‘আমার অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করে কোনো লাভ হবে না’
গোপালগঞ্জে একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের এক শিক্ষিকাকে নিয়ে বিদ্যালয়জুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। প্রধান শিক্ষক ছাড়া স্কুলের কোনো শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভবকরা তাকে চেনেন না। আবার তিনি এমপিওভুক্তও হয়েছেন। প্রতিমাসে বেতনও নিচ্ছেন। অস্তিত্বহীন ওই শিক্ষিকার নাম সুতৃষ্ণা বর। তাকে ওই স্কুলের বাংলা বিষয়ের শিক্ষক হিসেবে দেখানো হচ্ছে।
গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া উপজেলার ত্রিপল্লী শেখ আবু নাসের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে এ ঘটনা ঘটেছে।
বিজ্ঞাপন
বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী, অভিবাবক ও এলাকাবাসী বলছে, প্রধান শিক্ষক মৃণাল কান্তি ঢালী দুর্নীতি ও অনিয়ম করে ওই নারীকে একাই নিয়োগ দিয়েছেন।
এদিকে ওই অস্তিত্বহীন শিক্ষিকা সুতৃষ্ণা বরের নিয়োগের তারিখ দেখানো হয়েছে স্কুলের বাংলা বিষয়ের সাবেক শিক্ষিকা উৎপলা বিশ্বাসের যোগদানের তারিখে। এছাড়াও বিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে সুতৃষ্ণা বরের পরিবর্তে প্রধান শিক্ষকের স্ত্রী সাধনা রানী বিশ্বাসের ছবি ব্যবহৃত হয়েছে। যদিও প্রধান শিক্ষকের স্ত্রী সাধনা রানী টুঙ্গিপাড়া উপজেলার নবুখালী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা।
বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর এলাকায় নানা আলোচনা-সমালোচনার সৃষ্টি হয়েছে। ইতোমধ্যে স্কুলের প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ এনে দুর্নীতি দমন কমিশনে লিখিত অভিযোগ করা হয়েছে। টুঙ্গিপাড়া উপজেলার শ্রীরামকান্দি গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা জাহাঙ্গীর হোসেন প্রধান শিক্ষক মৃণাল কান্তি ঢালীর বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাৎ, নিয়োগ বাণিজ্য, স্বেচ্ছাচারিতাসহ বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ এনে দুর্নীতি দমন কমিশনে লিখিত অভিযোগ করেছেন।
বীর মুঙ্গিযোদ্ধা জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, প্রধান শিক্ষক মৃণাল কান্তি ঢালী এককভাবে বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি, সদস্য ও শিক্ষকদের অগোচরে মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে অবৈধ নিয়োগ বাণিজ্য ও দুর্নীতি করে আসছেন। ২০১৪ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি বিদ্যালয়ের গণিত ও বাংলা বিষয়ে শিক্ষক নিয়োগের দুটি বিজ্ঞপ্তি দেন। ২০১৪ সালের ২৮ এপ্রিল অনুষ্ঠিত নিয়োগ পরীক্ষায় সহকারী শিক্ষক বাংলা বিষয়ে উৎপলা বিশ্বাস ও গণিত বিষয়ে সুশান্ত মালাকার নিয়োগ পান। উৎপলা বিশ্বাস ২০১৪ সালের ৩ মে হতে ২০১৬ সালের ৬ জুন পর্যন্ত সহকারী শিক্ষক বাংলা বিষয়ে নিয়মিত পাঠ দান করান। পরে উৎপলা বিশ্বাসের একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চাকরি হয়। ২০১৬ সালের ৭ জুন মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে অব্যাহতি নিয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যোগদান করেন।
২০১৬ সালে বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির কোনো সহকারী শিক্ষক নিয়োগের ক্ষমতা ছিল না । কারণ ২০১৫ সালের ২২ নভেম্বর থেকে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সকল সহকারী শিক্ষক নিয়োগ কার্যক্রম এনটিআরসিএ নিয়ে নেয়।
উৎপলা বিশ্বাস অব্যাহতি নেওয়ার পর প্রধান শিক্ষক মৃণাল কান্তি অবৈধভাবে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি, পরীক্ষা ও রেজুলেশন ছাড়াই ১০ লাখ টাকার বিনিময়ে সুতৃষ্ণা বর নামে এক নারীকে বাংলা বিষয়ের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেন। এছাড়া ওই বিদ্যালয়ে কর্মরত শিক্ষকদের এমপিওভুক্ত, বিল ছাড়করণে প্রধান শিক্ষক মোটা অংকের ঘুষ গ্রহণ করেছেন বলেও অভিযোগে উল্লেখ করেছি।
