানের ছেলে। পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন চতুর্থ। ২০১৫ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেন জাহাঙ্গীর। ২০২১ সালে ১২ ডিসেম্বর সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিকের ব্যানব্যাট-৮ এলাকার উইক্যাম্পে শান্তিরক্ষা মিশনে যান তিনি।

সেনাবাহিনী সূত্রে জানা গেছে, নিহত সৈনিক জাহাঙ্গীর আলম পার্ক ইস্ট বেঙ্গলে থাকা কালীন ডেল্টা কোম্পানিতে কর্মরত ছিলেন। চাকরি জীবনে তার ওপরে অর্পিত যে কোনো দায়িত্ব তিনি সফলতার সঙ্গে পালন করেছেন। চাকরি জীবনে জাহাঙ্গীর আলম স্বাভাবিক কোর্স বিএমআর ও আইটি ট্রেনিংয়ে সফলতার সঙ্গে অংশগ্রহণ করেন। 

এছাড়া ২০১৯ সালে সদর দপ্তরে থাকাকালীন ১৯ পদাধিক ডিভিশনে তত্ত্বাবধানে পরিচালিত আঞ্চলিক এসোল্ট কোর্স প্রতিযোগিতায় ৩য় স্থান লাভের গৌরব অর্জন করেন জাহাঙ্গীর আলম। এসোল্ট কোর্সে বিশেষ পারদর্শিতা প্রদর্শন করায় বিশেষ কোটায় ব্যানব্যাট-৮ প্রজত্নে ৬১ ইস্ট বেঙ্গলের সঙ্গে নির্বাচিত হয়ে বৈদেশিক মিশনে গমন করেন। 

সেনা কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন তানজিদুল ইসলাম বলেন, নিহত সৈনিক জাহাঙ্গীর আলম কর্মজীবনে সকল দায়িত্ব সফলতার সঙ্গে পালন করেছেন। তাকে পারিবারিক কবরস্থানে সামরিক মর্যাদায় মরদেহ দাফন করা হয়েছে।

জাহাঙ্গীর আলমের বড় ভাই কর্পোরাল আবুজার রহমান বলেন, আমার ভাই সৈনিক জাহাঙ্গীর আলম যেমন একজন দায়িত্ববান সৈনিক ছিলেন, তেমনি খেলাধুলা ও অন্যান্য বিষয়ে পারদর্শী ছিলেন। আল্লাহ তাকে জান্নাত দান করুক এবং আমার বাবা মা ও তার স্ত্রীকে ধৈর্য ধরার তওফিক দান করুক।

স্থানীয় সংসদ সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা আফতাব উদ্দিন সরকার বলেন, শহীদ জাহাঙ্গীর আলমের মৃত্যুতে আমরা যেমন শোকাহত তেমনি তার মৃত্যু আমাদের জন্য গর্বের। দেশে জন্য সে জীবন দিয়েছে সে আমাদের দেশের গর্বিত সন্তান। জাহাঙ্গীরের বাড়ির সামনের সড়কটি 'শহীদ জাহাঙ্গীর সড়ক' ঘোষণা করা হলো। কাঁচা সড়কটি দ্রুত পাকা করা হবে।

গত ৩ অক্টোবর স্থানীয় সময় রাত সাড়ে আটটায় সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিকে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের কার্যক্রম পরিচালনার সময় বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের একটি বহর টহল থেকে ফেরার সময় পথে ইমপ্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইসের (আইইডি) বিস্ফোরণ ঘটে। এতে বহরের প্রথম গাড়িটি আক্রান্ত হয়। সেটি ছিটকে ১৫ ফুট দূরে গিয়ে পড়ে। এতে তিন বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী নিহত ও একজন আহত হন।

গতকাল শুক্রবার (১৪অক্টোবর) বিকেল ৫টায় আফ্রিকান এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইটে জাহাঙ্গীরের মরদেহ হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছায়। জাহাঙ্গীরের বড় ভাই আবুজার রহমান মরদেহ গ্রহণ করেন। বিমানবন্দরের আনুষ্ঠানিকতা শেষে সন্ধ্যার দিকে মরদেহ নেওয়া হয় ঢাকা সেনানিবাসে। 

পরদিন সকালে সেখানে জানাজার পর সেনাপ্রধান এই শহীদের সম্মানে কফিনে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। এরপর জাহাঙ্গীরের মরদেহ তার নিজ গ্রামের বাড়ি নীলফামারীর ডিমলায় পাঠানো হয়। সেখানে ডিমলা রানী বৃন্দা রানী সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে হেলিকপ্টারে করে বেলা ১১টায় তার মরদেহ পরিবারের মাঝে হস্তান্তর করা হয়।

সম্পূর্ণ সামরিক মর্যাদায় মরহুমের দাফনকার্য সম্পন্ন হয়। এ সময় পার্বতীপুর শহীদ মাহমুদ সেনানিবাস থেকে ক্যাপ্টেন তানজিদুল ইসলামের নেতৃত্বে ২৫ জন সেনাসদস্যের একটি দল সশস্ত্র সালাম প্রদান করে।

শরিফুল ইসলাম/এমএএস