ত্রিপল্লী শেখ আবু নাছের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ইংরেজি বিষয়ের শিক্ষিকা রুমা খানম বলেন, ২০১৯ সাল থেকে আমার নিয়োগের পর থেকে সুতৃষ্ণা বর নামে কোনো শিক্ষিকাকে বিদ্যালয়ে পাঠদান করাতে দেখিনি। ওই নামে কোনো শিক্ষিকাকে বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরাও চেনে না।
গণিতের শিক্ষক সুশান্ত মালাকার মালাকার বলেন, ২০১৪ সালে আমার ও উৎপলা বিশ্বাসের নিয়োগ হয়। উৎপলা বিশ্বাস ২০১৬ সাল পর্যন্ত বাংলা বিষয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের পাঠদান করান। কিন্তু সুতৃষ্ণা বর নামে কোনো শিক্ষিকাকে আজ পর্যন্ত স্কুলে আসতে দেখিনি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই বিদ্যালয়ের আরও এক শিক্ষক বলেন, প্রধান শিক্ষক মৃণাল কান্তি শুধু সুতৃষ্ণা বরই না অনেক শিক্ষককে নিয়োগ দিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। নৈশ প্রহরীর বিল করতে, মাধ্যমিক স্বীকৃতি, এমপিওকরণ, অডিট বাবদ আমাদের কাছ থেকে লাখ-লাখ টাকা নিয়েছেন। এছাড়া করোনাকালে ঢাকা যাতায়াত বাবদ বিদ্যালয়ের তহবিল থেকেও মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। প্রধান শিক্ষক নিজের খোয়াল-খুশি মতো বিদ্যালয়ে আসা যাওয়া করেন। ডিজিটাল হাজিরা অন্যান্য বিদ্যালয়ে আছে। কিন্তু এই বিদ্যালয়ে চালু করা হয়নি। শিক্ষকদের হাজিরা খাতা প্রধান শিক্ষকের জিম্মায় তার কক্ষে তালাবদ্ধ থাকে। আমরা দুর্নীতিবাজ প্রধান শিক্ষকের অপসারণ চাই।
ওই বিদ্যালয়ের সাবেক বাংলা বিষয়ের শিক্ষিকা উৎপলা বিশ্বাস বলেন, আমি ওই বিদ্যালয়ে ২০১৪ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত কমর্রত ছিলাম। তারপর আমার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চাকরি হয়। তখন থেকে আমি টুঙ্গীপাড়ার ডুমরিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষকতা করে আসছি।
ওই স্কুলের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী অর্থি বলে, আমি কোনো দিন সুতৃষ্ণা নামে কোনো শিক্ষিকাকে দেখিনি। তার কাছে কোন দিন ক্লাসও করিনি।
সুতৃষ্ণা বর অস্তিত্বহীন শিক্ষিকা নন দাবি করে প্রধান শিক্ষক মৃণাল কান্তি ঢালী বলেন, তাকে বৈধভাবেই নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। চলতি বছরের শুরুতে তিনি এমপিওভুক্ত হয়েছেন। নিয়মিত বিল তুলছেন। এমপিও হতে দেরি হয়েছে। তাই তিনি স্কুলে অনুপস্থিত ছিলেন। এখন স্কুলে আসবেন। তার নিয়োগে কিছু খরচ করতে হয়েছে। এজন্য হয়ত অভিযোগ উঠেছে। আর ভুলবশত সুতৃষ্ণার জায়গায় স্কুলের ওয়েবসাইটে আমার স্ত্রীর ছবি দেওয়া হয়েছে। এটি আমরা সরিয়ে নেব। এছাড়া স্কুল চালাতে গেলে কিছু অনিয়ম করতে হয়। এনিয়ে হয়ত প্রতিপক্ষ অভিযোগ করেছে। এর আগে বিষয়টি নিয়ে আমি এক ডজন সাংবাদিক ফেস করেছি। আমার অনিয়ম, দুর্নীতি ও নিয়োগ বাণিজ্য নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করে কোনো লাভ হবে না।
পরবর্তীতে প্রধান শিক্ষক মৃণাল কান্তি ঢালী এই প্রতিবেদককে তার এক নিকটাত্মীয়ের মাধ্যমে প্রথমে অর্থের লোভ ও পরে হুমকি-ধমকি দেন।
এ বিষয়ে টুঙ্গিপাড়া উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মাহবুবুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিষয়টি নিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপ করেছি। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে ।
টুঙ্গিপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আল মামুন বলেন, প্রধান শিক্ষকের দুর্নীতির বিষয়টি আপনাদের মাধ্যমে জানতে পারলাম। তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
এ বিষয়ে জেলা শিক্ষা অফিসার সিদ্দিকুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, দুদক এ বিষয়টি তদন্তের দায়িত্ব আমাকে দিয়েছে। আমি আজ তদন্ত করে আসছি। আগামী রোববার রিপোর্ট জমা দেব। রিপোর্ট জমা দেওয়ার আগে এর বেশি বলতে পারব না।
আশিক জামান/আরএআর